E-Paper

ছদ্মে পদ্মে একাকার

সন্দেশখালি-কেলেঙ্কারির ধাক্কায় রাজ্য-রাজনীতি এখনও কম্পমান। পরতে পরতে যে ভাবে তার ভাঁজ খুলছে, সেটা শাসক তৃণমূলের বিড়ম্বনা বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট।

An image of Abhijit Ganguly

দ্রুতগামী: সংবাদমাধ্যমের সামনে নিজের সিদ্ধান্ত জানাচ্ছেন প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, ৫ মার্চ। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য।

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০২৪ ০৭:৩১
Share
Save

এখনই ত্র্যহস্পর্শ না বললেও তৃণমূলের ভাগ্যচক্রে ত্রিফলা-যোগ তো বলাই যায়! ভোটের বাজারে হাতেগরম হয়ে উঠছিল একা শেখ শাহজাহান। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রথম সফরেই সেটা বেশ পরিষ্কার হয়ে যায়। এ বার যুক্ত হল আরও দুই ফলা— অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় ও তাপস রায়।

এর কোনটি ভোঁতা কোনটি ধারালো, কোনটা ছদ্ম, কোনটাই বা বিকশিত পদ্ম, বলতে পারব না। কারণ কোথাকার জল কত দূর গড়াবে, সে সব এখনই বলার সময় আসেনি। তবে এগুলি যে এ বারের ভোট-রাজনীতির বিশেষ উপাদান, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

সন্দেশখালি-কেলেঙ্কারির ধাক্কায় রাজ্য-রাজনীতি এখনও কম্পমান। পরতে পরতে যে ভাবে তার ভাঁজ খুলছে, সেটা শাসক তৃণমূলের বিড়ম্বনা বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট। সবাই জানি, প্রায় দু’মাস ফেরার হয়ে থাকা শাহজাহানকে পুলিশ তার এলাকা থেকেই কাগজে-কলমে গ্রেফতার করেছে ২৯ ফেব্রুয়ারি ভোরে। ‘কাগজে-কলমে’ কথাটি আক্ষরিক অর্থেই বলা। কারণ, অধরা শাহজাহান যে অবিলম্বে ‘ধরা’ পড়তে চলেছে, ২৮ ফেব্রুয়ারিই সংবাদ জগতে সেই তথ্য ছড়িয়ে পড়েছিল। পর দিন গ্রেফতারের একটি দুর্বল চিত্রনাট্য খাড়া করে পুলিশ বরং শাহজাহানের সঙ্গে তাদের ‘যোগাযোগ’ থাকার ধারণাই পুষ্ট করে দিয়েছে। গ্রেফতারের পরে দুপুরে ‘বন্দি’ শাহজাহানের বসিরহাট আদালতে সুবিন্যস্ত, ঝকঝকে, দাপুটে উপস্থিতি, আর পিছন পিছন তার অনুগত খানসামার মতো কতিপয় পুলিশ অফিসারকে দেখা গেল। এমনকি তার বিরুদ্ধে হাই কোর্টের দেওয়া সিবিআই তদন্তের আদেশ আটকাতে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত দৌড়ল রাজ্য সরকার।

কেউ বলতেই পারেন, অবাক হওয়ার কী আছে? আমরা তো আগেই শুনে ফেলেছিলাম, “কী করেছে শাহজাহান!” কিন্তু ভোট বড় ‘বালাই’। সন্দেশখালি ঘিরে যা যা ঘটছে, তার সামাজিক অভিঘাত নস্যাৎ করা খুব সহজ হবে কি? মনে হয় না।

তবে বিচারপতির কোট খুলে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বিজেপি-তে যোগদান আপাতত কিছু দিন বাজার গরম রাখলেও দিনের শেষে তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষের রক্তচাপ এতে কতটা বাড়বে, তা নিয়ে কিছুটা সংশয়ের পরিসর রয়েছে। রাজনীতি বড় ইনিংসের খেলা। ওয়ান-ডে বা টি-টোয়েন্টি নয়। তাই তাৎক্ষণিক বাহবা কুড়োনো, ভোটে হারজিত, কোনও কিছুই সেখানে সর্বদা শেষ কথা হয় না।

বিচারপতির আসন থেকেই অবশ্য ‘সমাজের মুখ’ এবং ‘ব্যতিক্রমী বিচারপতি’ হয়ে ওঠার প্রবণতা অভিজিতের মধ্যে তৈরি হয়েছিল। সেটা বেশ কিছু দিন যাবৎ। এখন বলতে দ্বিধা নেই, নিজেকে প্রচারের আলোয় রাখার ব্যাপারেও তাঁর কোনও রাখঢাক বা কার্পণ্য ছিল না। বরং সেই কুশলতাও তিনি হাই কোর্টের মহাসনে থেকেই আয়ত্ত করেছিলেন। একাংশের দৃষ্টিতে তাঁর বিভিন্ন ‘আক্রোশী’ মন্তব্য এবং দম্ভের প্রকাশ এক জন বিচারপতির পদের সঙ্গে বহু ক্ষেত্রে মানানসই বলে মনে হয়নি। পর্যবেক্ষণগুলি আজ বোধ হয় কিছুটা প্রাসঙ্গিক।

অনেকের জানা আছে, রাজ্য সিভিল সার্ভিসে প্রথম শ্রেণির অফিসারের চাকরি ছেড়ে আইনের পেশায় যোগ দিয়েছিলেন অভিজিৎ। আইনজীবী ও সিপিএম নেতা বিকাশ ভট্টাচার্যের কাছে থেকে আইনচর্চার কথা নিজেই বলেছেন তিনি। ২০১৮-র মে মাসে অভিজিৎ কলকাতা হাই কোর্টে
অতিরিক্ত বিচারপতি নিযুক্ত হন। ২০২০-এর জুলাই থেকে তিনি স্থায়ী বিচারপতি। তাঁর অবসরের সময় এগিয়ে এসেছিল।

বিচারপতি হিসাবে অভিজিতের নামডাকের অন্যতম কারণ ছিল নিয়োগ-দুর্নীতির মামলা। তৃণমূলের সরকার ও দল শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতির পাঁকে যত জড়িয়েছে, সেই সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের জন্য অভিজিতের এজলাস ততই বঞ্চিত, প্রত্যাশী ও প্রতিবাদীদের অন্যতম আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে। বিচারপতি হিসাবে এটি তাঁর কৃতিত্ব। এইখান থেকেই রাজ্যের শাসককুলের সঙ্গে তাঁর সংঘাতেরও সূচনা।

আগেই বলেছি, তিনি ঘোরতর প্রচারমুখী। তাই আদালতে বসে কখন কার বিরুদ্ধে কী ধরনের মন্তব্য করলে তা খবরের শিরোনাম এবং রাজনৈতিক বিতর্কের বিষয় হয়ে জিইয়ে থাকতে পারে, সেই বিচারও তাঁর ছিল। এই ভাবেই বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় হয়ে উঠেছিলেন বিরোধীদের
‘কাছের মানুষ’।

এ কথা ঠিক, আমাদের দেশে বিচারপতিদের প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার এবং পদ পাওয়ার বহু উদাহরণ রয়েছে। অভিজিৎ রাজনীতিতে যোগ দিয়ে তাই কোনও গর্হিত অপরাধ করেছেন বলে মনে করার বিন্দুমাত্র কারণ নেই। সর্বোপরি এই আমলেই দেশের এক প্রধান বিচারপতি অবসরের মাস তিনেকের মধ্যেই যে ভাবে শাসকের টিকিটে জিতে রাজ্যসভায় বসে পড়েন, তার পরে তো আর কথাই চলে না।

তবে অভিজিতের বেলায় সময় বিচারটা আরও দৃষ্টিকটু মনে হয়। কারণ তিনি স্বেচ্ছাবসর নেওয়ার পরে দলীয় রাজনীতিতে নাম লেখাতে এক দিনও সময় নেননি। যাকে বলে ‘কুলিং পিরিয়ড’, সেটা দূর স্থান। বিচারপতির চাকরিতে থাকাকালীনই যে তিনি দলীয় রাজনীতিতে আসার রাস্তা বাঁধিয়ে ফেলেছিলেন, তা-ও স্পষ্ট।

হতে পারে, এ বার তিনি ভোটে জিতে সাংসদ হবেন। বিজেপি সরকার গড়লে কেন্দ্রে মন্ত্রীও হতে পারেন। সবই হবে তাঁর নিজের পাওয়া। বিচারপতির আসন থেকে অভিজিৎ যাঁদের ভগ্ন বুকে আশা জাগাতেন, তাঁদের নয়। তবু এ সব ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের ‘নৈতিকতা’ নিয়ে আলোচনা থাক। তিনি কেন বিজেপি-কেই বেছে নিলেন, তাঁকে সঙ্গে পেতে সিপিএম এবং কংগ্রেসের আগ্রহে কেনই বা তিনি সাড়া দিলেন না, সেই সব প্রসঙ্গও আজ অবান্তর।

শুধু বলার বিষয় হল, যে দ্রুততায় বিচারপতি অভিজিৎ নিমেষে রাজনৈতিক অভিজিৎ হয়ে গেলেন, তাতে ‘বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা’ নিয়ে প্রশ্ন তোলার একটি দরজা খুলে যায়। আগাম মার্জনা চাইছি, এটা মহামান্য বিচারপতিদের প্রতি কোনও রকম অনাস্থা বা অসম্মান প্রকাশের উদ্দেশ্যে বলছি না। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, এক জন মন্ত্রী দুর্নীতিগ্রস্ত হলেই গোটা সরকারের গায়ে তার ছাপ পড়ে। এক জন নেতার চুরি ধরা পড়লেও বলা হয়, ওটা চোরের দল। এটাই বাস্তব।

পদে থাকাকালীন এক জন বিচারপতির রাজনৈতিক অবস্থান ও মনোভাব কী ছিল, অভিজিতের ভূমিকা খেকে এখন সেটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। রাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে তৃণমূল যে ভাবে সম্ভব এর ‘সুযোগ’ নেবে। তাঁর বিভিন্ন নির্দেশ, বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ সেই ভাবে দেখা হবে। বার বার প্রশ্নের আঙুল তোলা হবে বিচারপ্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতা নিয়ে। বস্তুত ভোটের ময়দানে অভিজিৎ তাঁর প্রতিপক্ষকে সেই ‘সুযোগ’ করে দিলেন। বলা যায়, তিনি মমতার দলের
‘বন্ধু’ হলেন!

অবশেষে তাপস-প্রসঙ্গ। এখানেও বিতর্কের উপাদান। আচমকা লোকসভা ভোটের মুখে দলীয় এবং বিধায়ক উভয় পদে ইস্তফা দিয়ে তৃণমূলের পুরনো নেতা তাপস রায় বিজেপি-তে গেলেন। তাঁর সম্পর্কে বিরাট কোনও দুর্নীতির অভিযোগ আগে শোনা যায়নি। পুর-নিয়োগ নিয়ে অভিযোগের সূত্রে তাঁর বাড়িতে কিছু দিন আগে ইডি-র হানা তাই অনেকের মনেই বিস্ময় তৈরি করেছিল। তাঁর বিজেপি-তে যোগদান সেই দিক থেকে কিছুটা অর্থবহ মনে হতে পারে। তবে ইডি হানার পর থেকে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে তাপসের ক্ষোভ জমছিল। তিনি সেটা গোপন করেননি।

প্রশ্ন, বিজেপি তাঁকে কী ভাবে ‘ব্যবহার’ করবে? শোনা যাচ্ছে, উত্তর কলকাতায় তৃণমূলের সম্ভাব্য প্রার্থী, লোকসভায় তৃণমূলের প্রবীণ নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁকে প্রার্থী করা হতে পারে। সুদীপের সঙ্গে তাপসের অহি-নকুল সম্পর্ক তৃণমূলে সুবিদিত। আবার তৃণমূলের অন্দরে ‘ভারসাম্য’-এর দাঁড়িপাল্লায় তাপস ছিলেন বৃদ্ধতন্ত্রের বিরুদ্ধ গোষ্ঠীতে।

এ বার ধরা যাক, তাপসের কাছে সুদীপ হারলেন। তা হলে জিতবে কি শুধুই বিজেপি? না কি আড়ালে হেসে কেউ কেউ বলবেন, ‘দেখ,
কেমন লাগে’!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Lok Sabha Election 2024 BJP Tapas Roy Abhijit Gangopadhyay PM Narendra Modi Sandeshkhali Incident Sheikh Shahajahan

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।