ছোটদের বাংলা শেখানোর জন্য নতুন ভাবে বই তৈরি করার কথা ভাবা দরকার। —ফাইল চিত্র।
বাসরাস্তা দিয়ে পুরুলিয়া থেকে শান্তিনিকেতন। দুপুর এগোচ্ছে বিকেলের দিকে। চোখে পড়ছিল সাইকেলে ছাত্রছাত্রীদের— স্কুল ভাঙছে, বাড়ি ফিরছে। সরকারি ও সরকার-পোষিত নানা স্কুলে পড়ে তারা, বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ থেকে আসে, উচ্চমধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত বাঙালি ভদ্রলোকদের জগৎ থেকে খানিকটা দূরে তাদের অবস্থান। হয়তো স্বপ্ন দেখে আর্থ-সামাজিক উন্নতির চাকা ঘুরিয়ে এক দিন তারাও ঢুকে পড়বে উচ্চবিত্তের দলে। স্বাভাবিক বাসনা। এই বাসনা পূর্ণ করার জন্য তো পড়াশোনাই গুরুত্বপূর্ণ উপায়। শুধু এই বাসনাই বা কেন! পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্রছাত্রী এখনও পর্যন্ত সরকারি ও সরকার-পোষিত স্কুলেই পড়ে। সেই স্কুলশিক্ষার ব্যবস্থাপনাকে পোক্ত করে তুললে এই বিপুল মানবসম্পদ কাজে লাগিয়ে অনেক সদিচ্ছা, অনেক বাসনাই পূর্ণ করা সম্ভব। অথচ অস্বীকার করার উপায় নেই, অবস্থা ভাল নয়— স্কুলে যাচ্ছে, প্রাথমিক স্তর ডিঙিয়ে ফাইভ-সিক্সে উঠেও যাচ্ছে, কিন্তু বাংলা ভাষাটুকুও বহু ছাত্রছাত্রী ভাল করে লিখতে-পড়তে শিখছে না। কেন এই অবস্থা? আগে তো শিখত, এখন অসুবিধে কোথায়?
এর পিছনে অনেক কারণ, তা নিয়ে অনেক কথাও হয়েছে। বহু দিন ধরেই বহু অব্যবস্থা, গাফিলতি, ভুল নীতি ইত্যাদির ইতিহাস আমাদের অজানা নয়। এর উপর সাম্প্রতিক কালে দুর্নীতির আঠারো ঘা এসে লেগেছে। ইতিমধ্যে আবার উৎসশ্রীর সুবাদে গ্রামের বিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অভাব আরও বেড়েছে— গ্রামের স্কুল থেকে বদলি নিয়ে যাঁরা চলে গেলেন তাঁদের পরিবর্তে নতুন কেউ আসেননি, স্কুলগুলি আরও বিগতশ্রী হয়েছে। এই অবস্থা বদলানোর জন্য নানা দিক থেকে একটা বড় রকমের উদ্যোগ দরকার, সেটা এখন স্পষ্ট। তবে সেই উদ্যোগের একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসাবে ভাবা দরকার ছোটদের বই নিয়ে।
একটা কথা বিশেষ করে মনে রাখতে হবে। ছোটদের জন্য প্রচলিত পাঠ্যপুস্তক ও সহায়ক বইপত্র তৈরি হয়েছিল এক ধরনের সামাজিক পরিসরের কথা মাথায় রেখে, বেশির ভাগ শিশু যে পরিসর থেকে স্কুলে পড়তে আসত। সকলের জন্য শিক্ষার সুযোগ করে দেওয়ার চেষ্টা যখন শুরু হল, তার পর থেকে ছবিটা পাল্টেছে। অনেক দিন ধরেই বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক শ্রেণি থেকে শিশুরা পড়াশোনা করতে আসছে। তাদের জীবনের সঙ্গে প্রচলিত বইগুলির বিষয়বস্তু, ভাষাভঙ্গি, লিখনশৈলীর মিল কম, দূরত্ব বিরাট। এই পরিপ্রেক্ষিতেই ভাবা দরকার, কী পড়বে প্রাথমিক স্তরের ছাত্রছাত্রীরা? কী ভাবেই বা পড়বে?
এর একটা উপায় হতে পারে বাংলা শেখানোর জন্য নতুন ভাবে বই তৈরি করা। অনেকে মিলে সে কাজ করা যেতে পারে। তৈরি করা যায় স্থানীয় স্তরেও। প্রাথমিক শিক্ষার পরিসরে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সামাজিক-অর্থনৈতিক শ্রেণি থেকে উঠে আসা শিক্ষার্থীদের উপর কোনও একটা এবং একটাই প্রাইমার-এর চাপ তৈরি না করে যদি নানা রকম প্রাইমার তৈরি করা যায়, তা হলে কাজটাও অনেক সহজ হয়, বাংলা শেখার সুবিধেও হয়। প্রমিত বাংলার পাশাপাশি নানা আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করারও চেষ্টা করা যেতে পারে। যে সামাজিক-অর্থনৈতিক শ্রেণিতে ছাত্রছাত্রীরা থাকে সেই পরিবেশে বহুলপ্রচলিত শব্দগুলি প্রথমে সংগ্রহ করা যায়। সেই শব্দভান্ডার তৈরির সময় ছাত্রছাত্রী এবং অভিভাবক-অভিভাবিকাদের সাহায্য নেওয়া দরকার। তার পর সেই শব্দের প্রয়োগে গড়ে তোলা যেতে পারে বাংলা শেখানোর অন্য রকম বই।
একটা উদাহরণ দেওয়া যায়। পুরুলিয়ার একটি জায়গা কুশটাঁড়। কুশ শব্দটি সুপরিচিত। টাঁড় শব্দটি প্রমিত বাংলায় প্রচলিত না হলেও একেবারে অপরিচিত নয়। টাঁড় শব্দের অর্থ মাঠ। কুশটাঁড় মানে ঘাসে ঢাকা মাঠ। পুরুলিয়ার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা শেখানোর প্রাইমারে এই ধরনের আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার করা ভাল। একই কথা দক্ষিণ ও উত্তরবঙ্গের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এ ধরনের শব্দের পাশাপাশি একই অর্থের প্রমিত বাংলা শব্দটিও নিশ্চয়ই শিশুদের জানা দরকার। প্রাইমারগুলি ক্লাসে পড়ানোর সময় শিক্ষকেরা সেগুলি সহজেই শিখিয়ে দিতে পারবেন।
বিকল্প বই: একটি পাতা
শুধু তো শব্দ নয়, শব্দের বিন্যাসে বাক্যটি কী ভাবে গড়ে ওঠে সেটি শিশুদের শিখিয়ে দেওয়া চাই। বার বার পড়া আর অভ্যাস করার জন্য ছোট ছোট পাঠ তৈরি করে নেওয়া যায়। একটা-দুটো নয়, অনেক। চটজলদি উদাহরণ হিসাবে বিকল্প বইয়ের যুক্তাক্ষরবিহীন একটি পৃষ্ঠার নমুনা আপাতত দেওয়া যাক। প্রাথমিক অক্ষরপরিচয় হয়েছে এমন শিশুদের জন্য তৈরি এই পাতার বিষয়: সাইকেল। এই দ্বিচক্রযানটি কলকাতার বাইরে বিভিন্ন প্রান্তে শিক্ষার্থীদের নিত্যসঙ্গী, তাদের স্বাধীনতার অবলম্বন।
‘সাইকেল। সাইকেলটা কালো। কালো সাইকেলটা বাবার। বাবার কালো সাইকেলটা ভাল। বাবা কালো-ভাল সাইকেলে মাঠে যায়। আমিও মাঠে যাব। বাবা নিয়ে যাবে। বাবার সাইকেলের পিছনে বসে আমি মাঠে যাব। মাঠে রোদ-জল-আলো। রোদ-জল-আলো ভাল। সকালের রোদ নরম। দুপুরের রোদ গরম। আমি সকালেই যাব। দুপুরে বাড়ি ফিরে ভাত খাব।’
নানা ভাবেই এই অনুচ্ছেদটির পাঠ দেওয়া যায়। যেমন, শিক্ষক যদি কম্পিউটারের সাহায্যে উপযুক্ত ছবি দিয়ে প্রতিটি পাতায় বড় হরফে একটি করে বাক্য বসিয়ে স্ক্রিনে দেখাতে পারেন, ভাল হয়। না হলে শিশুদের হাতে প্রিন্ট দেওয়া যেতে পারে। এক-একটি প্রিন্ট দু’-তিন জন এক সঙ্গে পড়তে পারে, তাতে হয়তো একটা অন্য মজা তৈরি হবে। নিদেনপক্ষে বাক্যগুলি বোর্ডে, স্লেটে বা খাতায় লেখানো যায়। কোনও বাক্যে ক্রিয়া নেই, কোনও বাক্যে আছে। একই শব্দের সঙ্গে বিভিন্ন বিভক্তির যোগ দেখানো আছে; যেমন, সাইকেলটা, সাইকেলের। আবার, কর্তা অনুসারে একই ক্রিয়ার নানা রূপ দেওয়া হয়েছে: যায়, যাবে। কিছু কিছু শব্দের বিশেষ প্রয়োগ আছে; যেমন, নরম রোদ। ছাত্রছাত্রীদের এগুলি খেয়াল করতে ও ভাবতে বলা যায়। সে জন্য পাঠের শেষে নির্দেশ দেওয়া যেতে পারে। যেমন, (১) খেয়াল করো: আমি যাব। আমি খাব। বাবা যায়। বাবা যাবে। সাইকেলটা। সাইকেলে। সাইকেলের। (২) মনে রাখো: নরম আলো। নরম জামা। ভাল মেয়ে। ভাল কথা। ভাল ছেলে। ভাল বই। আবার, কিছু বিকল্প শব্দের কথা খেয়াল করানো যায়। যেমন, (৩) বিকল্প: আব্বার সাইকেল। জল মানে পানি।
শুধু পড়া নয়, এগুলির অনুসরণে ছাত্রছাত্রীদের মুখ দিয়ে নতুন নতুন শব্দ ও বাক্য বলিয়ে নেওয়া দরকার। ‘নরম আলো’ পড়ে কোনও শিশু যদি বলে ‘নরম মন’, তা হলে তো দারুণ হয়! আর, যদি কেউ বলে ‘নরম আঁধার’, তা হলে তো “না, আঁধারের আগে নরম হয় না” বলে তাকে খারিজ করে দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, বরং এমন একটা কথা ভাবতে পারার জন্য বিশেষ তারিফ করা যেতেই পারে। বিকেলের চৌকাঠ ডিঙিয়ে গ্রামের মাঠগুলি যখন আঁধারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সেই ঘন আঁধারের আগে যা এল তা তো নরম আঁধারই বটে!
নিজের ভাষা নিয়ে এমন খেলার সুযোগ মিললে, কিংবা নিজের পরিবেশের শব্দ বসাতে পারলে ছাত্রছাত্রীদের কল্পনা আর ভাষার ভিত পোক্ত হয়ে উঠবে। তারা হয়তো যা শেখানো হল তাকে ব্যবহার করে, কিন্তু তার গণ্ডি ভেঙে বেরিয়ে গিয়ে বলবে: “আমাদের কালো সাইকেল ভাল লাগে না। আমাদের লাল-নীল সাইকেল চাই।” সেই বাক্যগুলি তখন প্রাইমারে ঢুকিয়ে নেওয়া যাবে। এই রকম নতুন প্রাইমারের পাতাগুলি, এক জন নয়, সবাই মিলে খেলতে খেলতে ভাবতে ভাবতে ভরিয়ে তুলতে পারি আমরা। উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া বাংলা ভাষার নামজাদা সাহিত্যিকদের লেখা প্রাইমারের পাশাপাশি সগৌরবে থাকবে আমাদের সকলের তৈরি করা প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় পাঠ। চেষ্টা করলে প্রাথমিকে বাংলা ভাষা শেখানোর আনন্দদায়ক নতুন উদ্যম তৈরি করা সম্ভব বইকি। পুরুলিয়া থেকে শান্তিনিকেতন— আমাদের বাংলা ভাষা শেখা ও শেখানোর জন্য অনেক কিছু করার আছে।
শেষে বিধিসম্মত সতর্কীকরণ। এক বারও বিদ্যাসাগর কিংবা রবীন্দ্রনাথকে বাতিল করার কথা বলছি না। বরং, প্রাথমিক স্তরে এ ভাবে বাংলার ভিত পোক্ত হলে কিছু দিনের মধ্যে দেখা যাবে, শিশুরা নিজেরাই আনন্দ করে বর্ণপরিচয় আর সহজ পাঠ পড়তে বসছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy