Advertisement
E-Paper

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে

১৯৪০-এ কলকাতাতেই জন্ম। পড়েছেন এখানকার রানি রাসমণি স্কুল আর বিদ্যাসাগর কলেজে। কলেজে পড়ার সময়েই, বাঙালি এক বন্ধু তাঁকে পড়ে শোনায় জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’।

Prayag Shukla

— ফাইল চিত্র।

সন্দীপন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৭:৪৫
Share
Save

সত্যজিৎ রায়ের লেখা ‘বিপিন চৌধুরীর স্মৃতিভ্রম’ গল্পের শুরুটা মনে আছে? “নিউ মার্কেটের কালীচরণের দোকান থেকে প্রতি সোমবার আপিস-ফেরতা বই কিনে বাড়ি ফেরেন বিপিন চৌধুরী। যত রাজ্যের ডিটেকটিভ বই, রহস্যের বই আর ভূতের গল্প।” শুধু বিপিন চৌধুরী নয়, থ্রিলারের টানে সে দোকানে মাঝেমধ্যে ঢুঁ মারতেন সত্যজিৎ নিজেও। সে সব স্মৃতিই উঠে আসছিল ওই দোকানের মালিকের এক ছেলের কথায়। সে ছেলে এখন চুরাশি বছরেও সতেজ— হিন্দি সাহিত্যের বিখ্যাত কবি, অনুবাদক ও শিল্প-সমালোচক প্রয়াগ শুক্ল। সম্প্রতি ‘শঙ্খ ঘোষ স্মারক বক্তৃতা’ দিতে এসেছিলেন কলকাতায়।

১৯৪০-এ কলকাতাতেই জন্ম। পড়েছেন এখানকার রানি রাসমণি স্কুল আর বিদ্যাসাগর কলেজে। কলেজে পড়ার সময়েই, বাঙালি এক বন্ধু তাঁকে পড়ে শোনায় জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’। সে কবিতার ছন্দ আর অন্তর্বিশ্বে মুগ্ধ তিনি সিগনেট থেকে কিনে ফেলেন সত্যজিতের প্রচ্ছদে জীবনানন্দের বনলতা সেন বইটি। আর আগে থেকেই পকেটে থাকত গীতাঞ্জলি-র পকেট-এডিশন। তখন ভাবতেও পারেননি যে, এক দিন তিনিই হিন্দিতে অনুবাদ করবেন এই দু’টি বই। তা ছাড়াও হিন্দিতে অনুবাদ করেছেন রবীন্দ্রনাথের প্রায় দু’শো গান, চিদানন্দ দাশগুপ্তের লেখা জীবনানন্দ-বিষয়ক মোনোগ্রাফ এবং শঙ্খ ঘোষের কবিতা। এমনকি বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধ— যা আজকাল ক’জন বাঙালিও কষ্ট করে পড়ে, বলা মুশকিল— হিন্দিতে অনুবাদ করে পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। আর এতই সাবলীল সে অনুবাদ যে, হিন্দিতে তার দু’-তিনটে সংস্করণও ফুরিয়ে গিয়েছে এর মধ্যে। আবার শিল্প-সমালোচক হওয়ায়, অল্পবয়সিদের মধ্যে শিল্পের বোধ জাগিয়ে তোলার জন্যই, অনুবাদ করেন অশোক মিত্রের পশ্চিম ইওরোপের চিত্রকলা

কিন্তু এক জন সৃষ্টিশীল লেখক হয়ে অনুবাদের জন্য তিনি এতটা সময় ব্যয় করলেন কেন? এই জন্যে যে, তিনি বিশ্বাস করেন, অনুবাদের মাধ্যমেই নিজের ভাষাকে আরও ভাল ভাবে চেনা যায়। কেন? নিজের ভাষার মধ্যে যে-হেতু স্বাভাবিক ভাবেই শ্বাস-প্রশ্বাস নেন তিনি, তাই নিজের লেখা লেখার সময়ে এক বারেই মূল কাঠামোটা চলে আসে তাঁর। হয়তো পরে সামান্য কিছু কাটাকুটি বা পরিবর্তন দরকার হয়। কিন্তু অনুবাদে, প্রতিটি বাক্যের ক্ষেত্রেই আলাদা করে ভাবনাচিন্তা করতে হয়। উদাহরণ হিসাবে বলেন, ‘কানাই ঘরে এল’ বা ‘কানাই ঘরে ঢুকে পড়ল’ বা ‘ঘরেতে কানাই এল’ বা ‘কানাই ঘরে পদার্পণ করল’— এ ভাবে একই কথাকে আট-দশ রকমে বলা যায় আলাদা মেজাজে। কিন্তু কোন ভাবে বললে তা যথাযথ হবে, সেটা বুঝে নিতে হয় অনুবাদে।

আখেরে এতে নিজেরই লাভ। নিজের ভাষার ক্ষমতাকে ভিতর দিক থেকে পরখ করে নেওয়ার একটা সুযোগ করে দেয় অনুবাদ। মাথায় রাখতে হয় যে, অনুবাদে যেন মূল লেখাটির ‘ফ্লেভার’ অক্ষুণ্ণ থাকে, অথচ যখন তা অন্য ভাষায় আসে, তখন সেটা পড়ে যেন অনুবাদ বলে মনে না হয়। সেটা হলে নিজের ভাষা সমৃদ্ধ হবে না।

আসলে, এক জন লেখককে বুঝে নিতে হয় তার পরিপ্রেক্ষিত। বুঝে নিতে হয়, তাঁর ভাষায় তাঁর সময়ে আর কী কী লেখা হচ্ছে, এমনকি তার আগেই বা কী কী কাজ হয়েছে, তাঁর দেশের অন্যান্য ভাষায় কী কী কাজ হচ্ছে, এমনকি অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের সঙ্গেই বা তার সম্পর্ক কেমন। এক জন লেখকের কাছে এই সজীব কৌতূহল এমন এক প্রবণতা, যা গড়ে তুলতে পারে তাঁর ‘মনের সৌন্দর্যময় এক স্বাস্থ্য’। কিন্তু আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে ‘ঐতিহ্যের বিস্তার’ প্রবন্ধে প্রশ্ন তুলছিলেন শঙ্খ ঘোষ— “বাংলা কি এই স্বাস্থ্যের দিকে এগোতে চায় কখনো?” স্পষ্ট ভাবেই বলছিলেন, “শিল্পজগৎ বা চলচ্চিত্রজগৎ বিষয়ে কথাটা হয়তো তত সত্য নয়, কিন্তু কথাটা সত্য আমাদের সাহিত্যজগৎ বিষয়ে।” তাই “বিশ্বপট যতখানি, আমাদের সাহিত্যের সামনে ভারতীয় পট কি ততটা উন্মোচিত? না কি আমরা সংকীর্ণ এক আত্মতৃপ্তির গণ্ডির মধ্যে নিজেদের বেঁধে রাখতে পেরেই খুশি?” হয়তো “একদিন, ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনের যুগে, প্রগতি সাহিত্য-আন্দোলনের যুগে, তৈরি হয়ে উঠছিল একটা সর্বভারতীয় যোগাযোগের সম্ভাবনা, কিন্তু আজ কলকাতা-কেন্দ্রিক লেখকসমাজের সামনে দেশ কথাটার ব্যাপক কোনো ছবি নেই, এমন-কী তার অভাববোধও লুপ্ত।”

যেখানকার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই অভাববোধ তৈরি হয়ে ওঠার কথা বলেন শঙ্খ ঘোষ, আশির দশকের গোড়া থেকে শুরু করে প্রায় শেষ পর্যন্ত, অশোক বাজপেয়ীর নেতৃত্বে তেমনই এক ‘সর্বভারতীয় যোগাযোগ’-এর জায়গা হিসাবে জেগে উঠছিল ভোপালের ভারতভবন। তারই ফসল হিসাবে বাংলায় আসেভাষানগর বা ভাষাবন্ধন বা অনুবাদ পত্রিকা-র মতো বেশ কিছু পত্রিকা, যা সমকালীন ভারতীয় সাহিত্যের মুখোমুখি দাঁড় করাবে আমাদের। কিন্তু ওই লেখার চল্লিশ বছর পরেও কি পাল্টেছে সেই পরিস্থিতি? প্রয়াগ শুক্লর মতো এক খ্যাতনামা হিন্দি কবি যখন তাঁর ওই বিপুল বাংলা অনুবাদ সম্পর্কে, বাংলা সাহিত্যজগৎ সম্পর্কে, অনায়াসে বলে যান কথার পর কথা, তখন তার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে তাই অপরাধী লাগে। মনে হয়, আমরাও কি এ ভাবে অনায়াসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতে বা আড্ডা মারতে পারব হিন্দি মালয়ালম কন্নড় বা মরাঠি সাহিত্য সম্পর্কে? তার জন্য কি আদৌ নিজেদের প্রস্তুত করেছি আমরা? এমনকি কোনও ইচ্ছে কি দেখিয়েছি নিজেদের প্রস্তুত করে তোলার?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Literature Author

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}