Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Crackers

কানে তুলো আর নাকে তালা

প্রতি বছর নিয়মমাফিক বাজি ফাটানোর সময় পেরিয়ে শহর জুড়ে শুরু হয় শব্দতাণ্ডব, প্রশাসন তখন অনেকাংশেই স্রেফ নীরব শ্রোতা।

শব্দবাজির তাণ্ডব।

শব্দবাজির তাণ্ডব। ফাইল চিত্র।

জয়ন্ত বসু
শেষ আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০২২ ০৫:২০
Share: Save:

কালীপুজো ও দেওয়ালিকে ঘিরে প্রতি বছর টানটান উত্তেজনা তৈরি হয়— কে জিতবে, শব্দবাজি, না কি প্রশাসন? নব্বইয়ের দশকের শেষ দিক থেকে পরের কয়েক বছর বাদ দিলে কমবেশি শব্দেরই জয় হয়েছে অধিকাংশ সময়। প্রতি বছর নিয়মমাফিক বাজি ফাটানোর সময় পেরিয়ে শহর জুড়ে শুরু হয় শব্দতাণ্ডব, প্রশাসন তখন অনেকাংশেই স্রেফ নীরব শ্রোতা। রেহাই পান না সাধারণ মানুষ থেকে হাসপাতালের রোগী, কেউ-ই।

এ-বারও অন্যথা হয়নি, যদিও প্রেক্ষিতটা খানিক অন্য রকম ছিল। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে সামনে রেখে কলকাতা হাই কোর্ট রায় দিয়েছিল, সবুজ বাজি ছাড়া অন্য কোনও বাজি ফাটানো যাবে না এবং তারও সময়সীমা রাত ৮টা থেকে ১০টা। যে-হেতু এ রাজ্যে বাজির অনুমোদিত শব্দসীমা ৯০ ডেসিবেল, যে মাত্রায় বস্তুত কোনও জোর আওয়াজের বাজিই হয় না, তাই কার্যত কোনও শব্দবাজি ফাটারই কথা নয় কলকাতা-সহ রাজ্যে। কিন্তু দেখা গেল, আক্ষরিক অর্থেই গগনভেদী শব্দবাজি রাজত্ব করল মধ্যরাত পেরিয়ে। বহু অভিযোগ জমা হল। কিছু ক্ষেত্রে কাজ হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চোর-পুলিশ খেলা চলল। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ও পুলিশের ছোট-বড় কর্তাদের জনান্তিকে আত্মসমর্পণের ঢঙে বক্তব্য যে, এত সংখ্যক সাধারণ মানুষ যদি আইন ভাঙেন, তবে কিছু করার থাকে না!

সত্যি কি তা-ই? ১৯৯৬ সালে প্রয়াত বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রায়ের চাপ ও পাশাপাশি দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ এবং প্রশাসনিক যুগলবন্দিতে প্রায় শব্দবিহীন হয়ে গিয়েছিল একের পর এক কালীপুজোর রাত। এ রাজ্যের শব্দ নিয়ন্ত্রণকে মডেল আখ্যা দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। এমনকি ২০০০ সাল নাগাদ কেন্দ্রীয় শব্দবিধিও গড়ে উঠেছিল কলকাতা হাই কোর্টের শব্দনির্দেশের উপর ভিত্তি করে। বাম আমলের শেষ পাঁচ বছর ও বর্তমান তৃণমূল সরকারের সময় আদালতের নজরদারি একটু কমতেই আইনভঙ্গকারীরা উৎসাহিত হল, পাশাপাশি প্রশাসনের চাপ হল শিথিলতর।

এ বছরও প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে বহু প্রশ্ন উঠছে। কেন দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ স্পষ্ট করে ৯০ ডেসিবেল মাত্রার কথা সরকারি ভাবে জানাল না, কেন যথেষ্ট আগে ব্যবস্থা না করে বিপুল পরিমাণ নিষিদ্ধ বাজি তৈরি করতে ও বাজারে আসতে দেওয়া হল, কেন সবুজ বাজি নিয়ে জনমানসে সময়মতো বিভ্রান্তি দূর না করে বেআইনি বাজি ব্যবসায়ীদের সুবিধা করে দেওয়া হল! আদালতের স্পষ্ট নির্দেশ ছিল দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ও পুলিশ, দু’টি কেন্দ্রীয় সংস্থাকে সঙ্গে নিয়ে সঠিক ‘কিউ আর কোড’ আছে এমন বাজিকেই ছাড়পত্র দেবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে বাজি বাজারগুলিতে প্রকাশ্যে বিক্রি শুরু হওয়ার প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী যৌথ নজরদারি শুরু হল, গোটাকয়েক দোকান থেকে বাজি পরীক্ষা করে প্রায় ২৩ কেজি সন্দেহজনক বাজি আটক করা হল। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে তেমন কোনও গ্রেফতার হল না, হল না বিশেষ মামলা রুজু, যদিও আদালত বেআইনি বাজি বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা করতে বলেছিল। পরিবেশবিদরা বাজির বাক্সের উপর ছাপানো কিউ আর কোড পরীক্ষা করে জানালেন যে, বাজি বাজারে বিক্রি হওয়া তথাকথিত সবুজ বাজির নব্বই শতাংশের উপর আসলে জাল। বাজি বাজারের বাইরেও সম্পূর্ণ বেআইনি ভাবে বাজি বিক্রি হল।

ফলে মানুষের হাতে বিপুল পরিমাণ বেআইনি বাজি এল, এবং এই বার্তাও গেল যে, মুখে যা-ই বলুক, সরকার আসলে বেআইনি বাজি আটকাতে চাইছে না। বিরাট কোহলির পাকিস্তান জয়ের কল্যাণে এক দিন আগে শুরু হয়ে কালীপুজো, দেওয়ালি, ছট পেরিয়েও চলছে শব্দবাজি ফাটানো। প্রশাসন কোনও ক্রমে সময়টা পার করে দিতেই ব্যস্ত। আসলে এক অংশের রাজনীতিবিদরা চান না বেআইনি বাজি বন্ধ হোক। বাম আমল থেকে শুরু করে এ আমলেও বেআইনি বাজি ব্যবসা রাজনৈতিক আনুকূল্য পেয়ে এসেছে। ভোটের অঙ্কে তা নাকি গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি দলের দামাল ছেলেদের ডিজে বাজিয়ে, বাজি ফাটিয়ে, পাড়া দাপিয়ে আনন্দ করতে দেওয়ার দায় তো আছেই। এ পথের শরিক সব রাজনৈতিক দলই। তাই বেআইনি বাজি আটকানোর সরকারি ব্যর্থতা নিয়ে রা কাড়েন না কোনও বিরোধী নেতানেত্রী। অথচ, দিল্লিতে আপ সরকার দেখিয়েছে যে, রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে বাজি আটকানো যায়।

পাশাপাশি বিত্তশালী ও আইনকে পাত্তা না দেওয়া এক দল মানুষও নিয়ম ভাঙেন নিয়ম করে; যাঁদের অনেকেই বহুতলের বাসিন্দা। কেননা, শব্দ আইন ভাঙাকে অপরাধ বলেই মানেন না তাঁরা। যেমন মানে না প্রশাসনের একটা বড় অংশ। বেআইনি বাজি নিয়ন্ত্রণ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ নয়, বরং বছরভর চলা টেস্ট ম্যাচ, যেখানে সঠিক পরিকল্পনা করে এগোলে যাবতীয় রাজনৈতিক টানাপড়েন সত্ত্বেও বাজি ও মাইকের এই লাগামছাড়া দাপাদাপি বেশ খানিকটা কমানো যাবে। নয়তো দূষণ ঠেকাতে কানে তুলো আর নাকে তালা লাগানোই ভবিতব্য।

অন্য বিষয়গুলি:

Crackers Diwali Kali Puja Illegal crakers
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy