দুই পাশে জঙ্গল, মাঝে পিচঢালা মসৃণ কালো রাস্তা। কাঁকড়াঝোড়ের এই রাস্তা ধরে একটু এগিয়ে গেলেই আমঝর্না। সেই ঝর্না অবধি গাড়ির রাস্তা নেই, জঙ্গুলে রাস্তার এক পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে এক কিলোমিটার হাঁটতে হবে।
যাওয়ার পথে গ্রামের রাস্তায় নজরে পড়ল পর পর তিনটে জিনিস। নীল দরজা, পাকা দেওয়ালের মাথায় অ্যাসবেসটসের ছাউনি দেওায়া প্রাথমিক বিদ্যালয়। তার পাশে আর একটা জঙ্গুলে জায়গায় পাকা বাড়ি। দেওয়ালে অ আ ই ইত্যাদি বাংলা হরফ। সবুজ জানালা দরজাওয়ালা বাড়ির মাথায় লেখা আইসিডিএস সেন্টার। মা ও ছোট শিশুর পুষ্টি বিষয়ে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র এই গ্রামেও আছে! ছোটদের স্কুল, অঙ্গনওায়াড়ি কেন্দ্র ইত্যাদি পাশ কাটিয়ে রেলিং ঘেরা শিশু উদ্যান। জলাশয় আর সবুজ গাছের আড়ালে ছোটদের খেলা করার হলুদরঙা ছোট্ট স্লিপ, দোলনা, ঢেঁকি। লকডাউনে ঝোপ ও আগাছার বাড়বাড়ন্ত, কিন্তু গ্রামীণ শিশু উদ্যানের চেহারাটি পরিষ্কার।
কাঁকড়াঝোড়ের অরণ্যে এটি এক মডেল গ্রাম। জঙ্গলে লুকিয়ে আছে আমঝর্না, ময়ূরঝর্না ইত্যাদি হরেক ঝোরা। শুনলাম, বর্ষাকালে এ সব ঝোরায় এক সময় প্রচুর কাঁকড়া পাওয়া যেত। সেখান থেকেই জঙ্গলের নাম কাঁকড়াঝোড়। মডেল গ্রামটিতে রেশন দোকানও আছে। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক লক্ষ্মীকান্ত মুড়া জানালেন, তাঁরা আজকাল নিয়মিত রেশন পান। রেশনে চাল, গম, আটা, কেরোসিন থাকে। মাসে দু’বার চিনি এবং ডালও পাওয়া যায়। ‘‘আগে পুরোটাই অনিয়মিত ছিল। কোনও সপ্তাহে রেশন আসত, কোনও সপ্তাহে আসত না। অনেকের রেশন কার্ড ছিল না, তা নিয়ে প্রশাসনের বাবুদের হেলদোল ছিল না’’, বলছিলেন লক্ষ্মীকান্ত।
গ্রামের নাম আমলাশোল। দেড় দশক আগে, ২০০৪ সালে এই গ্রামই অনাহারে মৃত্যুর কারণে প্রবল ভাবে উঠে এসেছিল সংবাদমাধ্যমে। লক্ষ্মীকান্ত স্মৃতি হাতড়ালেন, ‘‘এখনকার চেহারা দেখে তখনকার গ্রাম কি আর বুঝতে পারবেন, দাদা? তখন এই কাঁকড়াঝোড়ে গাড়ি যাতায়াতের পাকা রাস্তাও ছিল না।’’ এখন বেলপাহাড়ি হয়ে চমৎকার রাস্তা। কাঁকড়াঝোড়ের হোম স্টে-তে বসে শীতসন্ধ্যার নিঝুম হিমেল অন্ধকারে শুনতে পেলাম বাসের হর্ন। চার দিকে ঝিঁঝিপোকার কলতান, তারই মাঝে সন্ধ্যা সাড়ে ছটায় এসে পৌঁছল শেষ বাস। চায়ের দোকানে বসে স্থানীয় কৃষক মনোহর মাহাতো বলছিলেন, ‘‘এখন তো ভাল, কাঁকড়াঝোড় থেকে মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম যাতায়াতের তিনটে বাস। আগে এটুকুও ভাবা যেত না।’’
ভাবা যেত না অনেক কিছুই। সপ্তাহে তিন দিন সোম, বুধ, শুক্র এখন কাঁকড়াঝোড়, আমলাশোলে ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসাকেন্দ্রের গাড়ি আসে। টোল-ফ্রি নম্বরে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স এসে গুরুতর অসুস্থ রোগীকে ওদলচুয়া স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যায়। সেখানে প্রসব এবং অস্ত্রোপচারের বন্দোবস্ত আছে। ডাক্তরবাবু থাকেন? সবাই জানালেন, ‘‘হ্যাঁ।’’ মানেটা পরিষ্কার। পশ্চিমবঙ্গে অনেক কিছু হয়নি বলে আমরা চিৎকার চেঁচামেচি করি। এ বার কাঁকড়াঝোড়, আমলাশোল গিয়ে চার দিকে ইতিউতি দেখে বুঝলাম, অনেক কিছুই হয়েছে। আমরা, শহুরে বাবুরা, খবর রাখি না।
কথা হচ্ছিল ঝাড়গ্রামের বাসিন্দা, সহকর্মী সাংবাদিক কিংশুক গুপ্তের সঙ্গে। আনন্দবাজার পত্রিকায় কিংশুকের খবরের জেরেই সে সময় আমলাশোলে অনাহার মিডিয়ার নজরে আসে। এখনকার কাঁকড়াঝোড়, আমলাশোল নিয়ে তিনিও বিস্ময়াবিষ্ট, ‘‘এখন জায়গাটা নিজেরই অচেনা ঠেকে। মা কী ছিলেন আর কী হইলেন!’’ তখনকার রাজনীতিটাও ফাঁস করলেন তিনি, ‘‘একে তো জায়গাটা তখন দুর্গম, রাস্তাঘাট প্রায় নেই। গ্রাম-পঞ্চায়েত ছিল নরেন হাঁসদার ঝাড়খণ্ড পার্টির, পঞ্চায়েত ও জেলা পরিষদ বামপন্থীদের। ফলে এ দিকের গ্রামগুলিতে কারও নজর পড়ত না, ভাগের মা গঙ্গা পেত না।’’ অবস্থাটা বদলাল কী ভাবে? কিংশুকের অভিজ্ঞতা, মিডিয়ায় হইচইয়ের পর রাস্তাঘাট বাম আমলেই তৈরি হতে থাকে। কিছু মাটির রাস্তায় মোরাম ফেলা হয়, পিচ হয়। পরে গত কয়েক বছরে কাজের গতি অনেক বেড়েছে। রাস্তাঘাট, হাসপাতাল অনেক কিছুতেই।
অনেক কিছুই এখনও বাকি। আমলাশোলের প্রাথমিক শিক্ষক জানালেন, অষ্টম শ্রেণি অবধি পড়ার ব্যবস্থাটুকুই রয়েছে। তার পর ওদলচুয়া বা বাঁশপাহাড়ির স্কুল থেকে মাধ্যমিক। অতঃপর শিলদায় কলেজ। শিলদা নামটা বাঙালির মনে থাকতে পারে। মাওবাদী বিশৃঙ্খলার সময় সেখানে থানা থেকে বন্দুক লুট হয়েছিল। সেই আন্দোলন ও কিষেণজিখ্যাত লালগড়েও ২০১৪ সালে একটি সরকারি কলেজ হয়েছে। স্কুল, কলেজের হিসেবটা অবশ্য চটকে গেল সকালবেলায় জঙ্গলের পথে এক বালককে দেখে। ধুলোমাখা চুল, পরনে ছেঁড়া হাফপ্যান্ট, শতচ্ছিন্ন সোয়েটার। তার নাম রবি শূদ্র। স্কুলে যাস? প্রশ্নের উত্তরে জবাব, ‘‘স্কুল বন্ধ।’’ মা নেই, বাবা বাঁশপাহাড়ির দোকানে রান্নার কাজ করেন। বাড়িতে আরও ছোট দুই বোন, রবি জঙ্গলের রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, কাঠকুটো কুড়োয় আর টুরিস্ট দেখলে দু’চার টাকা চায়। অনলাইনে ক্লাস হয় কি না গোছের বাতুল সাংবাদিকী প্রশ্নটি করার সাহস ছিল না। কাঁকড়াঝোড়ে ঢোকার পর জিয়ো ছাড়া অন্য মোবাইল কাজ করে না। সকলের ফোনেই জিয়ো সিম। টালির চালে এক মাটির বাড়ির দেওয়ালে লেখা ‘ডিজিটাল সেবা, ই-গভর্ন্যান্স’। সেই একই মাটির দেওয়ালে আর একটি নোটিস, ‘জিয়ো পরিষেবা কেন্দ্র। এখানে জিয়ো রিচার্জ ও জিয়ো সিম কার্ড পাওয়া যায়।’
সেই শূদ্র বালকের সঙ্গে এক বিকেলে কাঁকড়াঝোড়ের হাটে গিয়ে চমকে গেলাম। ব্যাটারিচালিত মাইকে কেউ জানাচ্ছে, ‘আর পাবেন না, নিয়ে যান।’ বিক্রি হচ্ছে সস্তার সোয়েটার, জ্যাকেট, ছাপা শাড়ি, কাচের চুড়ি আর মেয়েদের টিপ। রাস্তার দু’পাশে উপচে পড়ছে তাজা ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলো, পালং শাক, কুমড়ো, বেগুন। কোথাও কোথাও ফুলকপির পাতা আমাদের পালং শাকের মতো বান্ডিল করে রাখা। ওটাও হাটুরেরা কিনে নিয়ে যায়। এক দিকে কয়েক রকম শুঁটকি মাছ। হাটে গ্রামের লোক আছে, আর আছে সিআরপিএফ জওয়ানরা। মাওবাদী হামলায় কয়েক বছর আগে কাঁকড়াঝোড়ের সরকারি গেস্ট হাউসটি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর থেকেই সেই পরিত্যক্ত বাড়িতে সঙ্গিন-উঁচানো জওয়ানদের শিবির। সকালবেলায় তাঁরা আমাদের গাড়ির নম্বরও লিখে রেখেছিলেন। এখন বিকেলের আলো। সেই জওয়ানরাই বস্তা ভরে টাটকা সব্জি কিনতে এসেছেন। আমার হতভম্ব দৃষ্টি দেখে রবি জানাল, ‘‘এ আর কী দেখছেন? সোমবার ঝাড়খণ্ডের গোধূরিয়ায় এর থেকেও বড় হাট।’’ প্রাথমিক শিক্ষক লক্ষ্মীবাবু জানালেন, তাঁর জমিতে এখন ধান ছাড়াও বেগুন, টমেটো ইত্যাদি চাষ হয়। আগে সেচের ব্যবস্থা ছিল না, এখন ‘জল ধরো, জল ভরো’র কল্যাণে জঙ্গলের পুকুর এবং ছোট বাঁধেও জল থাকে। ঝাড়খণ্ডের হাটটি এখান থেকে মাত্র সাত কিমি দূরে, চাষিরা বেশির ভাগ ফসল সে দিকেই পাঠান। রাস্তা ভাল হওয়ায় সেই রাজ্যের পাইকাররাও এখানে অক্লেশে সব্জি কিনতে আসে। কাঁকড়াঝোড়ের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটা মোটর-রাস্তার নামই ঘাটশিলা রোড। রোডসাইন দূরত্বও জানায়: ২০ কিমি। রোজ সেই জঙ্গলে হাঁটতে হাঁটতে ভাবতাম, বিভূতিভূষণ কি এখান দিয়েই হাঁটতেন!
শহর থেকে দূরে কাঁকড়াঝোড়ের জঙ্গল এখন একটি বিষয়ের নীরব প্রস্তুতিতে। ইকো টুরিজ়ম! আমি যে রিসর্টে ছিলাম, তার আশপাশেই বিভিন্ন জায়গায় তৈরি হচ্ছে আরও চার-পাঁচটি রিসর্ট। রোজই শুনতে পেতাম কাঠ চেরাই আর ড্রিলিং মেশিনের সশব্দ আর্তনাদ, ছেনি হাতুড়ির ঠকাঠক। স্থানীয় যুবক ঠাকুর মাহাতো রোজ এক ফাঁকা জমিতে বেলচা কোপায়, ঘাড়ে করে নিয়ে যায় জলের পাইপ এবং অনেক কিছু। জমিটা ঠাকুরের, কলকাতার এক সংস্থা ওখানে রিসর্ট তৈরি করবে। প্রদীপ মাহাতো বলছিলেন, ‘‘আগে তো লোকে ভয়ে এ দিকে আসতেন না। এখন অবস্থা পাল্টেছে। যত বেশি পর্যটক আসবেন, এলাকাটা ততই ভাল হবে।’’
অনাহারের দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে কাঁকড়াঝোড়, আমলাশোল এখন সেই ভালর জন্য দিন গোনে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy