—প্রতীকী চিত্র।
প্র: চলতি অর্থবর্ষের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০২৩) আর্থিক বৃদ্ধির যে আনুমানিক সংখ্যা পাওয়া গিয়েছে, তা ৮.৪%। এই হার এতই বেশি যে, আগের কোনও পূর্বাভাসই এর ধারেকাছেও ছিল না। হঠাৎ এই উন্নতির কারণ কী?
অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যন: কোনও একটা ত্রৈমাসিকের হিসাব নিয়ে কথা বলার সমস্যা হল, একটা অনিবার্য প্রতিযুক্তি আসবেই— সেটা হল, তিন মাস অতি অল্প সময়, সে সময়ে বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন সূচকের মান উপর-নীচ হতে পারে, ফলে তার হিসাব নিয়ে বেশি বিশ্লেষণ করা চলে না। কাজেই, এই প্রশ্নের উত্তরে আমি গোটা বছরের আর্থিক পূর্বাভাসের কথা বলব, তার থেকেই এই ত্রৈমাসিকের গল্পটাও ধরা যাবে। আর্থিক বৃদ্ধির হারের যে হিসাব নিয়ে সংবাদমাধ্যমে আলোচনা হয়, সেটা রিয়াল গ্রোথ রেট বা প্রকৃত বৃদ্ধির হার। নমিনাল গ্রোথ বা টাকার অঙ্কে আয় যতখানি বাড়ে, তার দুটো কারণ থাকে— এক, প্রকৃত উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ে; এবং দুই, জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। তাই, টাকার অঙ্কে বৃদ্ধির হার থেকে মূল্যস্ফীতির হার বাদ দিলে যেটা পড়ে থাকে, সেটা হল প্রকৃত বৃদ্ধির হার। মূল্যস্ফীতির হার হিসাবে যেটা বাদ দেওয়া হয়, পরিভাষায় তাকে বলে জিডিপি ডিফ্লেটর। ভারতে ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে অনুমান করা হচ্ছে যে, টাকার অঙ্কে জিডিপি বৃদ্ধির হার হবে ৯.১%, আর প্রকৃত বৃদ্ধির হার হবে ৭.৬%। অর্থাৎ, মূল্যস্ফীতি ধরা হচ্ছে ১.৫%। গ্রোস ভ্যালু অ্যাডেড (জিভিএ) বা মোট মূল্য সংযোজনের হিসাব দেখলে পাওয়া যাবে, সেখানে মূল্যস্ফীতি ১.৩%। সমস্যা এখানেই।
সমস্যা, কারণ এই মুহূর্তে ভারতে মূল্যস্ফীতির হার কোনও মতেই ১.৫% নয়। খুচরো মূল্যস্ফীতির যে কোনও সূচক দেখলেই স্পষ্ট হবে, এই মুহূর্তে দেশে মূল্যস্ফীতির ৩.৫ থেকে ৫.৫ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। তা হলে জিডিপির হিসাবে এই হার এত কম কেন? তার কারণ, ভারতে জিডিপি ডিফ্লেটরের হিসাব করা হয় পাইকারি ও খুচরো মূল্যসূচকের বৃদ্ধির হারের একটি নির্দিষ্ট অনুপাত মেনে। পাইকারি মূল্যসূচকে পেট্রোলিয়ামের গুরুত্ব প্রচুর। আন্তর্জাতিক বাজারে সাম্প্রতিক কালে যে-হেতু তেলের মূল্যবৃদ্ধি কম, ফলে ডিফ্লেটরের মানও কম। তাই এই হিসাব থেকে পাওয়া প্রকৃত জিডিপি-র মান বেশি। কিন্তু, এই ডিফ্লেটরের নিরিখে নির্ধারিত বৃদ্ধির হারকে ভারতের আসল বৃদ্ধির হার মনে করার কোনও কারণ নেই। মূল্যবৃদ্ধির হার গড়ে ৪% ধরে নেওয়া হয়, তা হলে এই অর্থবর্ষে ভারতের প্রকৃত আর্থিক বৃদ্ধির পরিমাণ হবে পাঁচ শতাংশের কাছাকাছি। আমার মত হল, সেটাই ঠিক হিসাব।
প্র: অর্থাৎ, তেলের দামের মূল্যবৃদ্ধি ঘটেনি বলে ভোটের মুখে জিডিপি-র চড়া হারে বৃদ্ধির পরিসংখ্যান পাওয়া গেল?
উ: একেবারেই। উন্নত দেশগুলিতে কিন্তু এ ভাবে ডিফ্লেটর হিসাব করা হয় না। সেখানে প্রোডিউসারস’ প্রাইস ইন্ডেক্স ব্যবহার করা হয়। ভারতে হয় না, ফলে এই ‘সুবিধা’ শাসকরা পাচ্ছেন। এখানে একটা কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন— চলতি অর্থবর্ষে জিডিপি-র যে বৃদ্ধির পূর্বাভাস করা হচ্ছে, তার কার্যত অর্ধেক জিভিএ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। অর্থাৎ, এ বছর দেশে যে হারে মূল্য সংযোজিত হয়েছে বলে হিসাব পাওয়া যাচ্ছে, মোট আয়বৃদ্ধির হার তার চেয়ে অনেকটা বেশি। জিডিপি-র হিসাবে যে গোলমাল রয়েছে, এটা তার প্রায় অকাট্য প্রমাণ।
তবে, এখানে এই কথাটাও যোগ করতে হবে যে, জিডিপি ডিফ্লেটর গণনার এই পদ্ধতি কিন্তু বর্তমান সরকার স্থির করেনি। ২০১১-১২ সালে এই হিসাবটা নির্ধারিত হয়েছিল। যে বছর আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোলিয়ামের দাম কম বাড়ে, সে বছর ডিফ্লেটর কম হওয়ার দরুন সরকারের পক্ষে জিডিপি-র প্রকৃত বৃদ্ধির হারকে বাস্তবের চেয়ে চড়া দেখানো সম্ভব হয়। কিন্তু, এর একটা উল্টো দিকও আছে— যখন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম চড়া থাকে, তখন ডিফ্লেটরের মান বাড়ে, ফলে প্রকৃত জিডিপি বৃদ্ধির হারের যে অঙ্কটি পাওয়া যায়, তা আসল বৃদ্ধির হারের চেয়ে কম হয়। সে ক্ষেত্রে অবশ্য সরকার এই ঘটনাটিকে ফলাও করে প্রচার করে, যাতে কম বৃদ্ধির হারকে সরকারের দোষ বলে মনে না হয়।
ঘটনা হল, ডিফ্লেটরের এই সমস্যাটি এমন কিছু নয়, যা কোনও মতেই দূর করা যায় না। প্রোডিউসারস’ প্রাইস ধরে হিসাব করলেই আর এই অসুবিধা থাকে না। ভারতে অনেক দিন ধরেই এ বিষয়ে কথা হচ্ছে। কিন্তু, কাজ কিছু এগোয়নি।
প্র: ভারতে আর্থিক বৃদ্ধির হারের পূর্বাভাস করার জন্য অসংগঠিত ক্ষেত্রের হিসাব কষা হয় না, সংগঠিত ক্ষেত্রের একটি অনুপাত ধরে তা অনুমান করা হয়। যে দেশে অসংগঠিত ক্ষেত্রই অর্থনীতিতে প্রধানতম, সেখানে কি এই পূর্বাভাসের আদৌ কোনও অর্থ হয়?
উ: অসংগঠিত ক্ষেত্রের আয়বৃদ্ধি অনুমান করা হয় ইন্ডেক্স অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাকশন (আইআইপি) থেকে, যেটা সম্পূর্ণতই সংগঠিত শিল্পক্ষেত্রের হিসাব। অর্থব্যবস্থা যদি স্বাভাবিক ছন্দে চলে, তা হলে এই অনুমান থেকে মোটামুটি ঠিক হিসাবই পাওয়া যায়। সমস্যা হয়, যখন অর্থব্যবস্থায় কোনও ধাক্কা লাগে। গত কয়েক বছরে নোট বাতিল, জিএসটি প্রবর্তন এবং কোভিড-জনিত লকডাউনের ধাক্কা অসংগঠিত ক্ষেত্রের গায়ে অনেক বেশি লেগেছে। কেন এই ধাক্কাগুলিতে সংগঠিত ক্ষেত্রের চেয়ে অসংগঠিত ক্ষেত্রে বেশি প্রভাব পড়েছে, তার একাধিক কারণ রয়েছে— যেমন, অসংগঠিত ক্ষেত্রের নগদ-নির্ভরতা, সে ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষা জালের অভাব ইত্যাদি। মোট কথা, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সংগঠিত ক্ষেত্র আর অসংগঠিত ক্ষেত্রের মধ্যে যে অনুপাতটি থাকে, এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে তা বিঘ্নিত হয়েছে। ফলে, আইআইপি থেকে সেই ক্ষেত্রের অবস্থা অনুমান করা চলে না। অতএব, জিডিপি-র চড়া পূর্বাভাস নিয়ে কতখানি উল্লসিত হব, সেই প্রশ্ন নিজেদের করতেই হবে।
সাক্ষাৎকার: অমিতাভ গুপ্ত
ভূতপূর্ব মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, ভারত সরকার
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy