Advertisement
০৩ জুলাই ২০২৪
‘ঐশ্বরিক’ মহিমা যাঁর, তাঁর মাত্র দেড় লাখ ভোটে জেতাটা মামুলি
Lok Sabha Election 2024 Result

তবু যেন ফ্যাকাসে

লোকসভা ভোটে জয়ের অঙ্ক হিসেবে ধরলে, দেড় লক্ষ ভোটের ব্যবধান কি কম? খুব হেলাফেলার জিনিস? একেবারেই না। বেশ বড় ব্যবধান, বুক ঠুকে বলার মতো।

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০২৪ ০৮:১০
Share: Save:

এ বারের লোকসভা ভোটে সবচেয়ে বড় জয় কে পেয়েছেন? তর্কযোগ্য ভাবে বলা যেতে পারে, ভদ্রলোকের নাম অজয় রাই। বারাণসী কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী। পরাজিত প্রার্থী। কিন্তু কিছু কিছু পরাজয় জয়ের গরিমাকেও ম্লান করে দেয়। জয়ের চেয়েও বড় হয়ে দেখা দেয়। অজয় রাই সেই কাজটিই করেছেন। তিনি প্রবল প্রতাপান্বিত নরেন্দ্র মোদীর জয়ের ব্যবধানকে দেড় লক্ষের কিছু বেশি ভোটে আটকে দিয়েছেন। সঠিক ভাবে বললে, সংখ্যাটা ১,৫২,৫১৩।

লোকসভা ভোটে জয়ের অঙ্ক হিসেবে ধরলে, দেড় লক্ষ ভোটের ব্যবধান কি কম? খুব হেলাফেলার জিনিস? একেবারেই না। বেশ বড় ব্যবধান, বুক ঠুকে বলার মতো। তৃপ্তিতে চোখ বুজে আসার মতো। কান এঁটো করে হাসার মতো। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী সেই তৃপ্তিটা পাচ্ছেন কি? পাচ্ছেন না, পাওয়ার কথাও নয়। কারণ তাঁর লক্ষ্য ছিল, অন্তত সাত লক্ষ ভোটে জেতা। জয়ের এমন একটি অতিকায় নজির স্থাপন করা, যাতে ছেলেবুড়ো সবাই মিলে বলতে পারে, দেখেছ? একে বলে জেতা! মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়! এ যেন অনেকটা পাশের বাড়ির দেমাকি ছেলের মতো! পরীক্ষা দিয়ে বলেছিল, অঙ্কে একশোয় একশো পাব। রেজ়াল্ট বেরোলে দেখা গেল, টেনেটুনে সত্তর। সত্তর কি খুব খারাপ নম্বর? মোটেই না। ও-পাড়ার পঞ্চা তো পঞ্চাশ পেয়েই খুশিতে ডগমগ! কিন্তু একশো পাব বলে বুক বাজিয়ে সত্তর পেলে পরে মুখ চুনই হয়। নরেন্দ্র মোদীরও হচ্ছে। সে তিনি যতই হাসি-হাসি মুখ করে ‘ভি’ দেখান না কেন! তিনি নিজেই নিজেকে এমন একটি ঐশ্বরিক মহিমা প্রদান করে বসে আছেন, যে আজ দেড় লক্ষ ভোটে জেতাটাও তাঁর নামের পাশে বড় মামুলি, বড্ড এলেবেলে বলে মনে হচ্ছে।

হাজার হোক, তিনি মোদী তো আর পাঁচ জন প্রার্থীর মতো নন। এমনকি আর পাঁচ জন প্রধানমন্ত্রী-প্রার্থীর মতোও নন। তিনি খোদ পরমাত্মার সন্তান। জে পি নড্ডা তো বলেন, উনি শুধু নরেন্দ্র নন, উনি সুরেন্দ্র— দেবতাদেরও রাজা। মন্দিরে-মন্দিরে যখন নরেন্দ্র পুজো দেন, তখন তাঁর ছবি দেখে মনে হয়, তিনি পুজো করতে আসেননি, পূজিত হতে এসেছেন। ভক্তি জানাতে আসেননি, ভক্তির উদ্রেক করতে এসেছেন। তিনি যখন সমুদ্রতীরে দাঁড়ান, মনে হয় সমুদ্র তাঁকে দেখে ধন্য হল, তাঁর পদস্পর্শে সৈকতের বালুকণা পবিত্র হল। সিনেমা হওয়ার আগে গান্ধীজির কথা যেমন কেউ নাকি জানত না, মোদীজি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে ভারতের নামও কোথাও কেউ শোনেনি। ২০১৪ সালে নিদ্রিত ভারত হঠাৎ দু’চক্ষু কচলে দেখল, এক জ্যোতির্ময় এসে দাঁড়িয়েছেন! তাঁর অঙ্গুলিহেলনে রণদামামাও থেমে যায়, তাবড় রাষ্ট্রনেতা তাঁর আলিঙ্গনপাশে বাঁধা পড়ার জন্য ছুটে ছুটে আসেন! ভারতবাসীর পরম সৌভাগ্য যে, এমন ৫৬ ইঞ্চির বিশ্বগুরু এ দেশকে বিকাশের শিখরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য পরমাত্মার কাছ থেকে ২০৪৭ সাল পর্যন্ত সময় চেয়ে রেখেছেন! দেশের ভালর জন্য ভেবে ভেবে তাঁর ঘুম নেই।

দেশের ভাল মানে কি শুধু বড় বড় গালভরা কর্মসূচি আর কর্পোরেট তোষণ? না, ছোটখাটো সব খুঁটিনাটির দিকে মোদীর খেয়াল আছে। এই যেমন ধরা যাক, পাছে দেশের লোকের শব্দভান্ডার ম-এ ‘মোদী’তে আটকে যায়, তাই গোটা প্রচারপর্ব জুড়ে এ বার মোদীজি ‘ম’ দিয়ে আরও অনেকগুলো শব্দ শিখিয়েছেন। যথা— মোগল, মছলি, মুসলিম লিগ, মঙ্গলসূত্র, মহিষ, মুজরো...। তাঁর প্রতিটি জনসভাই লোকশিক্ষার এক-একটি পাঠ। বিরোধীদের প্রতি অপার করুণা, সংখ্যালঘুদের প্রতি গভীর দায়িত্বশীলতা থেকেই মোদী এ বার কংগ্রেসের ইস্তাহারটি সাধারণ্যে প্রচার করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, তাঁর মতো তারকা প্রচারক বিরোধী শিবির কোথায় পাবে! তাই নিজের গ্যারান্টি শিকেয় তুলে রেখেও তিনি বিরোধীদের করা প্রতিশ্রুতিগুলো অন্তত যাতে মানুষের কাছে পৌঁছয়, তার ভার গ্রহণ করেছিলেন। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং সৌজন্যের এমত দৃষ্টান্ত তিনি ছাড়া কে-ই বা স্থাপন করতে পারতেন! খুব বড় মন না থাকলে, চারশো পার করার আত্মবিশ্বাস টইটম্বুর না হলে এতটা মহানুভবতা দেখানো যায় না!

আমরা ভুলে যাই, মোদী তো আর সাধারণ মনিষ্যি নন। তাঁর ব্রহ্মজ্ঞান কঠোর তপস্যালব্ধ, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব অপার্থিব। ধনী-গরিবে ফারাক বাড়ছে কেন-র মতো ছেঁদো প্রশ্নে তিনি জলবৎ তরলং জবাব দেন— সবাইকে গরিব বানিয়ে দিলে ভাল হত? তাঁর নামের পাশে বসার জন্যই কেবল ‘এন্টায়ার পলিটিক্যাল সায়েন্স’ নামে আদ্যন্ত নতুন একটি পাঠ্যবিষয় তৈরি হয়ে যায়। নিন্দুকেরা তাঁর বিবিধ সুভাষিতানিকে মিথ্যাচার বলে গাল পাড়ে! হতভাগারা বুঝতেই পারে না, তাঁর প্রতিটি বাক্যই আর্ষ-প্রয়োগ। সত্য-মিথ্যার সাধারণ নিক্তিতে তার বিচার হওয়ারই নয়। আর এ কথাও কে বা না জানে যে, অসহিষ্ণুতা-বিদ্বেষ-ঘৃণা-বিভাজনের মতো কুশব্দগুলো মোদী-রাজত্বে অভিধান থেকেই ছেঁটে ফেলা হয়েছে! মোদীর ধ্যানজ্ঞান শুধু তাঁর মিত্রঁ-শক্তির উন্নয়ন। সেটাকে যারা স্বজনপোষণ বলে, ধামাধরা পুঁজিবাদ বলে, তাদের দৃষ্টিই বড় সঙ্কীর্ণ। সবাইকে বড়লোক বানিয়ে দিলে ভাল হত নাকি?

মোদীর মাহাত্ম্য অনুধাবন করার মতো মেধাই আসলে এ পোড়া দেশে সকলের করায়ত্ত হয়নি আজও। তাই থেকে থেকেই পাঠ্যবইয়ে কাঁচি চালাতে হয়। শিক্ষার অগ্রগতি না হলে মোদীর মন কি বাত বোঝার ক্ষমতা তৈরি হবে কী করে? সেই খামতি আজও পুরোপুরি দূর হয়নি বলেই তো অজয় রাইয়ের মতো গ্ল্যামারবিহীন মানুষও মোদীকে দেড় লাখে আটকে দেওয়ার ক্ষমতা ধরেন। দেশের যাবতীয় প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি মোদীর বশংবদ হলেও কিছু বদ বেয়াড়া অর্বাচীন মাঝেমধ্যে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। সেই কারণেই তো মোদীর দলের জয়রথ আড়াইশোর নীচে থমকে যায়। একক দলের পক্ষে ২৪০টি আসন পাওয়া কি কম? আদপেই না। বিশেষত টানা দশ বছর ক্ষমতায় থাকার পরেও এই আসনসংখ্যা ধরে রাখা যে কোনও অঙ্কেই বড় কৃতিত্ব বলে গণ্য হওয়ার কথা। গোটা বিরোধী জোট মিলে যা পায়নি, মোদীর দল একা তার চেয়ে বেশি পেয়েছে। তবু কেন ফ্যাকাসে লাগছে? কারণ সেটা মোদীর মাপের তুলনায় ছোট। মোদীর দম্ভের পাশে খাটো। একটা এত বড় দেশের সাধারণ নির্বাচনকে তিনি যে ভাবে ব্যক্তিতন্ত্রের উদ্‌যাপনে পরিণত করেছিলেন, তার সাপেক্ষে এ নেহাতই অল্প হইল। যিনি মনোনয়ন পেশ করাকেই ৪০০ পার-সুলভ বিজয়োৎসবের চেহারা দেন, তাঁর পক্ষে তো খুবই অল্প হইল। মোদীর মুখচ্ছবিকেই জয়ের ‘গ্যারান্টি’ ধরে এগিয়ে যদি ৬৩টি আসন খোয়াতে হয়, তবে প্রতিটি খোয়ানো আসনেও মোদীই হেরেছেন বলে ধরতে হবে। অবলীলায় একা ৩৭০ আসন পাওয়ার দাবি করার পরে এবং বুথফেরত সমীক্ষাতেও এনডিএ জোটকে ৩৫০-৪০০ বলে প্রচার করার পরে ২৭২ ছুঁতে না পারলে তাকে পতন বলেই মনে হবে। সমাজমাধ্যমে হাহুতাশ দেখলে সেটা মালুম হচ্ছে। স্বয়ং রামের জন্মভূমিতে হার, অমেঠীতে স্মৃতি ইরানির পরাজয়, হিমন্তবিশ্ব শর্মার রাজ্যে দশ লাখে জেতার রেকর্ড, মহারাষ্ট্রে স্বখাতসলিলে নিমজ্জন, এত কিছু করেও তামিলনাড়ুতে খালি হাত— ভক্তদের বুকে লাগার মতো আঘাত কম নয় এ বার।

আর তার পাশে? ভাঙা পাঁজর, স্বল্প সম্বল আর অনন্ত টিটকিরির মাঝে বাঁচিয়ে রাখা মনের জোরকে আশ্রয় করে বিরোধী শক্তির একটুখানি মাথা তোলা এমন এক সাফল্য, যা নিজ গৌরবে গরীয়ান। দেশের বহু মানুষ এখনও কেবল মোদীর প্রজা না হয়ে গণতান্ত্রিক নাগরিক হতে চান, এই ফলাফল সেই সত্যেরই নির্ঘোষ। মোদীজি ক্ষুণ্ণ হতে পারেন, কিন্তু ভারতের আত্মসত্তার পক্ষে এটুকুই খুব বড় আশা আর ভরসার জায়গা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE