Advertisement
০৩ জুলাই ২০২৪
Teesta River

তিস্তা-বাঁধের বৃত্তান্ত

সিকিমের কানসি হিমবাহ থেকে জন্ম নিয়ে কোচবিহারের মেখলিগঞ্জ হয়ে বাংলাদেশে তিস্তার প্রবেশ। চুংথাং থেকে সিঙ্ঘিক, টানা কুড়ি কিলোমিটার হিমালয়ের এই অংশটি অত্যন্ত খাড়া।

Teesta River

—ফাইল চিত্র।

সুপ্রতিম কর্মকার
শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০২৪ ০৯:১২
Share: Save:

তিস্তার জলস্ফীতির জন্য একের পর এক বিপর্যয়ের মুখে পড়ছেন সিকিম ও উত্তরবঙ্গের মানুষেরা। কেন তিস্তা বার বার শহরের রাস্তা দিয়ে বয়ে চলেছে, তা বোঝার জন্য নদীর দিকে একটু তাকানো প্রয়োজন। করোনেশন ব্রিজের উপর দাঁড়ালে দেখা যায়, পাহাড়ের ঢাল দিয়ে নেমে আসার সময়ে তিস্তার শরীর সঙ্কীর্ণ। নীচের দিকে তা জাপানি হাতপাখার মতো প্রসারিত। নদীবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে ‘তিস্তা ফ্যান’। পাহাড়ের ঢাল ঝপ করে কমে যায়, আর তিস্তা নেমে পড়ে সমতলে। কাজেই নদী তার গতিশীল ভারসাম্য বজায় রাখতেই নিজের জলের শরীরকে প্রশস্ত করে দেয়। তিস্তার উপরে একের পর এক বাঁধ তৈরি করার সময় নদীর এই চরিত্রকে পরিকল্পনাকারীদের মাথায় রাখা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ‘উন্নয়ন’ শব্দের সামনে নদীর চরিত্র, মাটির চরিত্র, স্থানীয় মানুষের সঙ্গে নদীর সম্পর্ক, এ সব হয়ে যায় তুচ্ছ।

সিকিমের কানসি হিমবাহ থেকে জন্ম নিয়ে কোচবিহারের মেখলিগঞ্জ হয়ে বাংলাদেশে তিস্তার প্রবেশ। চুংথাং থেকে সিঙ্ঘিক, টানা কুড়ি কিলোমিটার হিমালয়ের এই অংশটি অত্যন্ত খাড়া। এই এলাকাতে নদীর ঢাল প্রতি ত্রিশ মিটারে এক মিটার। সিঙ্ঘিকের পর থেকে তিস্তার ঢাল ক্রমশ কমে দাঁড়ায় প্রতি ১২০ মিটারে এক মিটার করে। জলপাইগুড়ি শহরের কাছে সেই ঢাল আরও কমে দাঁড়ায় এক কিলোমিটারে ০.৭ মিটার। পরিবেশকর্মীদের দাবি, নদীর ঢালের এই বৈচিত্রকে কাজে লাগিয়ে জলবিদ্যুৎ পেতে রাষ্ট্রায়ত্ত জলবিদ্যুৎ সংস্থা ‘এনএইচপিসি’-র অধীনে বন ও পরিবেশ দফতরের পরিবেশ সুরক্ষার গাইডলাইন না মেনেই তিস্তার উপরে সিকিমে চারটি বাঁধ তৈরি হয়।

পাশাপাশি, সেচ ও পানীয় জল সরবরাহের জন্যেও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেচ ও জলপথ দফতরের তত্ত্বাবধানে থাকা ‘তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প’-এর অধীনে ১৯৭৬ সাল থেকে চারটি বাঁধ, আর ৫৭.৯৭ কিলোমিটার ‘লিঙ্কড ক্যানাল’ বা সংযোগকারী খাল তৈরি হয়। একই সঙ্গে দুটো প্রকল্পের অধীনে একাধিক বাঁধ নির্মাণে নদীর চলার স্বাভাবিক ছন্দ সম্পূর্ণ বিঘ্নিত হয়েছে। পাল্টে গিয়েছে তিস্তার জল ও পলি প্রবাহের স্বাভাবিক চরিত্র।

‘সিকিম উর্জা’ বা ‘স্টেজ ৩’ নামের বাঁধটি চুংথাং-এ তৈরির সময়ে পরিবেশের উপর প্রভাবের সমীক্ষা পর্যন্ত হয়নি। কাজেই হিমবাহ-গলা জলের চাপের বিস্ফোরণে মাত্র দশ মিনিটের ভিতরে স্টেজ ৩ বাঁধ ভাঙার সময়ে কাদা-পলির ঘোলা জল নিয়ে সমতলে ধাক্কা দিয়েছিল তিস্তা। এই ঘটনা গত বছরের। জলে কাদা-পলি মেশায় আজ পর্যন্ত তিস্তাতে মাছ নেই।

এ বছর তারই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। উত্তর সিকিম অত্যন্ত ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল, এই অঞ্চলে বড় বাঁধের পরিণতি যে ভয়ঙ্কর হতে পারে, সে কথা খড়্গপুর আইআইটি-র অধ্যাপক শঙ্কর কুমার নাথ প্রণীত, ভারত সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দফতরের একটি প্রামাণ্য নথিতে (সিসমিক হ্যাজ়ার্ডস অ্যান্ড মাইক্রোজ়োনাল অ্যাটলাস অব দ্য সিকিম হিমালয়) উল্লিখিত রয়েছে। সতর্কতার বার্তা উপেক্ষিত হয়েছে।

তিস্তা প্রকল্পের প্রায় প্রতিটি বাঁধের ক্ষেত্রেই সুরক্ষার আন্তর্জাতিক বিধিকে এড়িয়ে নির্মাণ হয়েছে, যা তৈরি করে ‘ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অন লার্জ ড্যামস’। হিমবাহ-সৃষ্ট হ্রদের জল বাড়ার ফলে স্টেজ ৩ বাঁধের মতো তিস্তার উপর বাকি যে কোনও চারটি বাঁধই ভাঙতে পারে। সেই সঙ্কটের সামনে সিকিম ও উত্তরবঙ্গের মানুষেরা আজ দাঁড়িয়ে। উষ্ণায়নের ফলে হিমালয়ে বৃষ্টির চরিত্র পাল্টেছে। অল্প সময়ে দীর্ঘকালীন বৃষ্টিপাতে নদীগুলো বার বার ফুলে-ফেঁপে উঠছে। তিস্তা যত সমতলের দিকে নেমেছে, তার অববাহিকার আকার তত সঙ্কীর্ণ হয়েছে। তার উপর অবৈধ নির্মাণে ছোট নদী ও ঝোরাগুলো হারিয়ে গিয়েছে। উপরের অববাহিকায় বৃষ্টি বেশি হলে নদীর জল বেরোনোর পথ নেই। তিস্তার উপরে তৈরি হওয়া বড় বাঁধগুলোর সঙ্গে নিকাশিব্যবস্থা তৈরি হয়নি, কারণ তা ব্যয়সাপেক্ষ। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে খরচ এড়াতে বাঁধের সঙ্গে নিকাশির নির্মাণ প্রায়ই উপেক্ষিত হয়। কাজেই বৃষ্টির অতিরিক্ত জল বেরোনোর পথ পায় না। নদীকে বাধ্য হয়ে বইতে হয় রাস্তার উপর দিয়ে, বাড়ি-ঘর ভেঙে।

এই বছর বৃষ্টি বেশি হলে সমস্যা হতে পারে তিস্তা অববাহিকাতে, সেই ইঙ্গিত ইসরোর একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম দিয়েছিল। সিকিম সরকার তড়িঘড়ি বৈঠক করেছিল জেলার উচ্চপদস্থ কর্তাদের নিয়ে। সিকিম সরকার অর্থ সহায়তা চেয়েছিল কেন্দ্রের অর্থ মন্ত্রকের কাছ থেকে, বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য। টাকা মেলেনি, সিকিমের সংবাদপত্রে বেরিয়েছে। পরিবেশকর্মীরা দাবি করছেন, এর কারণ কেবল প্রশাসনিক টালবাহানা না-ও হতে পারে। দেশের মধ্যে বিপর্যয় এড়ানোর ব্যবস্থা না করা, এবং দুর্যোগ মোকাবিলার তহবিলের অর্থ নিয়ে দুর্নীতি এক পরিচিত কুচক্র। বিভিন্ন সময়ে ক্যাগ রিপোর্টে সে কথা প্রকাশিত।

নেহরু চেয়েছিলেন, বড় বাঁধগুলো নতুন ভারতের মন্দির হয়ে উঠুক। জীবদ্দশাতেই তিনি তাঁর ভুল বুঝেছিলেন। বড় বাঁধের বিপদ নিয়ে বহু বিতর্ক হয়েছে, কিন্তু নির্মাণ থামেনি। বড় বাঁধের জন্য জাতীয় নীতি তৈরি হয়নি আজ পর্যন্ত। নদীকে অবিরল ও নির্মল ভাবে বইতে দেওয়া বড় প্রয়োজন। কিন্তু কী করে তা সম্ভব হবে, জানা নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Teesta River North Bengal West Bengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE