সহযোদ্ধা: তিস্তা শেতলবাদ, আর বি শ্রীকুমার, ও মহম্মদ জ়ুবেরের গ্রেফতারির প্রতিবাদে মিছিল। ১ জুলাই, পটনা। ছবি: পিটিআই
চল্লিশ বছরের পুরনো চলচ্চিত্রের দৃশ্য চার বছর আগে টুইট করেছিলেন অল্ট নিউজ়-এর সাংবাদিক এবং অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মহম্মদ জ়ুবের, সেই টুইটের দায়ে কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন দিল্লি পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করেছে। আদালতে তিনি জামিন পাননি। এই অঘটন নিয়ে একটি সাক্ষাৎকারে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি দীপক গুপ্ত প্রবীণ সাংবাদিক করণ থাপারের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন: “আমাদের সমাজ হঠাৎ খুব অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। চল্লিশ বছর ধরে কিছু ঘটল না, হঠাৎ এক বছরে বা ছ’মাসে এই টুইটটা এত আপত্তিকর হয়ে গেল?” যে কোনও সুস্থবুদ্ধির মানুষ বিচারপতি গুপ্তের সঙ্গে সহমত হবেন। আমাদের অনেকের বিপন্ন বিস্ময়কে তিনি স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করেছেন।
কিন্তু তাঁর কথার সূত্র ধরে একাধিক প্রশ্নও উঠে আসতে পারে। ‘চল্লিশ বছর ধরে কিছু ঘটল না’— এই যুক্তির উত্তরে কেউ তো বলতেই পারে, “পরিস্থিতি পাল্টে গেছে, আগে হনুমানকে হানিমুন বানালে কেউ আপত্তি করত না, করলেও লোকে হেসে (বা না হেসে) উড়িয়ে দিত, এখন আপত্তি ওঠে এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, তার পরিণামে অশান্তি হতে পারে, তাই এই শাসন জরুরি।” পরিস্থিতি যে পাল্টেছে, সে-কথা আমরা বিলক্ষণ জানি। দেবদেবী, ধর্মগুরু, ক্ষমতাসীন দাদা বা দিদি ইত্যাদি প্রভৃতিদের সম্পর্কে নিন্দা বা সমালোচনা তো অনেক পরের কথা, সম্পূর্ণ অকিঞ্চিৎকর মন্তব্য, এমনকি নির্ভেজাল কৌতুককে কেন্দ্র করে গত কয়েক বছরে বহু অশান্তির আগুন জ্বলেছে। সুতরাং আগে যা হয়নি এখন তা হবে না, এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। বরং যে কোনও একটা গোলমাল পাকানোর উপলক্ষ তৈরি হলেই গোলমাল হবে, তার সম্ভাবনা এখন প্রবল। সুতরাং প্রশ্নটা হল, কারও কোনও কথা বা কাজের প্রতিক্রিয়ায় যদি অশান্তি হয়ও, তার দায় কার? কে তার জন্য শাস্তি পাবে?
এখানেই পরের প্রশ্ন। পরিস্থিতি এমন পাল্টে গেল কেন? আগুন জ্বলার আশঙ্কা এমন বেড়ে গেল কেন? এর পিছনে সামাজিক অসহিষ্ণুতার ভূমিকা নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু সেটা ব্যাধি নয়, ব্যাধির লক্ষণ। ব্যাধির মূলে আছে ক্ষমতার কারবারিরা, যারা এই বিষাক্ত অসহিষ্ণুতাকে সৃষ্টি এবং লালন করে চলেছে। ওই কারবারিদের পরোক্ষ প্রশ্রয় এবং প্রত্যক্ষ মদত না থাকলে এই অসহিষ্ণুতা বিধ্বংসী আকার ধারণ করতে পারে না। নানা উপলক্ষে যে আগুন জ্বলছে বা জ্বলবার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে, সচরাচর তা নিজে জ্বলে না, তাকে জ্বালানো হয়। বহু ক্ষেত্রেই উপলক্ষটাও তৈরি করে নেওয়া হয়। মহম্মদ জ়ুবেরের ক্ষেত্রেও তার স্পষ্ট লক্ষণ। আলটপকা একটা রহস্যময় টুইট-নালিশ এবং তার পরে সেই নালিশের ধুয়ো তুলে গ্রেফতারি পরোয়ানার আবির্ভাব— দেখেশুনে মনে পড়তেই পারে গীতার একাদশ অধ্যায়: যারা মরবে, আমি তো আগেই তাদের মেরে রেখেছি। এ-মহাভারতে ক্ষমতা প্রথমে তার নিশানা স্থির করে, তার পরে সেই অনুসারে একটা অশান্তির উপলক্ষ খুঁজে অথবা বানিয়ে নেয়, তার পরে অশান্তির নাম করে কিংবা তার ভয় দেখিয়ে নির্ধারিত শিকারের উপর চড়াও হয় এবং কেউ তা নিয়ে প্রশ্ন তুললে বলে— যারা বিপজ্জনক প্ররোচনা দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা না করলে অশান্তি হবে।
এই ভাবেই চোখের সামনে স্বাধীন ভাবে কথা বলার, ছবি আঁকার, গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ লেখার, সিনেমা বানানোর, সংবাদ প্রচারের অধিকার সবই কেমন ম্লান হয়ে এল। ক্ষমতার অধীশ্বর এবং তাঁদের হরেক রকম চেলাচামুণ্ডাদের অপছন্দের কোনও আচরণ কেউ করলেই নানাবিধ ‘প্ররোচনা’র অভিযোগে মাথার উপরে খাঁড়াটি নেমে আসছে— রাষ্ট্রদ্রোহের প্ররোচনা, বিচ্ছিন্নতাবাদের প্ররোচনা, সন্ত্রাসের প্ররোচনা, অশান্তির প্ররোচনা, উন্নয়নে বাধা দেওয়ার প্ররোচনা, ইত্যাদি ইত্যাদি। বহু ক্ষেত্রেই প্ররোচনার কারণ হিসেবে খাড়া করা হচ্ছে ‘মানুষের আবেগে’ আঘাত করার যুক্তি। অবশ্যই সব মানুষ নয়, যারা ক্ষমতার দলে আছে অথবা তার কাজে লাগতে পারে, তাদের আবেগই মূল্যবান, অন্যদের আবেগের দাম কানাকড়িও নয়। উল্টো দিকে যাঁরা আছেন, ক্ষমতা যাঁদের শত্রু বলে গণ্য করে, যাঁরা তার বিরাগ বা বিদ্বেষের পাত্রপাত্রী, তাঁদের সমস্ত আবেগ অনুভূতিকে প্রতিনিয়ত আঘাত করাই তার পরম ব্রত। যারা সেই পবিত্র কাজটি সম্পাদন করে, তারা সরাসরি হিংসার ভয়ঙ্কর এবং কুৎসিত প্ররোচনা দিলেও ক্ষমতাবানেরা রা কাড়েন না, তাঁদের চোখে পলক পড়ে না।
এটাই যখন বাস্তব, তখন কথা বলার স্বাধীনতা, সমালোচনার স্বাধীনতা, প্রতিবাদের স্বাধীনতার দাবি জানানোর ভাষাও অনেক বেশি জোরদার হওয়া দরকার। ‘এত দিন তো অশান্তি হয়নি, আজ হঠাৎ কী এমন হল’ বলাটা যথেষ্ট নয়, এখন স্পষ্ট ভাবে বলা দরকার— অশান্তি যদি হয়, তার দায় যারা অশান্তি করবে তাদের, এবং সরকারের কাজ তাদের শাস্তি দেওয়া, অশান্তির অজুহাত বা ভয় দেখিয়ে স্বাধীন নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করা নয়। স্বাধীন ভারতের বিচারপতিরা অনেকেই বিভিন্ন উপলক্ষে এই কথাটা বার বার বলেছেন। আইনজ্ঞ অভিনব চন্দ্রচূড়ের লেখা রিপাবলিক অব রেটরিক (পেঙ্গুইন, ২০১৭) থেকে দু’টি নজির তুলে আনা যেতে পারে। ১৯৭৬ সালে রামায়ণ: আ ট্রু রিডিং নামক একটি বইয়ের উপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা খারিজ করে রায় দিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি কৃষ্ণ আইয়ার। সেই সূত্রে তিনি মন্তব্য করেছিলেন: ‘কট্টর স্বভাবের মতান্ধ লোকেদের’ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কোনও কিছুর বিচার করা উচিত নয়। দ্বিতীয় নজিরটি এর বারো বছর পরের। ১৯৮৮ সালে অবিস্মরণীয় টেলিভিশন-সিরিয়াল তমস-এর সম্প্রচার আটকানোর আবেদন জানানো হয় আদালতে। সুপ্রিম কোর্ট সেই আবেদন খারিজ করে দেয়। এই মামলায় সর্বোচ্চ আদালত বিচারপতি ভিভিয়ান বোসের নির্ধারিত একটি মাপকাঠি ব্যবহার করেছিল। অনেক বছর আগে নাগপুর হাই কোর্টের বিচারপতি হিসেবে কাজ করার সময় একটি মামলায় জাস্টিস বোস বলেছিলেন: “কোনও কথার পরিণাম কী হতে পারে, সেটা বিবেচনাবোধসম্পন্ন, দৃঢ়চেতা, প্রত্যয়ী এবং সাহসী মানুষের অবস্থান থেকে বিচার করতে হবে, দুর্বল এবং দোদুল্যমান স্বভাবের লোকেদের জায়গা থেকে নয়, সেই সব লোকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও নয় যারা প্রত্যেকটি বিরোধী অভিমতেই বিপদের গন্ধ পায়।”
কথাগুলো এখন যেন অবাস্তব এবং অলীক শোনায়। তার কারণ, এমন এক ভারতে আমরা পৌঁছে গিয়েছি যেখানে কট্টর স্বভাবের মতান্ধরাই সর্বেসর্বা, বিরোধী অভিমত মানেই যেখানে দেশদ্রোহ, যেখানে নীরন্ধ্র অসহিষ্ণুতা কেবল পেয়ে বসেনি, মাথায় চড়ে বসেছে। দুয়ারে অমৃত মহোৎসব সমাগত হলে এ-রকমটাই বুঝি হয়ে থাকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy