Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Pakistan

আবার সেনার লৌহকবলে

পাকিস্তানে এখন ক্ষমতায় আছে সেনাবাহিনীর মদতে পুষ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সাধারণ নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা, এবং নতুন সরকার দায়িত্ব না নেওয়া পর্যন্ত অর্থনীতিতে স্থিতাবস্থা বজায় রাখাই তার কাজ।

—ফাইল চিত্র।

প্রণয় শর্মা
শেষ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৫:২০
Share: Save:

গত কয়েক সপ্তাহে সেনাবাহিনী আবারও পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিসরে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে। ইমরান খান ইতিমধ্যেই কারারুদ্ধ হয়েছেন, তাঁর নির্বাচনে যোগদানও নিষিদ্ধ। তাঁর দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)-কেও ধাপে ধাপে ছত্রভঙ্গ করা হয়েছে। অধিকাংশ শীর্ষস্থানীয় নেতাকে হয় দল ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে, নয়তো সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নিতে হয়েছে।

পাকিস্তানে এখন ক্ষমতায় আছে সেনাবাহিনীর মদতে পুষ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সাধারণ নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা, এবং নতুন সরকার দায়িত্ব না নেওয়া পর্যন্ত অর্থনীতিতে স্থিতাবস্থা বজায় রাখাই তার কাজ। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বর্তমান সরকার অর্থনীতির হাল ফেরাতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সংস্কার করতেও সচেষ্ট। কিন্তু সেখানেই না থেমে বিদেশি বিনিয়োগ আনার লক্ষ্যে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো সংস্কারেও হাত দিয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। দেশের মানুষকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে যে, আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে পাকিস্তানে অতিরিক্ত বিদেশি বিনিয়োগ হতে পারে ৭৫ বিলিয়ন থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলার। ইতিমধ্যেই বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের সংস্কারের কাজ শুরু করেছে, বিল বকেয়া-রাখা সংস্থাদের শাস্তি দিতে উদ্যত হয়েছে।

তবে কি সাধারণ নির্বাচন পিছিয়ে যাবে? পাকিস্তানের ইলেকশন কমিশনের নির্দেশ, নির্বাচন করতে হবে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে। কিন্তু নির্বাচন কি অস্থিরতা কমাতে পারবে? পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনী বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ— জন্মলগ্ন থেকে এ পর্যন্ত অর্ধেক সময়েই পাকিস্তান দেশটি সেনাবাহিনীর শাসনাধীন থেকেছে। বাকি সময় অসামরিক সরকার থাকলেও, তা কার্যত সেনার মদতেই অস্তিত্ব বজায় রেখেছে।

সেনাবাহিনীর উপরমহলের একাংশের মদতেই ইমরান খান প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসেছিলেন। তার আগে নওয়াজ় শরিফ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। শরিফ যে ভাবে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিজের স্বাধীন সত্তা জাহির করতে শুরু করেন এবং ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেন, তা সেনাবাহিনীর পক্ষে অস্বস্তিকর হয়ে পড়ছিল। তাই শরিফের বদলে সেনাবাহিনী ইমরানের দিকে ঝুঁকে পড়ে।

অক্সফোর্ড-শিক্ষিত ক্রিকেট তারকা ইমরান দুর্নীতির সংস্কৃতিকে সাফ করবেন, ‘নয়া-পাকিস্তান’ গড়বেন, এমনই আশা ছিল। কিন্তু ইমরান রাজনীতিকে দুর্নীতিমুক্ত করতে ব্যর্থ হন এবং আমেরিকার সঙ্গে পুরনো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পুনরুদ্ধারও করতে পারেন না। আমেরিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর কাছে অত্যন্ত জরুরি, কারণ ভারতের সেনাবাহিনীর সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য পাকিস্তান দীর্ঘ দিন ধরেই অত্যাধুনিক আমেরিকান সমরাস্ত্র সরবরাহের উপর নির্ভরশীল। বর্তমানে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর জন্য সবচেয়ে বেশি সমরাস্ত্র আসে চিন থেকে। কিন্তু পাক সেনাকর্তারা এখনও মনে করেন, চিনা অস্ত্র দিয়ে ভারতের মোকাবিলা করাটা সহজ হবে না।

পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় যখন আমেরিকা পাকিস্তানকে সমরাস্ত্র দিতে বেঁকে বসে, এবং ভারতকে অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্র দিতে শুরু করে। এর জেরে দুই দেশের সামরিক শক্তির মধ্যে ব্যবধান আরও বাড়তে থাকে। পাক সেনাবাহিনীর শীর্ষকর্তারা ইমরানের উপর আরও অসন্তুষ্ট, কারণ, তাঁদের মতে, প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সেনার নিজস্ব বিষয়ে নাক গলাতে শুরু করেন।

২০২২ সালের এপ্রিলে অনাস্থা ভোটে হেরে ইমরানকে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয় ঠিকই, কিন্তু তার পরেও ইমরানের জনসভায় বিশাল জনসমাগম হতে থাকে। একের পর এক জনসভায় ইমরান সেনাকে সরাসরি আক্রমণ করে বলতে থাকেন যে তিনি আমেরিকার নীতির সমালোচনা করছিলেন বলেই আমেরিকার অঙ্গুলিহেলনে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সমালোচনার সুর কড়া হল ২০২২ সালের নভেম্বর জেনারেল আসিম মুনির পাক সেনাপ্রধানের পদে আসীন হওয়ার পর। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন এই জেনারেলকে আইএসআই প্রধানের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে ইমরান বরখাস্ত করেছিলেন। জেনারেল মুনির এমনিতে পাদপ্রদীপের আলোয় বেশি আসেন না। কিন্তু ৯ মে ইমরান গ্রেফতার হওয়ার পর দলীয় কর্মীদের সেনাবাহিনীর অফিস-বাড়ি আক্রান্ত হলে পাক সেনা আর চুপ করে বসে থাকতে পারল না। কিছু সেনা অফিসারকে বরখাস্ত করা হল, আর ব্যাপক হারে পিটিআই কর্মীদের গ্রেফতার করা হল। একই সঙ্গে পূর্বতন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ় শরিফকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রয়াস শুরু হল। ২০১৮ সালে ইমরানকে ক্ষমতায় আনার সময় শরিফকে ক্ষমতাচ্যুত করে জেলে পোরা হয়েছিল। শরিফকে কার্যত নির্বাসনে যেতে হয়।

অতএব রাজনীতি থেকে ইমরান খানকে বাদ দিয়ে চলার জন্য পাক সেনাবাহিনী যে কৌশল নিয়েছে, তা কার্যকর হতেও পারে। যদিও দেশের জনপ্রিয়তম রাজনৈতিক নেতাকে দূরে সরিয়ে রেখে নির্বাচন করলে তা দেশবাসীর কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য হবে, বা আন্তর্জাতিক মহলের কাছে কতটা স্বীকৃতি পাবে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। শেষ কথা, অন্তত তিন জন পাক প্রধানমন্ত্রীর নাম করা যায় যাঁরা জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বা নির্বাসন থেকে রাজনীতিতে পুরোদমে ফিরে আসতে পেরেছিলেন— হোসেন সুরাবর্দি, জ়ুলফিকার আলি ভুট্টো এবং বেনজ়ির ভুট্টো। ইমরান খান কী করবেন?

অন্য বিষয়গুলি:

Pakistan Imran Khan Shahbaz Sharif
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy