মেলানো-মেশানো পদ্ধতিতে পড়ানোর ক্লাসরুম। সদ্য কলেজে ভর্তি হওয়া ছাত্রীদের কিছু অংশ ক্লাসে বসে, বাকিরা যন্ত্রের পর্দায়। ক্লাসে থাকা এবং ল্যাপটপের পর্দায় থাকা ছাত্রীরা একই সঙ্গে দেখতে-শুনতে পায় এমন নির্দিষ্ট কৌণিক বিন্দুর সন্ধানে নাজেহাল, এমন সময় ক্লাসরুমে বেশ ক’টি হাত উঁচু। কী ব্যাপার? “ম্যাম, যা বোঝালেন, আরও এক বার বলবেন— মানে, বাংলায়।” ল্যাপটপের ও ধার থেকেও ক’জন সায় দিল।
এই সমস্যা ঠিক এই বছরের নয়। কোনও একটি কলেজ বা একটি ক্লাসরুমেরও নয়। নামী বেসরকারি ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানে অনেক কষ্টে পয়সা জোগাড় করে পড়তে আসা মেধাবী ছাত্রটিরও একই সমস্যা। সমস্যা ইংরেজি ভাষায়। অনেক চেষ্টা করেও এদের জন্য দ্বিভাষিক প্রশ্নপত্র বা বাংলায় উত্তর লেখার অধিকার পাওয়া যায়নি। কর্তৃপক্ষের যুক্তি, ভাল চাকরি পেতে ইংরেজি বলতে জানতেই হবে। তাড়াতাড়ি শিখে নেওয়াই ভাল।
সরকারি প্রতিষ্ঠানে এই জোরাজুরি নেই। ছাত্রছাত্রীদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আছে বিষয়টি বাংলায় লেখার। প্রশ্নপত্রও অধিকাংশ ক্ষেত্রে দু’ভাষায় হয়। কিন্তু তার মধ্যেও কোনও শিক্ষক যদি অর্থনীতি, ইতিহাস বা অন্য বিষয় শিখতে চাওয়া পড়ুয়াকে মনে করিয়ে দিতে চান যে, একটি বিদেশি ভাষা কম জানে বলে সে অনেকটা পিছিয়ে আছে, আবারও সেই যুক্তি ঘুরেফিরে আসবে। এ হল ইংরেজি। যে ভাষা ছাড়া আমাদের সব দফতরি কাজ অচল। তুমি ছাত্রছাত্রীকে ইংরেজি পড়তে জোর দিচ্ছ না বা ইংরেজিতে পড়াচ্ছ না কেন, তার কয়েকটি কারণ থাকতে পারে। এক, তুমি শিক্ষক হিসাবে ইংরেজিতে তত দড় নও। ছাত্রটির মতোই বিষয়টি জানলেও, ইংরেজি ব্যাকরণে অমার্জনীয় ভুল হতে পারে।
যে ছাত্রছাত্রী বা শিক্ষক যথেষ্ট ইংরেজি জানেন না, অথচ নামী প্রতিষ্ঠানে পড়ার বা পড়ানোর সুযোগ পেয়েছেন, তাঁদের ইংরেজি বা কোনও ভাষা কম জানাই আলাদা করে বিচার্য হতে পারে না। ভার্নাকুলার মিডিয়ামে শিক্ষিত হওয়া ছাত্রটির অপরাধ নয়, বা সেই সিদ্ধান্তের দায়ও তার নয়। সেই শিক্ষক বা ছাত্রটির বাবা-মা আদর্শগত বা আর্থিক কারণে মনে করেছেন, বাংলা বা আঞ্চলিক মাধ্যমে পড়েও ছেলেমেয়ে ভাল করবে। অসংখ্য দৃষ্টান্তও আছে তাঁদের সমর্থনে। বিখ্যাত বেসরকারি সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা থেকে ইসরো-র নবীন বিজ্ঞানী, সকলেই পড়েছেন তাঁদের রাজ্যের আঞ্চলিক ভাষায়। ২০২১-এর জয়েন্ট প্রবেশিকা পরীক্ষায় মেধা তালিকার ৬০% ছাত্রছাত্রী ছিল বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়ের।
আমার সন্তান এমনই হবে, অন্যের থেকে আলাদা— ভাবার সাহস করতেন সে যুগের অভিভাবকেরা। আমরা পারি না। নিজেদের মতো সন্তানকেও বাজারের শর্তে সমর্পণ করে নিশ্চিন্ত থাকতে ভালবাসি। এখনও যে অভিভাবকেরা অন্য রকম ভাবার সাহস দেখান, তাঁদের ছোট করার অধিকার কোনও কর্তৃপক্ষের নেই। আর ভাষাবিজ্ঞানও এই সাহসের সমর্থনে কথা বলে। নোম চমস্কি ও উইলিয়াম লাবোভ, ‘ভার্নাকুলার ল্যাঙ্গোয়েজ অ্যাকুইজ়িশন থিয়োরি’র স্রষ্টারা সরব শিক্ষায় মাতৃভাষার অগ্রাধিকার ও গুরুত্ব প্রসঙ্গে।
দুই, বাস্তব সম্পর্কে তোমার যথেষ্ট জ্ঞান নেই। ইংরেজি না জানলে পড়বে কী করে? এখানে উত্তরটা অবশ্য ইংরেজির ধ্বজাধারীদের পক্ষে। এখনও বাংলা পাঠ্যবইয়ের সংখ্যা যথেষ্ট নয়। ঔপনিবেশিক ভার থেকে গিয়েছে সব জায়গার মতো মাতৃভাষায় পাঠ্যবই রচনার ক্ষেত্রেও। তবে পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে, অনুবাদ হচ্ছে, বাংলা ভাষায় লেখাও হচ্ছে স্নাতক স্তরের বই। অনেক বই আছে, যার অনুবাদ নেই। কিন্তু অনুবাদের দায়িত্ব ছাত্রদের নয়, শিক্ষকস্থানীয় কারও। তাঁরা ইংরেজিতে পড়ার শর্টকাট দেখিয়ে দায় ঝেড়ে ফেলতে চাইলে সে আলাদা কথা।
তিন, ইংরেজি না জানলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার। উচ্চতর শিক্ষা, চাকরির পরীক্ষাতেও সম্ভাবনা নেই। এ ক্ষেত্রেও প্রশ্ন, কোন চাকরি? এমন কিছু চাকরি আছে, যেখানে ইংরেজির চাকচিক্যকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়, বিষয়ের সঙ্গে বা ছাড়া। সেই সব আপাত-ঝলমলে চাকরি ছাড়াও এক চাকরিজগৎ আছে, যেখানে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে বাংলা নেপালি অলচিকি সব ভাষারই স্থান। কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরির পরীক্ষা (সিইটি) হয় ১২টিরও বেশি আঞ্চলিক ভাষায়, রাজ্য সরকারের চাকরির পরীক্ষা ৪টিরও বেশি ভাষায়।
আশার কথা, প্রশাসনের সদর্থক পদক্ষেপ। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মাতৃভাষায় দখলকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে। এই আশ্বাস বাংলা মাধ্যমে পড়া ছাত্রদের কাছে অসম প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার এক হাতিয়ার হতে চলেছে, সন্দেহ নেই। সে প্রতিযোগিতা ঔপনিবেশিক মনোভাবের সঙ্গে, ইংরেজি মাধ্যমে পঠনপাঠনের চাকচিক্যের সঙ্গে, ‘ইংরেজি বলতে না পারলে কিচ্ছু হবে না’ গোছের মানসিকতার সঙ্গেও।
বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে নির্ভুল বাংলা বলতে ও লিখতে পারি, এর থেকে বড় অহঙ্কার আর কিছু নেই। মাতৃভাষা দিবস আর মাস দুই দূরে, সত্যিকারের ভাষা দিবস এই বাংলায় ঠিক কবে পালিত হবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy