মাছে ভাতে বাঙালি, বললেই তো আর হল না, সেই মাছই বা কেমন আর ভাতই বা কেমন সেটাও তো খুঁটিয়ে দেখতে হবে। ভাত খাওয়ার চল আমাদের দেশ জুড়ে, এ কথা খাঁটি সত্যি নয়। নানা জায়গায় ছোট দানার শস্য, ভুট্টা ইত্যাদি খাওয়ার প্রচলন ছিল। রেশন ব্যবস্থার নামে দেশ জুড়ে সাদা চাল বিতরণের সূত্র ধরে সে প্রচলন প্রায় উধাও। খাদ্য মানে তাতে থাকবে বৈচিত্র, যেমন শর্করা, ডাল, বাদাম জাতীয় বীজ, ডিম, মাছ বা মাংস, দুগ্ধজাত কোনও কিছু, শাক, লাল/ হলুদ/ কমলা ফল বা আনাজ। দিনে অন্তত পাঁচ-ছ’রকম খাবার খাওয়া উচিত সকলের, তবেই আমাদের মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট ঘাটতি মিটবে। অনেক খাবারের উৎসই গ্রামের আশপাশ হওয়ার কথা, কিন্তু রেশন, বিজ্ঞাপন ও বাজার এই সব খাবারকে হাল-ফ্যাশনের বাইরে ছুড়ে ফেলায় আমাদের খাবারের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আমরা দিব্যি পরাধীনতা মেনে বসে আছি। এমনকি যিনি শাক-আনাজ উৎপাদন করে বাজারে বেচছেন তিনিও দু’বেলা আলুসেদ্ধ-ভাতেই খুশি থাকছেন।
খাবারের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব, অর্থাৎ খাবার ফলানো বা বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা, এ দুটো এক নয়। আমাদের মনে হচ্ছে বাজারে সাজানো হাজার হাজার খাবার, মনে হচ্ছে এই তো কত উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু আসলে যা খাবার বাজার খাওয়াচ্ছে, যা খাবার সরকার খাওয়াচ্ছে, তার বাইরে কোনও পছন্দই নেই আমাদের। খোঁটায় বেঁধে দেওয়া গরু আর চিনির কৌটোয় আটকে থাকা পিঁপড়ে, সীমাবদ্ধতার অভ্যাসকেই স্বাধীনতা ভাবতে শেখে।
তবুও ভাতের কথায় ফিরে আসি। চালের উপরের যে আবরণ তাতেই আসল পুষ্টিগুণ। তাকে বাজারি চাহিদায় ফরসা করার জন্য পালিশ করে উপরের আবরণ তুলে দিয়ে বাজারে আনা হয়। আবার বাজারে ওই চালের তুলে ফেলা দেহাবরণ ‘রাইস ব্র্যান পাউডার’ বা তেল হয়ে রান্নাঘরে ঘুরে আসে। অর্থাৎ, এক চালে ডবল মুনাফা, যার পুরোটাই কোনও কোনও কোম্পানির পকেটে, উৎপাদকের নয়। চাল থেকে পুষ্টিকে সরিয়ে তাকে এখন আবার ফিরিয়ে আনার আর এক বিচিত্র ব্যবস্থা আবিষ্কার করেছে বাজার। চালকে গুঁড়ো করে তাতে লোহা মিশিয়ে আবার তাকে চালের মতো আকার দিয়ে ১ কুইন্টাল সাধারণ চালের সঙ্গে ১ কেজি মিশিয়ে বিতরণ করা হচ্ছে। তাতে নাকি আমাদের লোহার ঘাটতি কমবে। কেন্দ্রীয় ফতোয়া মেনে পশ্চিমবঙ্গে রেশনের দোকানে দোকানেও এখন এই লোহা মেশানো চাল।
আমাদের দেশে মানুষের শরীরে লোহার ঘাটতি আছে এ কথা ঠিক। কিন্তু সরকার যখন একটি সহজ বৈচিত্রবিহীন অপ্রাকৃতিক কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত সমাধানকে ম্যাজিক বুলেট হিসেবে চালানোর চেষ্টা করে তখন পছন্দের অধিকার তো যায়ই, তেমনই জলাঞ্জলি যায় স্থানীয় সমাধানের উপর মানুষের আস্থা ও শ্রদ্ধা। ফুলকপির পাতা, কচুর শাক, ছাতু, এই সব খাবারে লোহার পরিমাণ কিন্তু কম তো নয়ই, বরং ওই চালের থেকে বেশি। আর লোহা খেলেই তা শরীরের কাজে আসবে তা না-ও হতে পারে, তা নির্ভর করছে তার সঙ্গে কতটা ভিটামিন সি অর্থাৎ লেবু জাতীয় জিনিস আপনি খাচ্ছেন তার উপরে, অন্যান্য সহায়ক এনজ়াইম, প্রয়োজনীয় প্রোটিন ইত্যাদির উপরেও। পুষ্টি তো একটি সামগ্রিক ব্যাপার, তা এ রকম একটি একটি করে পুষ্টিগুণ খুঁজে খুঁজে খাওয়ার ব্যাপার না কি?
এই যে চাল, গম, তেল, নুন আর দুধ এই সব খাবারেই এ রকম কৃত্রিম পুষ্টি গুঁজে দেওয়া হচ্ছে, কেতাবি ভাষায় একে বলে ফর্টিফিকেশন। ভোজ্য তেল ও দুধ ফর্টিফিকেশন হচ্ছে ভিটামিন এ এবং ভিটামিন ডি দিয়ে, নুনকে আয়রন এবং আয়োডিন দিয়ে। সরকার এই ইঙ্গিতও দিয়েছিল যে, ভারতে চালের ফর্টিফিকেশন বাধ্যতামূলক হতে পারে। ফলে চাই বা না চাই, আমরা যারা সরকারি খাদ্য সরবরাহ পরিকল্পনার উপর নির্ভরশীল বা সাধারণ বাজার থেকে চাল কিনে খাই, ফর্টিফায়েড চাল তাদের জন্য বাধ্যতামূলক হবে। চাহিদা না থাকলেও খেতে বাধ্য করা এক বিচিত্র অগণতান্ত্রিক পদ্ধতি। মাত্রাতিরিক্ত লোহার উপস্থিতি শরীরের পক্ষে বিষাক্ত হতে পারে। অ্যানিমিয়া, থ্যালাসেমিয়া এবং অন্যান্য হিমোগ্লোবিনোপ্যাথি আছে যাদের, বা যাদের ম্যালেরিয়া বা যক্ষ্মা রোগের মতো তীব্র সংক্রমণ রয়েছে, যা আয়রন থাকলে আরও খারাপ হতে পারে, সেই নাগরিকদের জন্য ফর্টিফায়েড চাল আরও অনেক বেশি ক্ষতিকারক। তবে আমরা যে-হেতু ‘ধর তক্তা মার পেরেক’ পদ্ধতিতে দেশের নীতি নির্ধারণ করি তাই সবার জন্য এক দাওয়াই, এমন ঘটনাকে কোল্যাটারাল ড্যামেজ বলেই ধামাচাপা দেওয়া হবে নিশ্চয়।
বিশ্বব্যাপী ফর্টিফিকেশনের জন্য মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সরবরাহও একটি বিশাল ব্যবসা, যা কেবল কয়েকটি মেগা-কর্পোরেশন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সুতরাং, নানা রকম ডাল নয়, বেচাকেনার বাইরে বাড়ির আনাচেকানাচে ফলে থাকা জংলি শাক, পিঁপড়ের ডিম, চুনো মাছ, মানকচু, এ সবের বদলে আমাদের আরাধ্য এখন হাইব্রিড পালিশ করা কৃত্রিম লোহা মেশানো ফরসা সুদর্শন চাল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy