সরস: ‘রামগরুড়ের ছানা’ কবিতায় সুকুমার রায়ের অলঙ্করণ।
কবিতার গোড়াটা শুনলে মনে হবে, মাদারি কা খেল-এর আহ্বান। এত নৈপুণ্যে শব্দবিন্যাস বাজিয়ে তুলছে ঝঙ্কার, যেন শোনা যাচ্ছে সেই ঢোল-ডুগডুগির শব্দ। ‘দেখ্ বাবাজি দেখবি নাকি/ দেখরে খেলা দেখ্ চালাকি,/ ভোজের বাজি ভেল্কি ফাঁকি/ পড়্ পড়্ পড়্ পড়বি পাখি— ধপ্!’ দলবৃত্ত ছন্দ-কাঠামোয় ‘পড়্ পড়্ পড়্’ তিন রুদ্ধদলে এক পর্ব যেন অনায়াসে গতিমান, পুরো ঘটনার দিকে উদ্গ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছে পাঠক। তার পরই ঘটে অঘটন। ধামাধরা গোষ্ঠমামার বুকে বিঁধে গেল বাণ। ‘ঐ যা! গেল ফস্কে ফেঁসে/ হেই মামা তুই ক্ষেপ্লি শেষে?/ ঘ্যাঁচ্ ক’রে তোর পাঁজর ঘেঁষে/ লাগল কি বাণ ছট্কে এসে— ফট্?’ ঘটনাপরম্পরা এতই অপ্রত্যাশিত মোড় নেয়, ছন্দদ্রুতির তাল ঠুকতে ঠুকতে যে আমাদের নজর এড়িয়ে যায়, কী অসমান্য কবিতার বাঁধুনি! পাশে দু’টি ছবি। ঘটনার সাযুজ্যে গ্রথিত। উদ্ভট ঢুকে পড়ল এ বার। চশমা-আঁটা এক বাবু ধনুক ধরেছেন উল্টোবাগে। তাতেই বিপত্তি। কবিতা বলে ঘটনা, ছবি দেখায় তার কারণ। ছবি-কবিতা মিলেমিশে তৈরি হয় পাঠ্যপট। একে অন্যের সম্পূরক।
এ এক সর্বৈব নতুন প্রয়োগ। বাংলা কবিতার ইতিহাসে চমকে ওঠার মতো কল্পনামনীষা। কবিতার নাম ‘ফস্কে গেল!’ বইয়ের নাম আবোল তাবোল। কবি, সুকুমার রায়। মলাট, বইয়ে আঁকা ছবি-অলঙ্করণও তাঁর। প্রকাশিত হয় ১৯২৩-এর ১৯ সেপ্টেম্বর। কবি দেখে যেতে পারেননি সেই গ্রন্থপ্রকাশ, দশ দিন আগে, ৯ সেপ্টেম্বর প্রয়াত হন। গত একশো বছরে আবোল তাবোল বাংলা কবিতার এক অত্যাশ্চর্য অপ্রতিদ্বন্দ্বী অস্তিত্ব। তার শিল্পিত, চমকপ্রদ খেপামির দীপ্তি বঙ্গজীবনের, বঙ্গসমাজমানসের শিরাধমনী জুড়ে বহমান।
ভূমিকা নয়, মুখবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘কৈফিয়ত’। নাতিদীর্ঘ সেই কথনে ধরা ছিল দৃষ্টিভঙ্গির চাবিকাঠি। “যাহা আজগুবি, যাহা উদ্ভট, যাহা অসম্ভব, তাহাদের লইয়াই এই পুস্তকের কারবার। ইহা খেয়াল রসের বই। সুতরাং, সে রস যাঁহারা উপভোগ করিতে পারিবেন না, এ পুস্তক তাঁহাদের জন্য নহে।” মজাটা এই যে, ‘আজগুবি’, ‘উদ্ভট’, ‘অসম্ভব’ শব্দের পাশেই আছে ‘কারবার’। অনন্ত অবাস্তবের সঙ্গে কবি মিশিয়ে দিচ্ছেন কড়া ‘অর্থময়’ লেনদেনের বার্তা। এই সংঘর্ষের ফুলকি অবিনশ্বর উড়ে বেড়াল নতুন-নতুন যুগের পাঠক-পাঠিকার চার দিকে। সম্মোহিত করে রাখল তাদের।
আবোল তাবোল কাব্যগ্রন্থে ঠিক কী অভিনবত্ব যোজনা করলেন কবি? একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে, অবিশ্বাস্যের নানা রংদার উপস্থাপনা মিশে থাকে চেনা চৌহদ্দি, চেনা মানুষজনের পরিসরে। প্রচ্ছদে মই বেয়ে মেঘে বর্ণস্থাপন, তালগাছের উপর হুঁকো হাতে বৃদ্ধ, ক্লাউনের জগঝম্পে নৃত্যরত শুয়োর, আকাশচুম্বী পর্বতশীর্ষে মগ্ন গায়ক, সবই বাস্তবধর্মী পশ্চাৎপটে বিধৃত। কবিতা আর সংশ্লিষ্ট ছবিতে এই কল্পনা আর আজগুবি পরতে-পরতে সংলাপ চালায় ‘বাঙালি’ বাস্তবতার বহুমাত্রিক আনাচকানাচের সঙ্গে। এই ধরুন দু’-দুটো লেজবিশিষ্ট ‘হুঁকোমুখো হ্যাংলা’। তার আজগুবি কীর্তিকলাপের পাশাপাশি বাস্তবের আশ্চর্য অনুপ্রবেশ ঘটে: ‘শ্যামাদাস মামা তার আপিঙের থানাদার,/ আর তার কেউ নাই এছাড়া—’। বিকটমূর্তি, শিং-থাবা-কাঁটাওয়ালা, হাতে মুগুর, গুহা থেকে বেরিয়ে আসে আর তার অতিকায় অবয়বের সামনে একরত্তি ছাতা-ধুতির কেরানি ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পালায় (‘ভয় পেয়ো না’), কিংবা কুমড়োপটাশ নাচলে আস্তাবলের কাছে যাওয়া মানা, ‘ছায়াবাজি’-র লোকটি ছায়া ধরার ব্যবসা করে ‘চাঁদের আলোয় পেঁপের ছায়া’ ‘আমড়া গাছের নোংরা ছায়া’ ‘তেঁতুলতলার তপ্ত ছায়া’ ঝুড়ি দিয়ে আটক করে, পালোয়ান ষষ্ঠীচরণকে দেখা যায় বেনিয়াটোলায়। এই জানাচেনা বাস্তবের বনিয়াদে অসম্ভবের ছন্দনির্মাণ খোলতাই হয় ভাল।
এই ধরনের সমাজ-সময়-ব্যক্তিমানুষ ঢুকে পড়ার কারণেই, আবোল তাবোল বাঙালি জীবনাভিজ্ঞতা থেকে শত-শত বছরেও বিচ্ছিন্ন-বিচ্যুত হয় না। ভারতী পত্রিকায় চৈত্র ১২৯০ সংখ্যায় তরুণ রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন শ্লেষে-ক্রোধে, ‘অকালকুষ্মাণ্ড’ প্রবন্ধ। লিখেছিলেন, “...ইংরেজ যদি কখনো ভারতবর্ষ হইতে চলিয়া যায়... আর কেহ যাক না-যাক— আধুনিক বাংলা সাহিত্যটা তো যাইবেই। কারণ ইংরাজি গ্যাসলাইট ব্যতীত এ সাহিত্য পড়া যায় না।” এ দিক থেকে আবোল তাবোল এক মহাব্যতিক্রম। ‘নন্দখুড়ো’, ‘আদ্যানাথের মেসো’, ‘বাদলা রোদে জষ্ঠি মাসের বৃষ্টি’, ‘ছবির ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখে আমসত্ত্ব ভাজা’, ‘ডাকে যদি ফিরিওয়ালা’, ‘মালকোঁচা মারে বুঝি’, ‘শুনতে পেলুম পোস্তা গিয়ে’, ‘ঝোলাগুড় কিসে দেয়? সাবান না পটকা’, ‘পাঁউরুটি আর ঝোলাগুড়’, ‘ঠোঙাভরা বাদাম ভাজা’, এমন অজস্র চিহ্নকে ঠাসা আবোল তাবোল বাঙালি অভিজ্ঞতার অনশ্বর অংশ। ‘ব্যাকরণ মানি না’ ঘোষণা-সহ ‘খিচুড়ি’-তে তিনি বেছে নেন সন্ধি-সমাসের অক্ষরধ্বনির সমতা। হাঁস+সজারু, গিরগিটি+টিয়া, হাতি+তিমি, জিরাফ+ফড়িং ইত্যাদি। খেয়ালরসের তলায় নিহিত থাকল শব্দতত্ত্বের তীক্ষ্ণ হিসাবনিকাশ। ‘একা সে/ ফ্যাকাশে’, ‘অঙ্ক/ অসংখ্য’, ‘হাঁ করে/ মাকড়ে’, ‘পক্ষীরাজ/ লক্ষ্মী আজ’, চমকপ্রদ অন্ত্যানুপ্রাসের বন্যাও আছে। এই সচেতন নির্মাণ আর উদ্ভটের অবিশ্বাস্যতা আবোল তাবোল-এর প্রাণবায়ু। তার পূর্বসূরি নেই, উত্তরসূরিও অনুপস্থিত।
সুকুমার রায়ের গরিমা বহুস্তরিক। এই সব আজগুবি উদ্ভট শুধু মজা আর হালকা হাসির খাঁচায় বদ্ধ হয়ে থাকে না। নানা সময়ে, নানা পাঠে, নতুন নতুন পরিস্থিতিতে মশকরার আস্তরণ ভেদ করে দ্বিতীয় এক মাত্রা নিয়ে আবির্ভূত হয়। শুধু প্রতীক নয়, ছবি-ছড়ার অসম্ভব জীবনের গূঢ় সত্যকে ছুঁয়ে ফেলে। পাগল, খেপা— এ সব শব্দ বাউল-ফকির-কর্তাভজা-দরবেশ ঐতিহ্যে সত্যদ্রষ্টার স্বরূপ। সুতরাং, কখন যে হাসি-কৌতুক উদ্ভট ঢুকে পড়ে দর্শনের এলাকায়, বোঝা দুষ্কর।
কবিতা-পরিচয় পত্রিকার দশম সঙ্কলনে (জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৬) ‘বাবুরাম সাপুড়ে’ নিয়ে দীর্ঘ একটি নিবন্ধ বা ‘পাঠ’ পরিবেশন করেন মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি লেখেন, “আমার মনে হয় যে এই কবিতাটির মধ্যে এক মারাত্মক দার্শনিক থাপ্পড় র’য়ে গেছে— আমরা জীবনের দিকে যে ভাবে তাকাই, এই প্রচণ্ড চপেটাঘাতটি তারই প্রতি উদ্দিষ্ট।” তাঁর মতে, “আবোলতাবোল জগৎটি আসলে আমাদেরই এই পৃথিবীর একটি সটীক সংস্করণ বিশেষ।”
কত কবিতায় বিশ শতকের আদিপর্বের বহু অভিজ্ঞতা জাপ্টে-জড়িয়ে থেকেও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের মতো পঙ্ক্তিতে-পঙ্ক্তিতে ইশারা ছড়িয়ে রাখেন কবি। ‘সাত জার্মান, জগাই একা, তবুও জগাই লড়ে।’ অথবা ‘দেখতে পেলাম তিনটে শুয়োর/ মাথায় তাদের নেইকো টুপি’— ঔপনিবেশিক, উত্তর-ঔপনিবেশিক নানা অভিজ্ঞতার সঙ্গে নব-নব রূপে প্রাণে আসে। বেজে ওঠে।
ইদানীং লক্ষ করছি গবেষকরা হামলে পড়ে ‘নিশ্চিত’ অনুমানে জানাচ্ছেন তৎকালীন কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কোন কবিতা লেখা। কিছু কিছু সমান্তর যথেষ্ট চমকপ্রদ হলেও মনে হয়, কবিতার পক্ষে ক্ষতিকর। কেননা কবি ছন্দ-মিলে সাংবাদিক প্রতিবেদন লেখেন না, ঘটমান মুহূর্তগুলি থেকে ভবিষ্যতের অগণন সম্ভাবনাকে নিষিক্ত রাখেন কবিতায়। সারা আবোল তাবোল জুড়ে রাজা-রানি সিপাই-সান্ত্রি-কোটাল নিয়ে যে এত রাজশক্তির প্রতি বিদ্রুপ, তাদের নিয়ে সদা উপহাস-পরিহাস, সে কি আজকের ভারতবর্ষের শ্বাসরোধী শাসনের নিরিখে প্রযোজ্য নয়? আবোল তাবোল-এর লক্ষ্য বারংবার, এক ক্ষমতাদর্পী একক স্বর। যে সর্বদা আধিপত্য ও কর্তৃত্বের ‘যুক্তি’ দিয়ে আচ্ছন্ন করে ফেলতে চায় ‘ছোট’-কে। শৃঙ্খলা আর শৃঙ্খল যখন হামেশাই জুড়ে যায়, তখন বিশৃঙ্খলার উদ্ভটই হাতিয়ার। ‘আয় খ্যাপা-মন ঘুচিয়ে বাঁধন/ জাগিয়ে নাচন তাধিন্-ধিন্’। এক দিকে ‘একুশে আইন’ ‘বোম্বাগড়ের রাজা’ আর অন্য দিকে ‘বিজ্ঞান শিক্ষা’ ‘বুঝিয়ে বলা’। এ যেন আলথুসের কথিত ‘রাষ্ট্রিক দমন-কল’ আর ‘রাষ্ট্রিক মতাদর্শ-কল’ সশরীরে হাজির। যে কোনও জোর-জবরদস্তিকে একক ক্ষমতাস্বরকে হাসিঠাট্টায় উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন সুকুমার। ভয়ের পাঁজর ঘেঁষে হাসির বল্লম ঘ্যাঁচ করে ঢুকিয়ে দেন তিনি।
এমন কথা বেশি বলতে ভয়ও করে। কেননা, আবোল তাবোল-এর একটি তৃতীয় মাত্রা আছে। বহু মান্য আলোচকই দেখেছেন সুকুমারের ‘ননসেন্স’-এ ক্রমাগত ছায়া ফেলে যান এডওয়ার্ড লিয়র আর লুইস ক্যারল। এও এক অর্থে রবীন্দ্রনাথ কথিত ‘ইংরেজি সাহিত্যের গ্যাসলাইট’ ফেলে বাংলা কবিতা বিচারের ধারা! এঁরা বুঝতে চান না, ‘প্রভাব’ বা ‘অভিঘাত’ সৃষ্টিশীল শিল্পীমনের পরিপ্রেক্ষিতে আজ অচল শব্দ। লিয়র বা ক্যারলের ছড়া বা ছবি, একটু ঝুঁকি নিয়েই বলি, বহুলাংশে স্থাণু। ‘নারদ! নারদ!’ কবিতার ছবিতে এক জন পৈতেধারী ব্রাহ্মণ আর অন্য জন কোট-বুটের মেটে-সাহেব। ‘নেড়া বেলতলায় যায় ক’বার?’ কবিতায় ইটের পাঁজায় বসা লোকটির মাথায় ব্রিটিশ মুকুট আর সাহেবি তরোয়াল। ‘ওগো রাজা মুখটি খোল— কওনা ইহার কারণ কি?’ উপনিবেশের রাজা থেকে আজকের মণিপুর কিংবা মহিলা কুস্তিগিরদের যৌন হেনস্থা— সুকুমারই পারেন এ সব প্রশ্ন জীবন্ত রাখতে। ঔপনিবেশিকতার পরিসরে ‘কর্তার ভূত’ নানা অবয়বে, বিচিত্র পরিচয়ে নিয়ন্ত্রণ করে ব্যক্তি এবং দণ্ডমুণ্ডের পরিসর। এই সমাজ বা ব্যক্তি অভিজ্ঞতার মাত্রা লিয়র ও ক্যারলের অধিগত বা অনুভূত ছিল না।
আবার, তাঁকে এ ভাবেই শুধু দেখব কেন? সেখানেই তিনি মহীয়ান, যেখানে তিনি বহুস্বরের ধারক। কেউ তাঁকে পড়বেন আজগুবি আর মজার অঙ্গনে, কেউ পড়বেন সমকালীন অভিজ্ঞতায়, কেউ তৎকালীন ঘটনাবলির সমান্তরে, কেউ ‘ননসেন্স’-এর ভারতীয় প্রয়োগ বিবেচনায়, কেউ ক্ষমতা মোকাবিলার সশস্ত্র উচ্চারণ হিসাবে। সর্বত্রই হীরকখণ্ডের মতো চোখ-ধাঁধানো ঔজ্জ্বল্যে হাসতে থাকবে আবোল তাবোল, শতবার্ষিকীর ভাস্বরতায়। ‘আজগুবি চাল্ বেঠিক বেতাল/ মাতবি মাতাল রঙ্গেতে—/ আয়রে তবে ভুলের ভবে/ অসম্ভবের ছন্দেতে।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy