ব্যতিক্রমী: সৈয়দ মুজতবা আলী। ছবি: পরিমল গোস্বামী।
ভাবা যাক ১৯২৭ সালের প্যাচপেচে গরমের সেই দিনটার কথা। ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন হাওড়া— তুমুল হইচই, ব্যস্ততা... বছর তেইশের বেঁটেখাটো এক তরুণ উঠে বসলেন ট্রেনে। পেশোয়ার যাবেন, সেখান থেকে কাবুল। সঙ্গে সবচেয়ে দামি জিনিস একটাই, রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন থেকে পাওয়া এম এ ডিগ্রি, ব্রিটিশ প্রশাসনের কাছে যার স্বীকৃতি বা দর নেই তখন। সুতরাং তরুণ চলেছেন আফগানিস্তান, সেখানকার আধুনিক সংস্কারপন্থী শাসক আমানুল্লা খানের নতুন শিক্ষা দফতরে কাজে যোগ দিতে। আফগানিস্তান যাবে বলে তরুণটি কলকাতার চাঁদনিতে পুরনো জামাকাপড়ের বাজার থেকে অল্প দামের একটা শার্ট কিনেছেন। সাদি আর হাফিজ়-এর ফারসি বয়েত পড়ে পড়ে মুখস্থ করেছেন, কারণ তিনি জানেন, ভারত ও আফগানিস্তানের মধ্যে যুগ-যুগান্তের যে ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বন্ধন, সাহিত্যের ঐতিহ্যই তার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী। জীবন বদলে দেওয়ার যাত্রায় এই প্রস্তুতিটুকু তাঁর কাছে মনে হয়েছে যথেষ্ট।
তরুণের নাম সৈয়দ মুজতবা আলী। এই আফগানিস্তান-যাত্রা তাঁর জীবনে হয়ে উঠবে অন্যতর নানান সীমান্ত অতিক্রমও। সীমানা ছাপিয়ে জীবনব্যাপী তাঁর ‘দূরে কোথাও, দূরে দূরে’ যাওয়ার সেটাই শুরুয়াত। দ্বিতীয়ত, সাহিত্যের সব সীমানা ভেঙে তাঁর হাতেই বাংলা ভাষায় প্রাণ পাবে এক নতুন ঘরানা— রম্যরচনা: তার খানিকটা আত্মজৈবনিক, খানিকটা ভ্রমণকথা, বিশ্ব জুড়ে সাম্রাজ্যগুলির ক্রমশ ভেঙে পড়ার সাক্ষী ইতিহাসসম্মত তীক্ষ্ণ এক দৃষ্টিভঙ্গিও উপস্থিত সেখানে। তৃতীয় বৈশিষ্ট্যটি প্রথম দুইয়ের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি— এক আধুনিক লেখকসত্তার নির্মাণ। এমন এক আড্ডাবাজ লেখক, বাঙালি বাড়ির রোয়াক, চা-দোকান, পাড়া ছাড়িয়ে সমস্ত নাগরিক পরিসর ঘুরে আর দেখে বেড়ায় যে, নির্মল গুলতানিতে পেরিয়ে যায় ভারত মহাসাগর, ইউরোপের সীমা।
বিশ শতকের শুরুতে আফগানিস্তান যাওয়া ভারতীয় ভ্রামণিকদের কাছে এই ভূখণ্ড ছিল বিশ্বসংস্কৃতির এক উঠোন। সৈয়দ মুজতবা আলী, রামনাথ বিশ্বাস, উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও অন্য আফগানিস্তান-কথকেরা তুলে ধরেছেন দুই দেশের সংলাপের পরিসরটিকে— সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও ভাষিক অন্তরঙ্গতাকে। বিশ্বজোড়া উপনিবেশ-বিরোধী সংহতিতে ভারতের যোগ এই সূত্রে পোক্ত হল। সৈয়দ মুজতবা আলীর এশিয়া ও ইউরোপজোড়া ভ্রমণকাহিনিগুলি পড়তে বসলে তাই আজও সীমান্ত, স্বদেশ নিয়ে চিন্তার অজস্র সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যায়।
দেশে বিদেশে-কে যেমন মনে হয়— ঔপনিবেশিক শাসনের নিগড়-ভাঙা, উপনিবেশ-বিরোধী অমিত সম্ভাবনার এক কল্পকৃতি বলে। শার্ল বোদল্যেয়র-এর কবিতার আলোচনা করতে গিয়ে ওয়াল্টার বেঞ্জামিন ‘ফ্ল্যানর’ (flaneur) শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন, সে এক আধুনিক পুরুষ, প্রাচুর্যময় নগরসভ্যতা সে অলস ভঙ্গিতে হাঁটতে হাঁটতে, দেখতে দেখতে পেরিয়ে যায়। এটা আলী সাহেবেরও বৈশিষ্ট্য। পরিহাস ও কৌতুককে তিনি যেমন মোক্ষম ভাবে ব্যবহার করেন, সেখানেই ভারতীয় ইতিহাসনামার বাঁধন-ছেঁড়া সম্ভাবনা। ভ্রমণকে প্রাধান্য বিস্তার, ভ্রমণসাহিত্যকে নৃতাত্ত্বিক সন্দর্ভ হিসেবে দেখার যে ঔপনিবেশিক অভ্যাস, আলী সাহেব হাসতে হাসতে সেখানে অন্তর্ঘাত ঘটিয়ে দেন। দেশে বিদেশে আসলে উপনিবেশ ও সাম্রাজ্যবাদের গতিশীলতারই গল্প, শুধু শাসিতের দৃষ্টি থেকে দেখা আর বলা। ব্রিটিশ পাসপোর্টের দৌলতে বাধাবন্ধহীন যত্রতত্র গমন, বিশ্বজনীনতার অভিজ্ঞতা-স্মৃতি তাই ফিরে ফিরে আসে মুজতবা আলীর আফগানিস্তান-কাহিনিতে, পরে নাৎসি উত্থানের জার্মানি-ভ্রমণকথাতেও।
আফগানিস্তান-ব্রিটিশ ভারতের সীমান্তটা কী রকম? ব্রিটিশের আইনি শাসন সেখানে চলে না, কিন্তু মুজতবা আলীর কাছে তা মুক্তির, যথেচ্ছ চলাচলের পরিসর। বাজার, আড্ডার প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর পেশোয়ারে তিনি প্রথম পঠান ও আফগান আতিথেয়তা ও বন্ধুত্বের স্বাদ পাচ্ছেন। শান্তিনিকেতন ও কলকাতার পরিচিত সামাজিকতার বাইরে অন্য সমাজের সঙ্গে তাঁর এই প্রথম পরিচয়। খাইবার পাস পেরোনোর কষ্টকর বর্ণনা দেশে বিদেশে-র অন্যতম আকর্ষণ; প্রতিকূল আবহাওয়া, রেল যোগাযোগহীন দুর্গম পথ। ব্রিটিশ অভিযাত্রীদের ভ্রমণকাহিনিতে এই গিরিপথের বর্ণনায় পদে পদে বিপদ, পাহাড়ে লুকোনো জনজাতি যে কোনও সময় নিশানা করতে পারে। কিন্তু মুজতবা আলীর লেখায় এ সব কথা একেবারেই নেই। তাঁর কাবুল যাওয়া এক লজ্ঝড়ে বাসে, “আপাদমস্তক পুরু টিন দিয়ে ঢাকা এবং নশ্বর ভঙ্গুর কাচ সে তার উইন্ডস্ক্রিন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে। একটা হেডলাইট কানা, কাচের অবগুন্ঠন নেই।” দৈহিক কষ্ট আছে, উটের কাফেলার পিছনে বাসের বিরক্তিকর চলা আছে, সরাইখানার দুর্গন্ধ আছে, কিন্তু এই সবই যাত্রীদের মধ্যে গড়ে তোলে সংহতি, বন্ধুত্ব। আফগানিস্তানে প্রবেশের ভয় সংশয় সন্দেহে মোড়া ঔপনিবেশিক মনোভাব এ কাহিনিতে নেই, বরং আছে কাবুল উপত্যকায় পৌঁছনোর আশা ও আনন্দে ভরা বর্ণনা।
স্বপ্নমুখর এই পরবাস ভেঙে যায় ১৯২৯ সালে। আমানুল্লা খানের সংস্কার আন্দোলনের বিরোধিতা লুটতরাজ ও বিদ্রোহ শুরু করে এক ভিস্তিওলার ছেলে, ডাকাত বাচ্চা সগাও-এর ভাড়াটে সৈন্যরা। আলী সাহেব লিখছেন, “ফরমান বেরোল। তার মূল বক্তব্য, আমান উল্লা কাফির, কারণ সে ছেলেদের এলজেব্রা শেখাত, ভূগোল পড়াত, বলত, পৃথিবী গোল। বিংশ শতাব্দীতে এ রকম ফরমান বেরোতে পারে সে কথা কেউ সহজে বিশ্বাস করবেন না, কিন্তু বাচ্চার মতো ডাকাত যখন তখৎ-নসীন হতে পারে তখন এ রকম ফরমান আর অবিশ্বাস করার কোনও উপায় থাকে না।” এ যেন পুরোদস্তুর গৃহযুদ্ধের দামামা। নিরাপদে দেশে ফিরতে কাবুলের ভারতীয়রা সেখানকার ব্রিটিশ দূতাবাসে স্যর ফ্রান্সিস হামফ্রেজ়-এর কাছে আবেদন করলেন। ফ্রান্সিস জানালেন, কাবুলে আটকে পড়া ভারতীয়দের প্রতি তাঁর কোনও দায়িত্ব নেই। আলী সাহেব লিখছেন, “সাহস করে যদি এই জীবনে সত্যি কথা বলে ফেলতে পারি, তবে একবার স্বর্গদর্শন লাভ হলেও হতে পারে। বললুম, হাওয়াই জাহাজগুলি ভারতীয় পয়সায় কেনা, পাইলটরা ভারতীয় তনখা পায়, পেশাওয়ারের বিমানঘাঁটি ভারতের নিজস্ব— এ অবস্থায় আমাদের কি কোনো হক নেই? ব্রিটিশ লিগেশন যে ভারতীয় অর্থে তৈরি, সায়েব যে ভারতীয় নিমক খান, সে কথা আর ভদ্রতা করে বললুম না।” ফল: অবরুদ্ধ কাবুল থেকে উড়ানে ফিরবেন যাঁরা, সেই ভারতীয়দের তালিকা থেকে ফ্রান্সিস প্রতিবাদী মুজতবা আলীর নাম কেটে দিলেন। তার পর বিপর্যয়, চার দিকে বিশৃঙ্খলা ও ডাকাতি, পেটে কিল মেরে কোনও মতে আধপেটা খেয়ে থাকার কাহিনিও মুজতবা লিখে গিয়েছেন। এ-হেন পরিস্থিতিতে এক দিন চলে গেলেন বাবরের কবরে। পরিপার্শ্বের অসহায়তা, ব্রিটিশ সরকারের ব্যবহারে ক্ষোভ, ভারতের জন্য আশা, সবই যেন মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতার কবরে সে দিন দর্শন করলেন তিনি, “কবরের কাছে দাঁড়িয়ে মনে হয় আমি আমারই মতো মাটির মানুষ, যেন এক আত্মজনের সমাধির কাছে এসে দাঁড়িয়েছি।…বরফের শুভ্র কম্বলে ঢাকা ফকির বাবুর খোদাতালার সামনে সজগা নিয়ে যেন অন্তরের শেষ কামনা জানাচ্ছেন। কী সে কামনা? ইংরেজ-ধর্ষিত ভারতের জন্য মুক্তি-মোক্ষ-নজাত কামনা করছেন।”
আলী সাহেবের সংযত ও পরিশীলিত গদ্যে এই ‘ধর্ষিত’ শব্দটি যেন আছড়ে পড়ে এক চরম অভিঘাতে। মনে পড়ে যায়, এই লেখা ছেপে বেরোচ্ছে ১৯৪৬ থেকে ৪৮-এর মধ্যে। সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা, আসন্ন দেশভাগ, সব নিয়ে ভারতে সে বড় সুখের সময় নয়। কাঁটাতারের নতুন সীমানা, দুর্বোধ্য ছায়ারেখা পেরিয়ে কয়েক লক্ষ মানুষের দেশ-ছাড়া হওয়া, খুন জখম ধর্ষণ লুটতরাজের মধ্যে স্বাধীনতার আগমন তখন স্বাধীন দুই দেশের নাগরিককে বিপন্ন করে তুলেছে, ঝাপসা চোখে খুঁজতে হচ্ছে স্বদেশ ও নির্বাসনের নতুন সংজ্ঞা।
এই পরিস্থিতিতে ১৯২৭-২৯ সময়কালের আফগানিস্তান, তার নির্বিচার হিংসা ও বিশৃঙ্খলাকে ফিরে দেখা যেন হয়ে দাঁড়ায় মুজতবা আলীর নিজের সত্তারই হাহাকার— উত্তর-ঔপনিবেশিক দুনিয়াতে ভারত আর পূর্ব বঙ্গ/ পূর্ব পাকিস্তান/ বাংলাদেশে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ আর জাতীয়তাবাদী মিথ গড়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষার সসম্মান প্রতিষ্ঠার সক্রিয় সমর্থন তাঁকে করে তুলেছিল পাকিস্তানের শাসকদের চক্ষুশূল, নিজ ভূমে অবাঞ্ছিত। ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশের তরফেই আলাদা আলাদা সময়ে অভিযোগ এসেছে, তিনি অন্য দেশের চর। দুই পারের দুই বাংলায় যে রাজনীতির শিকার হলেন, সেখানে হতাশা ছাড়া আর কিছু থাকল না। অপরিমিত মদ্যপান, পঙ্গুত্ব ও স্নায়ুরোগে তা বেড়ে গেল আরও। পঞ্চাশ বছর হতে চলল, তিনি শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন ১৯৭৪ সালে, সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের ঢাকা শহরে। উপনিবেশ পাততাড়ি গোটানোর পর দক্ষিণ এশিয়ায় এমনই ছিল বহু মানুষের ভবিতব্য। এক অচেনা ভূখণ্ডে নির্বাসন— একদা যা ছিল তাঁদের দেশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy