সুর-সহচর: দিলীপকুমার রায় ও নিশিকান্ত রায়চৌধুরী।
আগামী বছর, ২০২৩ সালে, পূর্ণ হবে কবি ও গীতিকার নিশিকান্ত রায়চৌধুরীর প্রয়াণের পঞ্চাশ বছর। কিন্তু আদৌ কেন তাঁকে মনে করা? তাঁর কবিতা নিয়ে সামান্য আলোচনা হয়েছে, সঙ্কলন তৈরি হয়েছে, সম্প্রতি সমগ্র কবিতা সঙ্কলনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজও হয়েছে। কিন্তু তিনি তো কেবল কবি নন, গীতিকারও। নিশিকান্তের সেই ভূমিকাটি বুঝতে চাওয়ার মতো কাজ খুবই বিচ্ছিন্ন। মজার ব্যাপার, যে সব লেখালিখিতে তাঁর গীতিকার সত্তার প্রসঙ্গ এসেছে, তার প্রায় সবই প্রকৃত বিষয় দিলীপকুমার রায়— যাতে প্রসঙ্গক্রমে নিশিকান্তের ভূমিকার জায়গাটা এসে পড়েছে। সেটা যথেষ্ট কি না, আমাদেরই ভেবে দেখতে হবে।
এটা ঠিকই যে, দিলীপকুমার রায়ের সুরের, ছন্দের প্রভাবে একদা নিশিকান্তের গান লেখার সূচনা। ১৯৩০-এর দশকে পন্ডিচেরির (অধুনা পুদুচেরি) অরবিন্দ আশ্রমে প্রথম মুখোমুখি হন দুই জন। জানা যায়, সে সময় দিলীপকুমার রায় নাকি তাঁকে একটা কথা বলতেন: “আসুন নিশিকান্তবাবু, আমরা দু’জনে কাব্য ও সঙ্গীতের জুড়িগাড়ি চালাই। আপনি কথা দিয়ে মালা গাঁথুন, আমি সুর দিয়ে তা দোলাব।”
অরবিন্দের আকর্ষণে শান্তিনিকেতন থেকে খানিকটা আচমকাই নিশিকান্ত পন্ডিচেরি আসেন ১৯৩৩ সালে। শান্তিনিকেতনে এ তাঁর দ্বিতীয় দফা। ১৯০৯ সালে জন্ম। অগ্রজ সুধাকান্ত রায়চৌধুরীর সুবাদে, ১৯১৪ সালে তাঁর প্রথম শান্তিনিকেতন আসা। কর্মসূত্রে সুধাকান্তকে যেতে হয় সিউড়ি, নিশিকান্তও অনুগামী হন। সিউড়িতে থাকাকালেই হঠাৎ এক দিন বাড়ি থেকে পালিয়ে কাটোয়ায় বৈষ্ণব আখড়ায় চলে যান তিনি।
১৯২৭ থেকে দ্বিতীয় দফার শান্তিনিকেতন পর্বে নিশিকান্ত কলাভবনের ছাত্র ছিলেন। তাঁর ছবির কাজ পছন্দ করতেন রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ। কৈশোর থেকে কবিতা লেখেন, যাতে আগ্রহ ছিল রবীন্দ্রনাথের। জানা যায়, এক বার তাঁর কিশোরবেলায় লেখা কিছু কবিতার এক খাতা পড়বার জন্য তিনি চেয়েও নেন। রবীন্দ্রনাথ আদর করে তাঁকে ডাকতেন ‘চাঁদ কবি’ নামে। সমকালে বিচিত্রায় নিশিকান্তের ‘টুক্রির কবিতা’ প্রকাশিত হয়। এই সময়েও নিশিকান্ত কিছু গান লেখেন, নিছকই মজাচ্ছলে, চার পাশের ঘটনা নিয়ে— অপূর্ব তার ভাব ও ভাষা। বন্ধুরা সদলে গাইতেন সেগুলি।
১৯৩৭ সালে দিলীপকুমার রায় পন্ডিচেরি থেকে কলকাতা আসেন গান গাইতে। বছরখানেক থাকেন। সেই সময়ে একের পর এক রেকর্ডে গেয়ে যান নিশিকান্তের গান। দ্বিতীয় রেকর্ডে শুরু হয় ‘এই পৃথিবীর পথের পরে’ এবং ‘জ্বলবার মন্ত্র দিলে মোরে’ দিয়ে। ১৯৩৯ সালে গান, ‘পূজা আমার সাঙ্গ হল’, পরের বছর ওঁর শিষ্যা উমা বসুকে দিয়ে গাওয়ান ‘রূপে বর্ণে ছন্দে’। ১৯৪২ সালে আবার নিজে গান, ‘সখী দিয়ো না দিয়ো না’। ওই বছরই ফিরে যান পন্ডিচেরি। ১৯৩৭-৪২: এই ছয়টি বছর, কলকাতাকে কেন্দ্র করে দিলীপকুমারের গান বাঙালি শ্রোতার মনে এক অন্য আবেগের খবর এনে দেয়।
মনে রাখতে হবে, সেই উনিশশো ত্রিশের দশকে, কলকাতা তথা বৃহত্তর বঙ্গসমাজে, বাংলা গান নিয়ে উদ্দীপনা এবং উত্তেজনা তুঙ্গে। নতুন শ্রোতৃসমাজ, তাদের চাহিদাও বিপুল। রেকর্ড, সিনেমা এবং বেতার সম্প্রচারের তাগিদে দরকার হয়ে পড়ছে বিপুলসংখ্যক গানের। একেবারেই অর্থনীতির চাহিদা-জোগানের নিয়ম মেনেই যেন সেই সংখ্যায় পৌঁছনোর চেষ্টা। উপরন্তু, ত্রিশের দশকে, বিভিন্ন কোম্পানির প্রতিযোগিতার দরুন, ৭৮ ঘূর্ণনের রেকর্ডের দাম কমেছে, তা মধ্যবিত্ত সমাজের ক্রয়ক্ষমতার আওতায় এসেছে। যোগ হয়েছে ক্রেতাদের পছন্দ-অপছন্দও, তাঁদের বিচিত্র আবদার। বাংলা গানের নেপথ্য কারিগররা অবশ্য তত দিনে নিজেদের সৃষ্টিতে এই জায়গাগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করার কৌশল শিখে গেছেন। নজরুলের আগে পর্যন্ত, রবীন্দ্রনাথ থেকে দিলীপকুমার, এঁদের কাউকে অর্ডারি গান লিখতে হয়নি কোনও দিন। কারণ তখনও পর্যন্ত এঁদের কেবল শ্রোতা ছিল— ক্রেতা নয়। ক্রমশ নজরুলের সময় পেরিয়ে, সুবোধ পুরকায়স্থ, শৈলেন রায়, অজয় ভট্টাচার্যদের সময়ে ঢুকে পড়ছি আমরা। তাঁদের গানে তখনও নজরুল আচ্ছন্নতা লেগে— ভাষায়, চিত্রকল্পে। ফুল, মালা, চাঁদ, সমাধি, অথবা বালুচর— এর মধ্যে কোন শব্দটা যে ছিল বাংলা গানে সবচেয়ে বড় অবসেশন, সেটা বলা আজ মুশকিল। তবে ঠাট্টাটা তো ফিরে ফিরেই এসেছে। তাত্ত্বিকরা মনে করেন, দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে, সামাজিক ভারসাম্যহীনতা ও নৈরাশ্যের ঘায়ে, বাঙালির গানের পথভ্রষ্ট প্রেম আসলে এক পলায়নি প্রসঙ্গ। শুধু তা-ই নয়, সে দিনের বাংলা গানের চিত্রকল্প, শব্দ, এ সবেও তাঁরা অপকৃষ্ট উপকরণ ব্যবহারের নজির খুঁজে পান। অভিযোগ ওঠে, সমাজ-সচেতনতার প্রশ্নে বাংলা গান সে দিন সাড়া দেয়নি। প্রসঙ্গত, গণসঙ্গীতের জায়গাটা তখনও তৈরি হয়ে ওঠেনি।
মনে হতেই পারে, নিশিকান্ত প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ এ সব কথাই বা কেন! এর মানে কি তবে এই যে, নিশিকান্তের গানে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল এই সমাজ-সচেতনতার জায়গাটা? আদপেই নয়। সে প্রাক্ বা উত্তর-গণসঙ্গীত পর্ব, কোনও সময়েই নয়। বরং তিনি যে যাবতীয় হাটের কেনাবেচার বাইরে, অন্য প্রত্যয়ে, তাঁকে গানে গানে এ কথা বলতে দেখা গিয়েছে। তত দিনে এক কর্মনাশা গানের ভ্রমর তাঁর মর্মে বাসা বেঁধেছে। তবে, পন্ডিচেরি আশ্রমে, অরবিন্দের আশ্রয়ে, যোগজীবন কাটানোর সময়ে, এই সব গানে নিজেকে চেনার, নিজেকে জানতে চাওয়ার যে ধরন— সমকালীন বাংলা গানের পাশাপাশি রেখে ভাবলে, তা এক ভিন্ন ধারা।
“এই বেদনাবিলাসী, পুষ্পবিধুর বাংলা গানে…অন্য ভাবনা আর বলার ভঙ্গীর একটা আলাদা ধারা আনেন প্রেমেন্দ্র মিত্র ও নিশিকান্ত”: ১৯৮৭ সালে এ কথা লেখেন সুধীর চক্রবর্তী। প্রসঙ্গত মনে করিয়ে দেন নিশিকান্তের ‘জ্বেলেছি জীবন দিয়ে মরণ-কালো বিভাবরী’র মতো লাইন। কিন্তু সুধীর চক্রবর্তীর এই ভাবনাটা নিয়ে বাংলা গানের জগতে আর তেমন নাড়াচাড়া হল না। ২০০১ সালে তিনিই অন্যত্র লেখেন, নিশিকান্তের লেখনীতে ভক্তিগীতির এক স্বতন্ত্র স্বাদ যে পাচ্ছেন, সেই কথা। ক্রমশ যেন এক দিকে পন্ডিচেরি, অরবিন্দ আশ্রম, আর অন্য দিকে লেখনীতে পরিচিত কোনও সমাজ-সচেতনতার ছাপ না থাকার ফলে ওঁর গানগুলির গায়ে একটা ভক্তির তকমা লেগে যেতে শুরু করে। নির্বিচারে তাঁর সব গান পড়ে গেল ভক্তির খোপে। ভক্তির বাইরে গিয়ে তাঁর বয়ানের মিস্টিক বিন্যাসের জায়গাটা ভেবে দেখার শ্রম আর স্বীকার করতে হল না।
অথচ এই মিস্টিক ধারার পাশাপাশি কত অন্য রকম গানও লিখেছেন নিশিকান্ত। শান্তিনিকেতনে লিখেছিলেন, ‘এ সংসারে কখন কী হয় যায় না বলা, সুখে থাকতে ভূতে কিলোয় আর দুঃখে থাকলে আরও জ্বালা’! কিংবা, ‘খাবো না খাবো না খাবো না লুচি, লুচি খাওয়া মোর গিয়েছে ঘুচি, গলদা চিংড়ি ভাজিয়া রাখে, দেখে চোখে জল কেমনে থাকে’! এই রসবোধ, সৌন্দর্যবোধ, সঙ্গে লীলাবাদ, আত্মজিজ্ঞাসা— সবটুকু ঐতিহ্যকে যদি নিজের সময়ের নিরিখে বাংলা গান ভাবনায়, বয়ানে বুনে নিতে পারত, তবে কেমন হত!
নিশিকান্তের জীবনী, গানগুলির কালানুক্রম বা তাদের স্বরলিপির প্রাথমিক রূপ, প্রায় কিছুই নেই। অন্যান্য দেশে সুর ও সুরকারদের নিয়ে গবেষণার চলটা অনেক বেশি। শোনা যায়, বাখের মৃত্যুর চল্লিশ বছর পর ব্যারন ভন সুইটেন বাখের বিস্মৃত অনেক রচনা উদ্ধার করেন। মৃত্যুর বাহান্ন বছর পর ফরকেল তাঁর জীবনী লেখেন। আমাদেরও মনে রাখা উচিত, আমাদের সুরকার-গীতিকারদের মধ্যে বিধৃত আছে আমাদেরই ইতিহাস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy