—প্রতীকী ছবি।
রান্না বসেছে উনুনে। স্ত্রী আনাজ কাটছেন, সারা দিন অটো চালিয়ে ফিরে আসা স্বামী তাঁকে টুকটাক সাহায্য করছেন। পাশেই বিছানায় ছেলে বইপত্র ছড়িয়ে বসে, চোখ ফোনের দিকে। হতে পারত যে কোনও ছাপোষা গেরস্ত বাড়ির ছবি। কিন্তু তফাত একটু আছে। এই সংসারের অবস্থান মুক্ত জেলের কোয়ার্টারে। রাজস্থানের জয়পুর থেকে তেরো কিলোমিটার দূরে সাংনার ‘খুল্লা ক্যাম্প’-এ। পোশাকি নাম শ্রীসম্পূর্ণানন্দ খুলা বন্দি শিবির। চার হেক্টর জমির উপরে একটা গ্রামের মতো শিবির। চাষের জমি, ঘর-বাড়ি, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র, শিশুদের জন্য স্কুল, সবই আছে। মাঝে-মাঝে বন্দিদের আত্মীয়-বন্ধুরাও এসে থাকেন।
কোচবিহার থেকে রাজস্থানের হোটেলে কাজ করতে এসেছিলেন অজয় (সব নাম পরিবর্তিত)। ২০০৫ সালে খুনের দায়ে গ্রেফতার হওয়ার পর পরিবারকে খবরও দিতে পারেননি। স্বামীকে খুঁজতে নাবালক দুই ছেলে নিয়ে মিতা আসেন জয়পুরে। সেই প্রথম বাড়ির বাইরে বেরোলেন তিনি। স্বামীর কাজের জায়গায় কোনও সহযোগিতা পাননি। জেলের ঠিকানা খুঁজে-খুঁজে অজয়ের সন্ধান পান। তার পর জয়পুরেই গৃহপরিচারিকার কাজ জোগাড় করেন। শুরু হয় জীবনসংগ্রাম— লোকের বাড়ি বাড়ি রান্না, ঘর সামলানোর কাজ করে ঘর ভাড়া, ছেলেদের পড়ার খরচ, আর স্বামীর মামলা চালানো। সাত বছরের জেলবন্দি থাকার পর অজয় স্থান পেয়েছেন মুক্ত জেলে। এখন নিজের উপার্জন থেকে সংসার খরচ চালাতে পারছেন। দীর্ঘ, কঠিন লড়াইয়ের পরে মিতাও কিছুটা স্বস্তিতে। জেলের মেয়াদ শেষ হয়নি, কিন্তু বন্দিত্বের অমানবিক দশা, যা ব্যক্তির সঙ্গে পরিবারকেও বিপর্যস্ত করে, তা থেকে মুক্তি দিয়েছে ‘ওপেন জেল’।
আক্ষেপ, মুক্ত জেলের কার্যকারিতা স্পষ্ট হলেও, এই মডেল এখনও ব্যতিক্রম হয়েই রয়ে গিয়েছে। ১৯৫০ সালে প্রথম মুক্ত জেল তৈরি হয় উত্তরপ্রদেশের সিতারগঞ্জে, মুখ্যমন্ত্রী সম্পূর্ণানন্দের উদ্যোগে। এই মডেল বন্দিদের কৃষিকাজ, কুটিরশিল্প প্রভৃতিতে যোগ দিয়ে জীবিকা অর্জন করতে সহযোগিতা করে। চাষের জমিও দেয়। পশ্চিমবঙ্গে প্রথম মুক্ত জেল তৈরি হয় মুর্শিদাবাদের লালগোলায়, ১৯৮৭ সালে। গত বছর দশেকে আরও তিনটি ‘ওপেন জেল’ খুলেছে দুর্গাপুর, মেদিনীপুর ও রায়গঞ্জে। সেগুলিতে দৈনিক লক-আপের কোনও ব্যবস্থা নেই, সাজাপ্রাপ্তরা সারা দিন বাইরে থাকতে পারেন, কেবল রাতে একটি নির্দিষ্ট সময়ে ফিরতে হয়। জেলের বিধি-নিয়মের চাইতে, বন্দির শৃঙ্খলাবোধের উপরে নির্ভর করে চলে এই প্রাচীরহীন জেলগুলি। বন্দি-জীবন এবং মুক্ত জীবনের মধ্যে এক অন্তর্বর্তী ধাপ হিসাবে মুক্ত জেলকে দেখে প্রশাসন। যাঁরা দীর্ঘ মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত, তাঁদের মেয়াদ শেষ হওয়ার কয়েক বছর আগে মুক্ত জেলে রাখা হয়। যাতে তাঁরা পরিবারের সঙ্গে ফের সংযুক্ত হতে পারেন, কাজ খুঁজে নেন, সংসার চালানোর দায়িত্বে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন।
কতটা সফল মুক্ত জেল? দীর্ঘ দিন ধরে মুক্ত জেলের বন্দিদের নিয়ে কাজ করছেন স্মিতা চক্রবর্তী। বন্দিদের মুক্ত জেলে পাঠানোয় সহায়তার জন্য একটি সংস্থাও তৈরি করেছেন। স্মিতা জানান, সাজার মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পরেও মুক্ত জেল ছেড়ে বন্দিরা যেতে চান না। আর্জি করেন, ‘আরও কিছু দিন থাকতে দিন।’ এঁদের ‘উচ্ছেদ’ করা যাবে কী করে, তাই নিয়ে স্মিতার পরামর্শ চেয়েছেন রাজস্থানের জেল কর্তৃপক্ষ!
স্মিতা নানা রাজ্যের জেল পরিদর্শন করেছেন। তিনি জানান, অধিকাংশ জেলের পরিস্থিতি অত্যন্ত অমানবিক— কোনও কোনও ক্ষেত্রে ঘরে এত বেশি লোককে ঠাসা হয় যে, বন্দিদের পালা করে বসতে হয়। খাঁচাবন্দি পশুর মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তাঁদের। আক্ষেপ এই যে, অনেক নাগরিক মনে করেন, এমন অমানুষিক কষ্টই হল অপরাধীর ঠিক শাস্তি। যদিও গবেষণায় দেখা যায়, অধিকাংশ জেলবন্দিই নিয়মিত অপরাধ চক্রে যুক্ত নন। হঠাৎ রাগের বশে, বিপজ্জনক কোনও পরিস্থিতিতে, তাঁরা অন্যকে আক্রমণ করেছেন। উকিলের খরচ জোগাতে পারেননি বলে সাজা এড়াতে পারেননি, এমন মানুষও কম নেই। যথেষ্ট প্রিজ়ন ভ্যান, রক্ষী নেই বলে বহু বন্দিকে ঠিক দিনে আদালতে উপস্থিত করা যায় না। নাচার বন্দিত্ব, অমানুষিক পরিবেশ এঁদের আত্মহত্যাপ্রবণ, কিংবা হিংস্র করে তোলে। পশ্চিমবঙ্গ-সহ বহু রাজ্যের জেল থেকে নিয়মিত আসে বন্দিদের অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবর। স্মিতা দেখিয়েছেন, প্রথাগত জেল চালানোর খরচও বেশি— মুক্ত জেল চালাতে খরচ অন্তত আশি শতাংশ কম। মানবাধিকার কর্মীরা তাই আরও বেশি মুক্ত, আধামুক্ত জেল তৈরির পক্ষে সওয়াল করছেন।
সাজাপ্রাপ্ত বন্দির পরিবারের প্রতি যে অন্যায় হয়, অপরাধের বিচারে তা-ও বাদ পড়ে যায়। অজয়ের স্ত্রী মিতার মতো, অগণিত নিরপরাধ মানুষের জীবন একটি ঘটনার আঘাতে ওলটপালট হয়ে যায়। অপরাধের খবর আসামাত্র সমাজ গোটা পরিবারকেই এড়িয়ে চলে। বহু ক্ষেত্রে বন্দিদের সাজা ঘোষণা হয়ে গেলে পরিজনরা আর যোগাযোগ রাখে না। বছরের পর বছর ভিজিটর আসে না । বন্দিদের পরিবারে ফেরানোর নতুন সুযোগ করে দেয় মুক্ত জেলের মডেল।
অজয় ঠিক করেছেন, সাজা সম্পূর্ণ হয়ে ছাড়া পেলে জয়পুরেই অটো চালাবেন। জয়পুরের সব অলিগলি তাঁর চেনা। ট্র্যাফিক পুলিশদের সঙ্গে বেজায় খাতির। তাঁর অটোর নিয়মিত যাত্রীরা অনেকে জানেন যে অজয় খুল্লা ক্যাম্পে থাকেন। তাতে কী? তিনি তো নিজের রোজগারে মানুষের মতোই বাঁচছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy