E-Paper

দেখা হচ্ছে, দেখা হচ্ছে না

জাপানিদের নাকি মাত্রাতিরিক্ত ছবি তোলার অভ্যাস— রসিকতা শুনেছিলাম, ওঁরা বিশ্ব দেখেন লেন্সের মধ্য দিয়ে। অধুনা আমরা সব কিছুই দেখছি মোবাইল ক্যামেরার মধ্য দিয়ে।

mobile.

—প্রতীকী ছবি।

আকাশ বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০২৩ ০৫:৫৭
Share
Save

ফেরার মুখে শিলিগুড়িতে থেমে কালিম্পং রোড পর্যন্ত গিয়েছিলাম, তিস্তা নদীর ধার দিয়ে যে আশ্চর্য সুন্দর রেলপথ তখন ছিল... সে পথে গিয়েছি, রূপসী প্রকৃতির উদাসীন মায়ায় মন মেতেছে— পরে একাধিকবার গেছি সেই অঞ্চলে কিন্তু অল্প বয়সের মোহাবেশ আর ঘটেনি... বহু দেশে বহু অদ্ভুত মাধুর্য ও প্রকৃতির ব্যঞ্জনা চাক্ষুষ করে মনে হয়েছে দেখা উচিত ছিল কম বয়সে। অল্পবয়স্কদেরই যেন ভারতদর্শন করানো হয়, বিশ্বদর্শনেরও যথাসাধ্য চেষ্টা হয়, কারণ তাদেরই চোখ আর মন হল এই সুন্দরী মোহময়ী পৃথিবীর মধুরিমা আস্বাদের জন্য আকুল নয়, উপযুক্তও বটে।”— বামপন্থী চিন্তক হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন তাঁর আত্মজীবনী তরী হতে তীর-এ। বয়স তখন কম-বেশি সাতষট্টি। অবাক হতে পারার ঐশ্বর্য— চোখ বা মন— বয়সের হাত ধরে হারাতে থাকে ক্রমে। এর কারণ হিসাবে কারও সিগমুন্ড ফ্রয়েডের তত্ত্ব মনে পড়তে পারে, কারও কার্ল মার্ক্সের, কারও বা উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের কথা। বিস্মিত হতে পারার মতো সংবেদনশীল ও সৃষ্টিশীল না হতে পারা এক দুর্ভাগ্য— প্রথম দেখা পুরীর সমুদ্র বা পাহাড় বেয়ে নেমে আসা তিস্তা-রঙ্গিতের সঙ্গে প্রথম দেখা সে কারণেই শ্রেষ্ঠ দেখা।

মানুষ যে কিছু দেখছে না, এখন চোখের সামনে নিত্য দিন তা দেখতে হচ্ছে। বাস, ট্রেন, মেট্রো, অফিস-কাছারি সর্বত্র বিপুলসংখ্যক মানুষ নতশির ও স্থিরদৃষ্টি, হাতের স্মার্টফোনের পর্দায় বিভোর, আঠায় আটকে যাওয়া মাছির মতো। চায়ের দোকান, বারোয়ারি আড্ডার পরিচিত ভঙ্গি এখনও থাকলেও, নেই বন্ধুদের অবিরল পারস্পরিক বাক্যালাপ। আয়োজন সম্পূর্ণ করেও সকলে যেন আপনা মগ্ন আপনি। খেলায় বা প্রেমে, চ্যালেঞ্জে, প্রতিহিংসায়, প্রতিবাদে-প্রত্যুত্তরে, ক্রয়ে-বিক্রয়ে, বিনিয়োগে বা ব্যর্থতায়, সংবাদে-বিসংবাদে, বিজ্ঞানে বা অপপ্রচারে, অধ্যাত্মে বা আস্বাদনে— যে যে ভাবে হোক সারা বিশ্বের সঙ্গে কম-বেশি সংযুক্ত। এবং সকলেই কম-বেশি নতশির, স্থিরদৃষ্টি।

জাপানিদের নাকি মাত্রাতিরিক্ত ছবি তোলার অভ্যাস— রসিকতা শুনেছিলাম, ওঁরা বিশ্ব দেখেন লেন্সের মধ্য দিয়ে। অধুনা আমরা সব কিছুই দেখছি মোবাইল ক্যামেরার মধ্য দিয়ে। টেবিলের সিজ়লার থেকে মঞ্চে শাহরুখ খানের বক্তৃতা, বোলপুরের ট্রেনে বাউলের গান, দুর্গাপুজোর ঠাকুর-মণ্ডপসজ্জা— মানুষ বিভোর ছবি তুলতে, রিল বানাতে। সমাজমাধ্যমে কত মানুষ ব্যক্ত করলেন তাঁদের পছন্দ, প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন ক’জন, ক্ষণে ক্ষণে তা দেখে আত্মমুগ্ধতায় বুঁদ হওয়ার আয়োজন। এই সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে নিজের যদি দেখা বা শোনা না-ও হয় কিছু, যদি সহমানুষের অসুবিধা বা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, তা-ও সই। মোবাইল-আসক্তি বা নিজেকে নিরন্তর দেখিয়ে চলার অভ্যাসে তুলনায় তরুণতরদের মাঠ ছেড়ে দিতে রাজি নন বড়রাও। কোথায় সঞ্চিত হবে এত ছবি, কত বিপুল সংগ্রহ একটি ফোন বা কম্পিউটারে রেখে দেওয়া সম্ভব, প্রতি মুহূর্তের ব্যক্তিগত যাপনকে ধরে রাখার সাধ সম্ভব করে তুলতে কী কী দরকার, প্রশ্ন অনেক। উত্তর কিছু জানা, অজানা কিছু।

এ ভাবে সবাইকে সব কিছু দেখাতে গিয়ে এবং সবার সব কিছু দেখতে গিয়ে চার পাশের কত কিছু যে দেখা হচ্ছে না! সব কিছুকে মেলাতে গিয়ে তৈরি হচ্ছে বীভৎস বিচ্ছিন্নতা, বিশ্বের সমাচার পেতে গিয়ে ঘরের পাশের আরশিনগরের সংবাদ পৌঁছচ্ছে না। চলার পথে পোস্টার-সাইনবোর্ড-দেওয়াল লিখন পড়ে যে শেখা, যানবাহন, ডাক্তারবাবুর চেম্বার, সেলুনে খবরের কাগজ-ম্যাগাজ়িন পড়ে যে ‘জ্ঞান’ অর্জন, অথবা বাসের জানলায় মুখ রেখে দেখার যে আশ্চর্য অভিজ্ঞতা, তা থেকে বঞ্চিত থাকতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অপরাজিত ছবিতে ট্রেনের বাইরের দৃশ্যপট দেখিয়ে সত্যজিৎ রায় বুঝিয়ে দিয়েছিলেন অপুরা কাশী ছেড়ে ফিরে আসছে সুজলা-সুফলা শ্যামল বঙ্গদেশে; নায়ক ছবিতে ঠিক তার উল্টো যাত্রাপথ। মানুষ তখন সচেতন ভাবেই হোক কিংবা বাধ্যত, সব দেখত। এখন সবাই গান শোনে, গেম খেলে, চ্যাট করে, চার পাশে চোখ মেলে দেখে না কিছু। আজ এই দেখানোর উৎসবে মগ্ন সমাজে, সর্বত্র সারি সারি নতশির মানুষকে দৃষ্টিসুখসম্মোহন থেকে উদ্ধার করার দায়িত্ব কে নিজের কাঁধে তুলে নেবে, বা আদৌ তা সম্ভব কি না— কার কাছে সে উত্তর আছে, কে জানে!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Mobile Phones Addiction

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।