—প্রতীকী ছবি।
আমেরিকার আটলান্টায় জেলের মধ্যে ছারপোকার কামড়ে মৃত্যু হয়েছে লশন টমসন নামে এক বন্দির। মৃতের পরিবারের এই অভিযোগে তোলপাড় আমেরিকার বিচারব্যবস্থা, জেল ও মানবাধিকার সংগঠনগুলি। লশন মানসিক রোগগ্রস্ত ছিলেন, বিনা অনুমতিতে একটি শিশু আবাসের পার্কে ঢুকে ঘুমাচ্ছিলেন তিনি। তাই পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। আটলান্টার ফুলটন কাউন্টি জেলের মনোরোগ শাখার একটি জেলে তাঁকে রাখা হয়েছিল। বিচারাধীন অবস্থাতেই মারা যান লশন। তাঁর যে ছবি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে তাঁর উন্মুক্ত মুখ, বুক ও পেটের উপর হাজার হাজার ছারপোকা, বা ছারপোকা জাতীয় কোনও পোকা বসে রয়েছে। পরিবারের অভিযোগ, জেলে ছারপোকার হাত থেকে বাঁচার জন্য সাহায্য চেয়ে চিৎকার করলেও কেউ তাঁকে সাহায্য করেনি, তাঁর মনোরোগের চিকিৎসাও হয়নি।
আটলান্টার শেরিফ ও জেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, এই ঘটনার জেরে বেশ কয়েক জন জেলকর্মী পদত্যাগ করেছেন। জেল সংস্কারের জন্য প্রচুর অর্থ মঞ্জুর করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ ৬০০ বন্দিকে অন্যত্র সরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু পরিবার ও মানবাধিকার কর্মীরা তাতে সন্তুষ্ট নন। তাঁদের দাবি, ওই জেল বন্ধ করে দিতে হবে, এবং জেলের দায়িত্বে থাকা আধিকারিককে ‘অপরাধী’ ঘোষণা করে শাস্তি দিতে হবে। এই ঘটনা আমেরিকার জেলব্যবস্থা, জেলে মনোরোগীদের অবস্থা, এবং সামগ্রিক ভাবে জেলবন্দি কালো মানুষের অবস্থা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। সরকারি তথ্য দেখিয়ে মানবাধিকার কর্মীরা দাবি করছেন, আমেরিকার জেলবন্দিদের মধ্যে রয়েছেন অনেক মনোরোগী। কিন্তু তাঁদের চিকিৎসা হয় না। সরকারি পরিসংখ্যানে আরও বলছে যে, জেলে কালো মানুষের সংখ্যা সাদা চামড়ার মানুষের থেকে পাঁচগুণ বেশি, যদিও জনসংখ্যার মাত্র ১৩-১৪ শতাংশ হল কৃষ্ণাঙ্গ।
আমেরিকার এই ঘটনাকে সামনে রেখে দেখা যেতে পারে এ রাজ্যের জেলবন্দিদের অবস্থা। সরকারি পরিসংখ্যান (৩১ মার্চ, ২০২৩) অনুযায়ী এ রাজ্যে জেলবন্দিদের সংখ্যা ২৮,৬৭৩। যদিও রাজ্যের সমস্ত জেল মিলিয়ে বন্দি রাখার ক্ষমতা ২১,৪৭৬— এটাও একই তারিখের সরকারি পরিসংখ্যান। বাস্তবে জেলগুলির ধারণক্ষমতা বড় জোর ১৯ হাজার। সেই জায়গায় ২৯ হাজার বন্দি থাকেন। আলিপুর সেন্ট্রাল জেল বন্ধ হয়েছে, অদূর ভবিষ্যতে বন্ধ হবে প্রেসিডেন্সি ও আলিপুর মহিলা জেল। কী হবে বন্দিদের? উত্তর নেই।
এ রাজ্যের জনসংখ্যার ২৭ শতাংশ মুসলমান। অথচ, জেলে মুসলমান বন্দির সংখ্যা ১০,৭৮৯, অর্থাৎ ৩৭ শতাংশ। মনোরোগী জেলবন্দি আছেন ৩৬২ জন। অথচ, রাজ্যের ৬০টি জেলের কোনওটিতে মানসিক চিকিৎসার ডাক্তার নেই, মোট ডাক্তারের সংখ্যা ২৫ জন। তাঁদের মধ্যে পূর্ণ সময়ের ডাক্তার মাত্র চার জন, বাকিরা আংশিক সময় কাজ করেন। যদিও ষাটটি জেলের জন্য একশো দশটি ডাক্তার পদ মঞ্জুর করা আছে। এ সব তথ্য কারা দফতরের ওয়েবসাইটের।
কিছু দিন আগেই রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু জেলে গরিব ও জনজাতি বন্দিদের সংখ্যা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। জেল থেকে বন্দিদের মুক্তির চেষ্টা করার কথা বলেছিলেন। কেউ খুব একটা কর্ণপাত করেছে বলে মনে হয় না। আমেরিকার এক জন কৃষ্ণাঙ্গ মনোরোগী বন্দির মৃত্যু নিয়ে যে পরিমাণ হইচই হচ্ছে, আমেরিকার জেল নিয়ে যত তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে, তা এ দেশে অভাবনীয়। যে কোনও ঘটনায় এ দেশের সরকার বা আমলাতন্ত্র তথ্য চাপতে এত তৎপর, এবং সংবাদমাধ্যম এ সব তথ্য প্রকাশে এত অনীহা দেখায় যে, অবাক হতে হয়। কয়েক বছর আগে এ রাজ্যের আলিপুর জেল থেকে এক জন মহিলা বন্দি নিখোঁজ হন। তাঁকে আর খুঁজে পাওয়াই গেল না। ২০২১ সালের মার্চ মাসের মাঝামাঝি আলিপুর মহিলা জেলে প্রবল পেটের রোগে বহু বন্দি হাসপাতালে ভর্তি হলেন, এক জনের মৃত্যু হল। কেন এমন ঘটল, জানা গেল না। ২১ মার্চ, ২০২০ দমদম জেলে অন্তত ছ’জন বন্দি পুলিশের গুলিতে মারা গেলেন, অনেকে আহত হলেন। এমন ভয়ানক ঘটনাতেও কারও শাস্তি হল না। বারুইপুর জেলে সাত দিনের মধ্যে চার জন বন্দিকে পিটিয়ে মারার অভিযোগ উঠেছিল গত বছর জুলাইতে। এই ঘটনাতেও এখনও অবধি কারও শাস্তি হয়নি। একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়েছিল, কলকাতা হাই কোর্ট সম্প্রতি সিআইডি তদন্তের আদেশ দিয়েছে।
ছারপোকা, চাম উকুন, উকুন, আরশোলা, বিড়াল এ রাজ্যের জেলেও কম নেই। কে তার খোঁজ নেয়! প্রবল গরমে বদ্ধ কুঠুরিতে কেমন আছেন বন্দিরা, বা বন্দি মনোরোগীরা, যাঁদের হাজার চেষ্টাতেও কুঠুরি থেকে বাইরে আনা যায় না। বারো-তেরো বছর প্যারোলহীন ‘বিচারাধীন বন্দি’ হয়ে জেলে থাকার পর কতটুকু জীবনীশক্তি বা মানসিক তাগিদ থাকে নিজেকে বাঁচানোর! কেউ তো নেই এই মানুষগুলিকে কাউন্সেলিং করার জন্য। আমেরিকার এক জন জেলবন্দির অস্বাভাবিক মৃত্যুতে যে পরিমাণ হইচই হচ্ছে, তার এক ভগ্নাংশও যদি এ দেশে হত, হয়তো এ রাজ্যের জেলবন্দিদের অবস্থা কিছুটা বদলাত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy