আজ দু’টি রুটে গোটা পনেরো ট্রাম রোজ চলে কি না সন্দেহ। ফাইল চিত্র।
কলকাতায় ট্রাম চলার দেড়শো বছর পূর্তি উৎসব উদ্বোধনে পরিবহণমন্ত্রী কার্যত ট্রামের মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছেন। মুখে বলেছেন যে ট্রামকে ফেয়ারওয়েল দিতে আসেননি, কিন্তু তাঁর কথার মর্মার্থ হল— কলকাতায় আগামী দিনে ট্রাম; ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল বা শহিদ মিনারের মতো স্রেফ একটি ঐতিহ্যশালী দ্রষ্টব্য হয়ে থাকবে। এক সময় যে শহরে প্রায় পঞ্চাশটি রুটে চারশোর কাছাকাছি ট্রাম চলত; এক দশক আগেও পঁয়ত্রিশটির উপর রুটে প্রায় পৌনে দু’শো; সেখানে আজ দু’টি রুটে গোটা পনেরো ট্রাম রোজ চলে কি না সন্দেহ, আর ডিপোগুলিতে পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা প্রায় আড়াইশো ট্রাম।
কেন? পরিবহণমন্ত্রী জানিয়েছেন, কলকাতার মতো অল্প পরিমাণ রাস্তার শহরে স্বল্প গতির ট্রাম মানেই যানজট। ফলে ট্রাম হটাও, গতি লাও। একই মতের শরিক ছিলেন বাম আমলের পরিবহণমন্ত্রীরাও, বেশ কিছু সরকারি আধিকারিক বিশেষ করে পুলিশের কর্তাব্যক্তিও। কতটা সারবত্তা এই যুক্তিতে? সারা পৃথিবী জুড়ে বর্তমানে প্রায় চারশো শহরে ট্রাম রয়েছে, সংখ্যাটা ক্রমেই বাড়ছে। এর কারণ, ঐতিহ্য নয়, পরিবেশ।
আরও একটা কথা। ট্রাম এক সঙ্গে যত মানুষকে বয়ে নিয়ে যেতে পারে, ট্রেন বা মেট্রো ছাড়া এমন ক্ষমতা কোনও গণপরিবহণের নেই। এবং পাশাপাশি নির্দিষ্ট লাইন ধরে যাওয়ার ফলে ট্রামের কারণে যানজট হওয়ার কথা নয়। গবেষণা জানাচ্ছে যে, কলকাতা শহরেও ট্রাম থাকা আর না থাকা রাস্তায় হওয়া যানজটের মধ্যে কোনও তারতম্য নেই; ইচ্ছেমতো রাস্তা জুড়ে হকার বসা, যেখানে সেখানে পার্কিং; অটো, বাস, প্রাইভেট গাড়ির দৌরাত্ম্যের কারণেই যানগতি মন্থর হয়। উল্টো দিকে প্রশ্ন, সল্ট লেক বা নিউ টাউনে যথেষ্ট জায়গা থাকা সত্ত্বেও কেন ট্রাম চালানোর পরিকল্পনা করা হয়নি? এই বায়ুদূষণ আর জলবায়ু পরিবর্তনের সময় সারা বিশ্ব জুড়ে বৈদ্যুতিক যানের রমরমা বাড়ছে এবং সেখানে ট্রাম সামনের সারিতে। কলকাতাতেই শুধু উলটপুরাণ?
সারা পৃথিবীতে গণপরিবহণ, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার মতো সামাজিক সুরক্ষার সঙ্গে যুক্ত বিষয়গুলি সরকারি অনুদান পায়। ফলে পশ্চিমবঙ্গে ট্রামের আর্থিক অনুদান পাওয়াটা ব্যতিক্রমী নয়। পাশাপাশি যখন কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারকে ট্রামের জন্য আর্থিক সাহায্য পাওয়ার জন্য প্রস্তাব দিতে বলে, তখন রাজ্যের আধিকারিকরা তাতে আদৌ উৎসাহ দেখাননি! আসলে ট্রাম বকলমে তুলে দেওয়া বা নৈবেদ্যর চূড়ার মতো ‘হেরিটেজ’ বানিয়ে রাখার পিছনে কায়েমি স্বার্থ কাজ করে। ট্রামের জীবনকাল অনেক বড়; ফলে চটজলদি ট্রাম কেনাবেচা করে বেআইনি ব্যবসায়িক লাভ করা যায় না। অভিযোগ ওঠে, এই কারণেই ট্রাম কোম্পানিকে দিয়ে বাস চালানো শুরু। এখন বামপন্থীরা ‘ট্রাম বাঁচাও’ পোস্টার সাঁটালেও বাম পরিবহণমন্ত্রীরাই কলকাতা থেকে ট্রাম তোলার কাজ শুরু করেন, এবং দুর্জনেরা বলেন, তার পিছনে রয়েছে সারা শহর জুড়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় থাকা ট্রাম ডিপোগুলির জমি বিক্রি করে কয়েক হাজার কোটি টাকা আয় করা। তৃণমূল সরকার এ ক্ষেত্রে নীতি বদলায়নি এবং বেশ কয়েকটি ডিপোয় ইতিমধ্যেই সে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত।
এটা যদি না হত, তা হলে ট্রাম রাখা উচিত কি না, সেটা বিশেষজ্ঞদের মত অনুযায়ী ঠিক হত, কিছু রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী, আধিকারিকের ইচ্ছায় নয়। হয়তো সরকার বিশেষজ্ঞদের প্রস্তাব মেনে ট্রামকে মেট্রো স্টেশনদের সঙ্গে যুক্ত করার কথাও ভাবত। যে-হেতু এই পরিবেশ চর্চার যুগে ট্রামকে এক কথায় তুলে দেওয়া কঠিন, তাই প্রয়োগ হচ্ছে পরোক্ষ পরিকল্পনা। লাভজনক রুট থেকে ট্রাম তুলে দাও, সংখ্যা কমাও ও অনিয়মিত করো, ট্রামের জন্য নির্দিষ্ট গতিপথ ভেঙেচুরে রাস্তার সঙ্গে মিলিয়ে দাও, মাঝরাস্তায় স্টপ তৈরি করো, যাতে মানুষ উঠতে না পারেন। এর ফলে তৈরি হবে ‘মাল্টিপ্লায়ার এফেক্ট’, যত কম মানুষ ট্রামে উঠবেন, যত কম ট্রাম চলবে, আরও রুট কমানো আরও ট্রাম কমানো চলবে, যত ক্ষণ না এই ভাবে শহরের গোটা ট্রামব্যবস্থার ‘স্বাভাবিক’ মৃত্যু হয়। পরিকল্পনা সফল, কেননা গত এক দশকে রাস্তায় চালু ট্রামের সংখ্যা আর ট্রামে ওঠা মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে। দ্বিচারিতা কতটা, তা স্পষ্ট হয় যখন দেখা যায় যে, ‘ন্যাশনাল ক্লিন এয়ার প্রোগ্রাম’ থেকে কয়েকশো কোটি টাকা পেতে আরও বেশি করে ট্রাম চালানোর অঙ্গীকার করেছে রাজ্য সরকার।
শহরে আবার ট্রাম ফিরে এলে শুধু শহরটাই বাঁচবে তা নয়; এই পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের সময় দাঁড়িয়ে এক জন আধুনিক রাজনৈতিক নেতা হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ খানিকটা পরিচিতি পাবেন। তুরস্কের বিখ্যাত লেখক নাট্যকার মহমত মুরাত ইলদান লিখেছিলেন, যে শহরে ট্রাম নেই সেই শহরকে কম শিক্ষিত, কম কাব্যিক লাগে। এই শহরের বুদ্ধিজীবীরা কি শুনছেন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy