২০১৯-এর আগের বেশ কয়েক বছরে ভারতে আয়বৃদ্ধির হার ছিল দুনিয়ায় অন্যতম সেরা। প্রতীকী ছবি।
সামগ্রিক জাতীয় আয়ের হিসাবে ভারত পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম দেশ, এই কথাটা বললে ঠিক কী বুঝব? অর্থশাস্ত্রের তত্ত্বে বিভিন্ন দেশের আয়ের মধ্যে তুলনা করার মান্য পদ্ধতি হল, পারচেসিং পাওয়ার প্যারিটি বা ক্রয়ক্ষমতার সাম্য বিচার করা। ধরা যাক, দুনিয়ায় একটিমাত্র পণ্য কিনতে পাওয়া যায়, তা হল চাল। একটি দেশে যদি ১০০ টাকায় এক কেজি চাল কেনা যায়, আর অন্য দেশে দু’কেজি— তা হলে ডলারের অঙ্কে যদি দেশ দু’টির আয় সমান হয়, তবে ক্রয়ক্ষমতার সাম্য অনুসারে দ্বিতীয় দেশটির আয় প্রথমটির দ্বিগুণ, কারণ একই পরিমাণ টাকায় দ্বিতীয় দেশে দ্বিগুণ পণ্য কেনা সম্ভব। গরিব দেশগুলোতে সাধারণত ধনী দেশের তুলনায় সস্তায় খাবারদাবার-বাসস্থান পাওয়া যায়। তাই ভারতের মতো দেশের জিডিপি সরাসরি ডলারের অঙ্কের চেয়ে পারচেসিং পাওয়ার প্যারিটির হিসাবে বেশি হয়।
এই আখ্যানে অবশ্য ‘ইতি গজ’ অংশটি একেবারে বাদ পড়ে যায়। ক্রয়ক্ষমতার সাম্য ভিত্তিতেই জাতীয় আয় হিসাব করলেও, মাথাপিছু আয়ের নিরিখে ভারতের স্থান দুনিয়ায় ১২৫-এরও নীচে। তবে এটাও ঠিক যে, সামগ্রিক ভাবে ভারতের জাতীয় আয়ের আপেক্ষিক অবস্থান কখনও এতটা উপরে ছিল না, অন্তত গত দু’তিন দশকে। ক্রয়ক্ষমতার সাম্যের ভিত্তিতে হিসাব ছেড়ে শুধু সাদা চোখের তথ্য অনুসরণ করি, তাতে দেখব যে, ভারতের মাথাপিছু আয় চিনের ১৮%। কিন্তু ক্রয়ক্ষমতার সাম্যের বিচারে সেই অনুপাত প্রায় ৪০ শতাংশের কাছাকাছি।
ভারতে মাথাপিছু আয়ের স্বল্পতা গভীর উদ্বেগের বিষয়। অথচ, ২০১৯-এর আগের বেশ কয়েক বছরে ভারতে আয়বৃদ্ধির হার ছিল দুনিয়ায় অন্যতম সেরা। তা হলে বাড়তি রোজগার যাচ্ছে কোথায়? সাম্প্রতিক জাতীয় আয়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বের দরবারে ভারতের আপেক্ষিক স্থান যত ভাল, ততখানি হয়তো আগে হয়নি। যদিও অনেক দিন থেকেই যে কয়েকটি দেশের জাতীয় আয়ের সমষ্টি বিশ্বের সামগ্রিক আয়ে উন্নত দেশগুলোর অংশকে ছাপিয়ে যাচ্ছিল, তার মধ্যে ভারতও অন্যতম। এই প্রক্রিয়াকে ‘গ্রেট কনভার্জেন্স’ নাম দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ রিচার্ড বল্ডউইন। প্রক্রিয়াটির সূচনা অনেক দিন আগে থেকেই, ২০১৪ সালে নয়। আমাদের দেশের সরকার আশা করতেই পারে যে, দেশের অর্থনীতি এক দশকের মধ্যে আরও বিশাল হয়ে উঠবে। কিন্তু গড় নাগরিকের তাতে কতটা উপকার হবে, সে কথা তাদের ভাবতে হবে।
একটি তথ্য এ বিষয়ে প্রাসঙ্গিক। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অ্যাঙ্গাস ডিটন তাঁর সাম্প্রতিক গবেষণাপত্রে দেখিয়েছেন যে, গরিব দেশগুলো কোভিড-পরবর্তী সময়ে উন্নত দেশগুলোর চেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুরে দাঁড়িয়েছে বা দাঁড়াচ্ছে। ভারত অনেক দেশের চেয়ে সামগ্রিক আয়ের ক্ষেত্রে এবং মূল্যবৃদ্ধির হার সম্পর্কিত ব্যবস্থাপনায় ভাল ফল করতেই পারে। কিন্তু আয়বৃদ্ধির হারকে বেশ কিছু দিন ধরে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন আরও অনেক বিনিয়োগ। যে কথাটি বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন জায়গায় বলা হয়, এ দেশে ধনীতম ব্যবসায়ীরা মোটেই বিনিয়োগের হার বাড়াতে চান না। সরকারি বিনিয়োগের হার জাতীয় আয়ের তুলনায় ওই ৭ শতাংশের ধারে-কাছে দু’দশক ধরে আটকে রয়েছে।
বিপুল আর্থিক বৈষম্য কমাতে সম্পদ কর একটি অত্যাবশ্যক পদক্ষেপ। বৃহৎ ব্যবসায়ীদের উৎপাদনে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য সম্পদ কর ক্রেডিট দেওয়া অর্থাৎ বিনিয়োগের হার না বাড়ালে বাড়তি সম্পদের উপর প্রভূত কর বসানোর নীতি সাহসী সরকারের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।
ধনীদের বাড়তি রোজগারের খানিকটা সুষম বণ্টন না হলে সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয়। সহজ ব্যাখ্যা হল, বড়লোক আরও অনেক বড়লোক হলেও আর কত বেশি খাবে? নিশ্চয় তিনি বিনিয়োগ করে আরও খরচ করতে পারেন, যা বাজারে চাহিদা বাড়াবে। কিন্তু তিনি যদি বিনিয়োগ না করেন, শুধুই মুনাফার মুখ দেখতে চান আর সাম্রাজ্য বাড়িয়ে চলেন, তা হলে দেশের যে কতটা উপকার হবে কে জানে। সরকার একটি সোজা হিসাব এখনই করে ফেলতে পারে— সরকার দেশের প্রথম ১০০টি সবচেয়ে সম্পদশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করল। তাদের সম্পদ বৃদ্ধির পরিমাণ যদি ‘ক’ হয় আর তারা যদি ওই একই সময়ে ‘খ’ পরিমাণ টাকা বা সম্পদ বিনিয়োগ করে থাকে কৃষি, শিল্প বা পরিষেবা ক্ষেত্রে, তা হলে খ আর ক-এর অনুপাতটি হিসাব করতে হবে। যদি তা ১-এর চেয়ে বেশ কম হয়, তা হলে বোঝা যাবে যে, তাদের সম্পদ আহরণে দেশের তেমন উপকার হচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে তাদের ধনসম্পত্তির উপর কর বসিয়ে সে টাকাটা সরকার নিজেই বিনিয়োগ করতে পারে। যাদের খ-এর পরিমাণ ক-এর তুলনায় অন্যদের চেয়ে বেশ বেশি, তারা হয়তো সম্পদ কর দেওয়া থেকে অনেকটা ছাড় পেতে পারে। সরকার কি আদৌ এই হিসাবটি করতে চাইবে? আর সেই হিসাবমতো কড়া পদক্ষেপ করবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy