বিশ্ব অর্থনীতির আকাশে ফের কালো মেঘ। তাবড় অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের বড়কর্তা— সকলেই প্রায় এক বাক্যে মানছেন যে, বিশ্বব্যাপী আর্থিক সঙ্কট শুরু হয়ে গিয়েছে। সামনের বছর তা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা। এখনও পর্যন্ত যা ইঙ্গিত, তাতে এর প্রভাব ভারতের উপরেও পড়বে। এমনিতেই ভারতে অর্থনৈতিক সমস্যা অঢেল। বিশ্বজোড়া মন্দার চোখরাঙানিতে সামনের বছরদেড়েক সেগুলি আরও বহু গুণ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ১৯৩০-এর দশকে হওয়া গ্রেট ডিপ্রেশন বা মহামন্দার কথা আজও কেউ ভোলেননি। তার প্রভাব পড়েছিল সারা বিশ্বে। বিধ্বস্ত হয়েছিল বিশ্ব অর্থনীতি। এর পরের সাত দশকে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির আঙিনায় ধীরে ধীরে উন্নতি হয়েছে। এমন নয় যে, এই দীর্ঘ সময়ে সমস্যা আসেনি। উন্নত এবং উন্নয়নশীল দুনিয়ায় বার বার ধাক্কা এসেছে। চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। তবু মোটের উপরে ভয়ঙ্কর সমস্যা এড়িয়ে একটা উন্নতির ধারা বজায় থেকেছে।
যে রকম ভয়াল সমস্যার কথা বলছি, তা শেষ বার আছড়ে পড়েছিল ১৪ বছর আগে— ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে। চোখ কচলে সারা বিশ্ব দেখেছিল যে, সেই প্রবল ধাক্কার অভিঘাতে ধসে গেল নিউ ইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিট। সে বার সমস্যার শিকড় ছিল বাড়ি তৈরি করা বা কেনার জন্য দেদার ধার। এক সময়ে আমেরিকার রিয়্যাল এস্টেটের বাজারে বিপুল রিটার্নে আস্থা পোষণ করে দেদার ধার দিয়েছিল সে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি। কিন্তু এক সময়ে দেখা গিয়েছিল যে, সেই ধার অনেকেই আর শোধ দিতে পারছেন না।
শুধু তা-ই নয়, বাড়ির সম্ভাব্য যে বাজারদর ধরে নিয়ে তা বন্ধক রেখে ধার দেওয়া হয়েছিল, দেখা গেল তা-ও তলিয়ে গিয়েছে অতলে। অর্থনীতির ইতিহাসে এই অধ্যায়ই সাবপ্রাইম মর্টগেজ ক্রাইসিস নামে পরিচিত। এই সঙ্কটের জেরেই নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছিল তখন সারা দুনিয়ায় এক ডাকে চেনা ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্ক লেম্যান ব্রাদার্স। কার্যত ডুবেছিল পুরো ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা। সেই সঙ্গে এআইজি, জিএম, ক্রাইসলার-সহ আরও অনেক সংস্থা। সেই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে সারা পৃথিবীর বহু দিন লেগেছিল।
এ বার আর্থিক সঙ্কটের কারণ অবশ্য আলাদা। মূলত রাশিয়া বনাম ইউক্রেনের যুদ্ধ। এই যুদ্ধের কারণে তেল, গ্যাসের দাম বাড়ছে হুহু করে। এতে প্রবল সমস্যার মুখে পশ্চিমি দুনিয়া। কারণ, সেখানে এর জেরে বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের মতো জ্বালানির দাম বাড়ছে হুড়মুড়িয়ে। অনেক জায়গায় ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ! তার উপরে সামনেই শীত। পর্যাপ্ত গ্যাস আর বিদ্যুৎ ছাড়া হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় কী ভাবে গরম থাকবে ইউরোপের বাড়ি-ঘর? দুশ্চিন্তার শেষ নেই। হবে না-ই বা কেন? ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের ২০০টি দেশের মধ্যে অন্তত ৫০টি দেশে খাওয়ার খরচে টান পড়তে শুরু করেছে। এক দিকে জ্বালানির বাড়তি খরচ মেটাতে গিয়ে খাবার কেনার সঙ্গতি নেই, অন্য দিকে টান খাবারের জোগানেও। আগামী দিনে এই সমস্যা আরও তীব্র হওয়ার সম্ভাবনা।
রাষ্ট্রপুঞ্জ, বিশ্ব ব্যাঙ্ক, আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার (আইএমএফ) থেকে শুরু করে প্রায় সকলেই মানছে যে, সামনে খুব খারাপ সময় অপেক্ষা করছে। এখন থেকেই খরচ ও নতুন লগ্নিতে কাটছাঁট করতে শুরু করেছে বহু সংস্থা। আশঙ্কা, আগামী দিনে আমদানি-রফতানি কমবে। শুকিয়ে যাবে বিশ্ব-বাণিজ্যের স্রোত। এবং অবধারিত ভাবে এর প্রভাব পড়বে ভারতের উপরেও।
কেন্দ্রীয় সরকার এবং রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক বৃদ্ধির যে সম্ভাব্য হারের কথা বলে আসছে, সম্প্রতি নিজেদের পূর্বাভাসকে তার থেকে নীচে নামিয়ে দিচ্ছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান। বিশ্ব অর্থনীতির নড়বড়ে দশাই এর কারণ। আসলে কোভিডের আগেই এ দেশে বৃদ্ধির গতি কমেছিল— নোট বাতিলের পরে লকডাউনের গুঁতোও যেন কোমর ভেঙে দিয়েছে এ দেশের অর্থনীতির।
২০২০ সালের এপ্রিল থেকে টানা ছ’মাস জাতীয় আয় কমেছে। বৃদ্ধির হার নয়, জিডিপি-র পরিমাণই কমে গিয়েছে সরাসরি। তা-ও একনাগাড়ে আধ বছর। ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম। অনেকে বলছেন, শুধু ২০২০-২১ সালে দারিদ্রসীমার নীচে নেমে গিয়েছেন বহু কোটি ভারতীয়। এই জেরবার অবস্থা থেকে দেশের অর্থনীতি যখন সবে মুখ তোলার চেষ্টা করতে পারত, তখন আবার এই নতুন সঙ্কট। একে অর্থনীতিতে সমস্যা অঢেল। বৃদ্ধির গতি এখনও ঢিমে। বেসরকারি লগ্নির আগ্রহ সীমিত। বেকারত্বের হার চড়া। স্বাধীন বিশ্লেষকদের অনেকের মতে, সাড়ে চার দশকে সর্বোচ্চ।
এই পর্যাপ্ত সংখ্যায় কাজ না থাকার সমস্যা কিন্তু সবচেয়ে বেশি ভোগাচ্ছে ভারতকেই। কেন? ভারত ও চিনের জনসংখ্যা এখন প্রায় সমান— ১৪০ কোটির আশেপাশে। কিন্তু চিনে যেখানে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বাসিন্দার বয়স ৩৮-৩৯ বছর (মিডিয়ান এজ), সেখানে ভারতে তা ২৮-২৯ বছর। জনসংখ্যায় যুবক-যুবতীর এই বিপুল অনুপাত অবশ্যই সম্পদ, যাকে আমরা ‘ডেমোগ্র্যাফিক ডিভিডেন্ড’ বলি। কিন্তু হাতে কাজ না পেলে, এই সম্পদেরই বোঝা হয়ে উঠতে দেরি হয় না।
এর সঙ্গে রয়েছে ধনের অসম বণ্টন। ধনকুবেরদের ঘরে টাকার পাহাড়, সেখানে দেশের বহু মানুষের খাবার জোটে না। এই সমস্ত কিছুর উপরে এ বার বোঝা খাবার-দাবারের দাম। দেশের ইতিহাসে প্রথম বার দেড় বছর নাগাড়ে পাইকারি মূল্যসূচক (হোলসেল প্রাইস ইনডেক্স বা ডব্লিউপিআই) ১০ শতাংশের উপরে। সেপ্টেম্বরে ৭ শতাংশের উপরে খুচরো মূল্যবৃদ্ধির হারও (কনজ়িউমার প্রাইস ইনডেক্স বা সিপিআই)। তেল-গ্যাস-খাদ্যপণ্য-নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র অগ্নিমূল্য। যাঁরা বাজারে যাচ্ছেন, তাঁদের হাতে দামের ছেঁকা। বিশ্ব অর্থনীতির বেহাল দশার কারণে সামনের বছরদেড়েক এই সমস্ত সমস্যা সম্ভবত আরও বাড়বে। বাণিজ্য থেকে কাজের বাজার— সঙ্কটের ছায়া পড়বে সর্বত্র।
কত দিন এই সমস্যা চলবে, এর প্রভাব পরবর্তী লোকসভা ভোটে পড়বে কি না, তা এখনই বলা শক্ত। তবে আরএসএস থেকে বিরোধী, এমনকি সরকার— এই আশু সঙ্কটের কথা এখন সকলের মুখে। কেউ একে অস্বীকার করতে পারছেন না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy