খেলা হবে।— কিছু দিন ধরে এই শব্দবন্ধটি আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনে নুনঝাল মিশিয়ে একটু বেশিই ব্যবহৃত হচ্ছে। ফুটবল, ক্রিকেট বা ব্যাডমিন্টন খেলা নয়, এ হচ্ছে জীবনপ্রণালীর মধ্যে সেঁধিয়ে দেওয়া এক ভিন্ন ভাষ্য, যার নাম ‘খেলা’, যা চরম ঘৃণা ও অবহেলায় যে কোনও ‘লেখা’ অর্থাৎ বয়ান উল্টে দিতে পারে।
বয়ান ওল্টানো মানে অবশ্যই ‘বিপ্লব’ সংগঠন করা নয়, সেটি তো এক সেকেলে রংচটা আত্মঘাতী ব্যর্থ শব্দ। বর্তমানে যেটা হচ্ছে সেটা বয়ান নিয়ে বাইশ কোপের খেলা। এখন বিশ্ব জুড়ে চার পাশে শুধু খেলা। সমস্ত আইডিয়োলজিকাল ন্যারেটিভ ভেঙে তছনছ করে ফেলার খেলা। আবোল-তাবোল’এ সুকুমার রায় যা অনেক আগেই দেখেছিলেন: ‘পান্তভূতের জ্যান্ত ছানা করছে খেলা জোছনাতে।’ সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে (গুপী গাইন বাঘা বাইন, ১৯৬৯) পরে আমরা যা দেখব, তা তো উত্তরাধুনিক ভূতের নাচও বটে, যা অপূর্ব ব্যঞ্জনায় আমাদের সমাজৈতিহাসিক ক্ষতমুখগুলি দেখিয়ে দেয়। সত্যজিৎ কি এই সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী ছবিতে শিশুদের জন্য খেলাচ্ছলে ধরতে চেয়েছিলেন মানুষের সত্তা ও মুখোশ তথা আইডেন্টিটি বদলের খেলা (শুণ্ডি ও হাল্লার রাজা), ভালমন্দের খেলা, যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা— ‘‘শুধু শুধু বসে বসে খেলা করলে লোকেরা যে ছ্যা ছ্যা করবে, সেটা কি ভাল হবে? আজ বাদে কাল যুদ্ধু হবে।” খেলার নিয়মের একটা ছক উপস্থিত করছিল আমাদের সামনে যা সম্ভব হয়েছিল তাঁর গভীর অন্তর্দৃষ্টি, সাংগীতিকতা আর দার্শনিক বিন্যাসবোধের কারণে। যুদ্ধ-বিষয়ক এত চলচ্চিত্র দেখেছি আমরা, কিন্তু এ-রকম লাগ ভেল্কি লাগ রূপকথার বয়ান আদৌ দেখেছি কি না সন্দেহ।
“আমরা লড়াই করি না, আমরা খেলি।”— লর্ড ডালহৌসির লখনউ অধিকারের সমূহ সর্বনাশের সামনে দাঁড়িয়ে সৈয়দ মির্জা আলি বলেছিল মুনশি নন্দলালকে। সত্যজিৎ রায় শতরঞ্জ কে খিলাড়ি ছবিতে দাবা খেলার ছকে ব্যক্তিজীবন, সমাজজীবন ও ইতিহাসকে ধরতে চেয়েছিলেন। বুঝতে চেয়েছিলেন মধ্যবিত্তের ঐতিহাসিক উদাসীনতাকে। ‘ক খ ক খ ক খ’ বিন্যাসে (যে কথা শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়কে এক সাক্ষাৎকারে নিজেই বলেছিলেন তিনি) বিনুনির মতো একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা জীবনকে দেখাতে চেয়েছিলেন। তাঁর ক্যামেরার চোখ যেন খেলার নিয়ম এবং জটিল মারপ্যাঁচ ধরে ফেলেছে। শেষে দু’টি সুতো মিলে যায়। মির ও মির্জারা আধো-অন্ধকারে নির্লজ্জ সাবলীলতায় চিরাচরিত ভারতীয় ঐতিহ্য ছেড়ে ইংরেজ ধরনে খেলতে খেলতে মিলেমিশে যায় ইতিহাসের সিলুয়েটে। খেলা শুধু, খেলা, খেলা, খেলা। “মুঁহ্ ছুপানে কে লিয়ে অন্ধার জ়রুরি হ্যায় মীর সাব।” নায়ক (১৯৬৬)-এ আবার সুযোগের গন্ধ পাওয়া স্বামী তাঁর স্ত্রীকে বলছেন, “এই দেখো... তুমি আবার... এটা তো একটা খেলা মলি, একটা স্ট্র্যাটেজি, একটা...।” মুখ লুকনোর আড়াল?
দাবা খেলা অব্যাহত আছে। তার চাল আমাদের কোষের মধ্যে, রক্তকণিকার মধ্যে ঘুরছে। খেলার অর্থ? অস্কার ওয়াইল্ড-এর দ্য পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে-র ভূমিকায় ছিল সেই অমোঘ বাক্য: “দোজ় হু গো বিনিথ দ্য সারফেস ডু সো অ্যাট দেয়ার ওন পেরিল।” সত্যিকার জীবনের সত্যিকার সজীবতার পরিবর্তে এই খেলা এক মিথ্যে নির্মাণ। ব্যক্তির ফ্যান্টাসির একটি কাঠামো, যা সত্যান্বেষণের ভান করে জীবনকে প্রবঞ্চনা করবে চিরকাল। প্রেমচন্দ-এর গল্পে ও সত্যজিতের ছবিতে মির ও মির্জার জীবনযাপনের কাঠামোটি দাবার ঘুঁটি দিয়ে গড়া। কোনও অবস্থাতেই তাদের ঘোর কাটে না। সেখানে ভালবাসার কোনও স্থান নেই।
এই ‘খেলা’ কি আসলে মানবেতর হওয়ার আহ্বান? মানবেতর করে দেওয়ার চতুর চক্রব্যূহ? যখন এক গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচনকে কোনও দলের পক্ষ থেকে ‘খেলা’য় পরিণত করার অসম্মান জানানো হয়, অর্থাৎ মগজে কার্ফু ঘোষণা করে অন্ধ ও যান্ত্রিক গণ-হিস্টিরিয়াকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়, তখন কি তা স্বাধীন চিন্তাকে এক অন্তঃসারশূন্য সার্কাসে পরিণত করে না? এরিক বার্ন-এর গেমস পিপল প্লে নামক মানবসম্পর্ক বিষয়ক বহুপঠিত বইতে অস্মিতা দমন করে পরস্পরকে ‘আত্মবিধ্বংসী ও বিভাজনমুখী’ ভাবে ‘ব্যবহার’ করার জটিল ‘মনস্তাত্ত্বিক খেলা’ পরিহার করে সুস্থ জীবনযাপনের আমন্ত্রণ জানানো হয়। বিশ্বব্যাপী রাজনীতির দাবাড়ুদের পক্ষে সেই সুস্থতা অর্জন করা আজ প্রায় দুঃসাধ্য। দক্ষিণপন্থীরা তো বটেই, বামপন্থী পার্টিগুলি— স্বয়ং জাঁ-পল সার্ত্রের মতে— এ-ভাবেই তাদের চরিত্র হারিয়েছে। পূর্ব ইউরোপে স্লাভয় জ়িজেক-এর মনে হয়েছে, বড় মতাদর্শ আজ এক যৌন উত্তেজনা মাত্র।
জঁ রেনোয়া তাঁর শ্লেষাক্ত কমেডি লা রেগ্ল দ্যু জ্যো (খেলার নিয়ম) সম্পর্কে পরে আত্মজীবনীতে লেখেন: “আমার সৌভাগ্য যে যৌবনেই আমি যাবতীয় ছলচাতুরি ধরতে পেরেছিলাম, এবং ‘খেলার নিয়ম’ ছবিতে যা জানি সব দর্শকের কাছে ফাঁস করে দিয়েছিলাম। লোকে এ সব ভালবাসে না, সত্য তাদের কাছে অস্বস্তিকর।” সত্যজিতের ছবিতে ঔপনিবেশিক দালাল আর অযোধ্যার সম্রাটকে মুখোমুখি দাবার ঘুঁটির মতো সাজানো হয়; পাশাপাশি চলে ছোট ছোট বৃত্তের মধ্যে অন্য দাবাখেলা। বিবদমান গোষ্ঠীদের নানা সমস্যার একটি হল: এ-বারে দাবা খেলব কার সঙ্গে? সেখানে ক্ষোভ আর সংঘাত আস্তিনের নীচে লুকিয়ে থাকে। ঠিক সময়ে ফণা তোলে বন্দুক। মির রোশন আলির ভাষায়, “কৌয়ে ভি হমে জলিল সমঝতে হ্যায়।” এই ছবি আমাদের বলে: ‘মুখ লুকনোর জন্য তো অন্ধকার জরুরি।’
সাম্প্রতিক ‘খেলা হবে’ কথাটি নানা দিক থেকে আমাদের আলমারির কঙ্কালকে বাইরে বার করে আনে। ইতিহাসের, ব্যক্তির, সমাজের, গণতন্ত্রের। এর সঙ্গে প্রীতি ও ভালবাসার তেমন সম্পর্ক নেই। আছে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার কয়েকটি ভাঙাচোরা আয়না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy