যখন থেকে ‘জ্ঞান’ হয়েছে, তাঁর হাসি-মুখটাই দেখেছি, কখনও রাগতে দেখিনি, ভয়ও পেতে দেখিনি। শালগাছের ফোকর থেকে মাঝে মাঝে হাওয়া খেতে বেরোত গোখরো সাপ; আমরা ভয় পেতাম, তিনি ভরসা দিতেন: “নিজের কাজ করো, ও নিজের কাজ করে যাবে, ভয় নেই।” তিনি আমার গ্রাম-ঠাকুরদা— চানা মুর্মু, আমার গড়ম-বা। সব কথাতেই তাঁর কাঁধ দুলিয়ে হাসি, কিংবা বিস্ময়, বা আশ্বাস। সেই প্রথম তাঁকে আতঙ্কিত হতে দেখলাম। অর্ধ শতাব্দী আগে, ইস্কুলে বা অন্য কোথাও শুনলাম, মানুষ চাঁদে পা দিয়েছে। সদ্য-জানা তথ্যটা তাঁকে তৎক্ষণাৎ জানানো চাই। কথাটা জানানোমাত্র তাঁর উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণ মুখটাতে যেন কেউ ছাই ঘষে দিয়ে গেল। কিছু ক্ষণের স্তব্ধতা, তার পর প্রায় অস্ফুটে বললেন, “সে কী কথা! মানুষ চাঁদের গায়ে পা দিল? সর্বনাশ, আর রক্ষা নেই!”
তখন চতুর্থ শ্রেণি, বোধগম্য হচ্ছিল না, কেন মানুষের সর্বনাশ হবে। যে লোকটা চাঁদে গিয়েছিল, (নিল আর্মস্ট্রংয়ের নাম তখনও জানি না) সে তো ফিরে এসেছে, সমস্যাটা কোথায়? “সমস্যা নেই? হঠাৎ করে তুমি চাঁদে চলে যাবে? পৃথিবী-চাঁদ-সূর্য-তারা, সবার নিজের-নিজের ঘরবাড়ি। তুমি অন্যের ঘরে ঢুকতে যাবে কেন? ধরো, এই আমাদের বাড়ি, আর ওই তোমার পদরা দাদার বাড়ি। তা, হঠাৎ করে নিশুত রাতে আমি তার ঘরে হাজির হয়ে যাব? তার রাগ হবে না? তেমনই চাঁদ তার ঘরে কী করছে আমরা জানি না, সে হয়তো ঘুমোচ্ছে, কিংবা ভাত রাঁধছে, তার মাঝে তুমি দুম করে গিয়ে হাজির হয়ে যাবে?”
গড়ম-বা’র কথাগুলো কেমন যেন মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিল, বুঝতে পারিনি। “চাঁদ বলো, সূর্য বলো, পাহাড়-বন-পশুপাখি বলো, সবাই মানুষের পড়শি। এক মানুষ যেমন আর এক মানুষের পড়শি, তাদের মধ্যে কথাবার্তা হয়, দেওয়া-নেওয়া হয়; কিন্তু তারা এক নয়, আলাদা। তুমি যদি সেটা না মানো, তা হলে তারাও মানবে না। আর, রেগে গেলে মহা অনর্থ হবে।”
কল্পনা করার চেষ্টা করি, আজ পাঁচ দশক পর, যখন অনর্থটা একেবারে ঘাড়ের উপরে— বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন ‘ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা’— তখন গড়ম-বা বেঁচে থাকলে কী বলতেন? আমি নিশ্চিত, ‘হেঁ-হেঁ, বলেছিলাম না!’ বলে তিনি আত্মগর্বে মুগ্ধ হয়ে থাকতেন না। যুগ-যুগান্তের কঠিন শ্রমে অর্জিত তাঁর সভ্যতা তাঁকে শিখিয়েছিল, ওটা কুরুচি, মানুষের বিপদের সময় ও রকম বারফট্টাই মারাটা মানুষের ধর্ম হতে পারে না। বরং, তিনি হয়তো একটা পথ বাতলে দেওয়ার চেষ্টা করতেন।
পথ এখনও পাওয়া যায়, যদি চাই। যেমন, তাঁর মারা যাওয়ার প্রায় চল্লিশ বছর পর আমি যেন আবার তাঁকেই দেখলাম, সাঁওতাল পরগনার লাঙ্গোপাহাড়িতে। সেই চেহারা, সেই ভঙ্গি। নাম জাটা হেমব্রম। দুমকা জেলার গোপীকান্দর ব্লকে কয়লার সন্ধান পেয়ে তখন সে অঞ্চলে ব্যবসায়ী-সরকার গোষ্ঠী মাতোয়ারা। কিন্তু, লোকেরা উৎখাত হতে রাজি হচ্ছিল না। টানাপড়েন। গোপীকান্দর লাঙ্গোপাহাড়ি থেকে বহু দূরে, কিন্তু খবর আসে। ছেলেছোকরাদের কেউ কেউ আধুনিক রাজনীতির সঙ্গেও জুড়ে গিয়েছে। তাদের কেউ এক জন আধুনিকদের শেখানো কথাগুলো বলছিল, “যদি যথেষ্ট ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়, তা হলে তো আপত্তি হওয়ার কারণ নেই; যেটা দেখার তা হল, দেওয়া কথাগুলো সরকার রাখছে কি না।” নানা জনের নানা কথা শুনে জাটা বলতে শুরু করলেন, গলাটা সেই আমার গড়ম-বা’র— “ক্ষতিপূরণ তো শুধু মানুষের হলে চলবে না। ধরতির যে ক্ষতিটা হবে, সেটা পূরণ করবে কী করে? ওখানে যে বন আছে, কার সাধ্য সেই বন আবার করে সিরজন করে? আর সিরজনই যদি না করতে পারো, তা হলে তোমাকে ওটা ধ্বংস করার অধিকার কে দিয়েছে? বন, পাহাড়, নদী-নালা, পশু-পাখি সবাইকে নিয়ে এই ধরতি। এর থেকে একটা কিছু কম হয়ে গেল মানে ধরতির গায়ে ততখানি খুঁত হয়ে গেল। এই সোজা কথাটা না বুঝলে চলবে?” কেউ এক জন বলল, “তা মাটির তলায় অত কয়লা আছে, সেগুলো অমনি পড়ে থাকবে?” জাটার আশ্চর্য সহজ উত্তর, “আছে বলেই তুলতে হবে? তোমার গায়ে খুব জোর, তাই বলে তুমি একে তাকে গুঁতিয়ে বেড়াবে? মাটির তলায় কিছু কেন আছে, তার মানে আমরা বুঝি? যে সিরজন করেছে সেই শুধু বোঝে। তার সঙ্গে কথা না বলে ও জিনিস তোলা যায় না।” পুবের পাহাড়টার দিকে হাত বাড়িয়ে জাটা বলেন, “ওই পাহাড়ে আমাদের ঠাকুরের ঘর, সে পাহাড়ে আমরা যদি গাছ কাটি, চাষ করি, কিংবা মাটির তলা থেকে কিছু তুলতে যাই, তা হলে ঠাকুর থাকবে কোথায়? পাহাড়টা আছে বলে ঠাকুর আছে, ঠাকুর আছে বলে আমরা আছি। সবার সঙ্গে কথা না বলে কিছু করা চলে না।”
ধনতান্ত্রিক লোভকেই আধুনিকতা বলে জানা লোকেরা চানা মুর্মু বা জাটা হেমব্রমের মতো সাঁওতালের কথাগুলোকে বুজরুকি বা বোকামি বলে উড়িয়ে দেবেন। তবে ভরসার কথা, জ্ঞানবান অনেক মানুষ আদিবাসী বিশ্বের কাছে জ্ঞানের জন্য হাত পাতছেন, বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে কথা বলা শিখতে চাইছেন। না শিখে উপায় নেই, প্রকৃতির নিকটতম প্রতিবেশী হিসাবে এঁরা যুগ-যুগ ধরে বেঁচে এসেছেন, প্রতিবেশ ব্যাপারটা এঁরাই জানেন। যখন ব্যবসায়ী-সরকার গোষ্ঠী কার্বন নিঃসরণ কমানোর মিথ্যা বাগাড়ম্বর করছে, আবার নদীকে বেঁধে, পাহাড় কেটে, বন আর মৃত্তিকা উজাড় করে উন্নয়নের ঢাকও পেটাচ্ছে, তখন আধুনিকতার স্বঘোষিত অগ্রবাহিনী নীরব। এমন অবস্থায় প্রকৃতিকে রক্ষা করার জন্য সারা পৃথিবী জুড়ে ছোট-বড় নানা আকারের আন্দোলন সংগঠিত করে আসছেন এই আদিবাসী সমুদয়— নিজেদের জন্য, এবং গোটা পৃথিবীর জন্য। যেমন, পৃথিবীর শ্বাসতন্ত্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ আমাজ়ন অঞ্চলে ওয়াওরানি জনজাতি তেল কোম্পানিগুলোর আক্রমণের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে এক দিকে রাস্তার আন্দোলন এবং অন্য দিকে আদালতের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে পাঁচ লক্ষ একর গভীর অরণ্য রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছেন। পাশাপাশি, আরও সাত লক্ষ একর অঞ্চলে তেল কোম্পানিগুলোর পা রাখা নিষিদ্ধ করাতে পেরেছেন। যদি সর্বত্রই এমন হত!
আপাত দৃষ্টিতে এই আন্দোলন আদিবাসীদের উৎখাত হওয়া আটকানোর জন্যই, কিন্তু এর পরিধি ব্যাপক— আমাজ়ন যদি না বাঁচে, তা হলে কি পৃথিবী বাঁচবে? আদিবাসীদের উচ্ছেদে ভৌত পৃথিবীর বিপন্নতার যোগাযোগের সঙ্গে আর একটা সংযোগ হল আদিবাসী মানুষের বসত, প্রাকৃতিক বৈচিত্র এবং ভাষা-সংস্কৃতিগত সমৃদ্ধির এক আশ্চর্য সমানুপাতিক সম্পর্ক। পৃথিবীর মোট ছ’হাজার সংস্কৃতি এবং সমসংখ্যক ভাষার বেশির ভাগটাই আদিবাসীদের। আবার, যে অঞ্চলের জৈব গুরুত্ব যত বেশি, সেই অঞ্চলে আদিবাসীদের বসবাসও তত বেশি। তাই ইকুয়েডরের পরিবেশ আন্দোলনের ওয়াওরানি নেত্রী নেমন্তে নেঙ্কিমো জোর দিয়েই বলতে পারেন, “আদিবাসীদের আন্দোলনগুলো হল সারা পৃথিবীকে রক্ষা করার আন্দোলন, এগুলোতে আদিবাসীদের স্বার্থের চেয়ে অনেক বেশি জড়িয়ে আছে সমগ্র মানব সমাজের স্বার্থ।” দুর্ভাগ্য, এই সহজ ব্যাপারটাকেও গুলিয়ে দেওয়ার জন্য অনেকে উন্নয়নের নামে ব্যবসায়ী-সরকার গোষ্ঠীর নায়েব-গোমস্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। কেউ আবার বিজ্ঞানের দোহাই দেন— প্রগতি বন্ধ রাখতে হবে? যেতে হবে না চন্দ্রাভিযানে?
চানা মুর্মু বেঁচে নেই, কিন্তু তাঁর উত্তরটা আছে— “নিশ্চয় যাবে, কিন্তু তার আগে চাঁদের সঙ্গে কথা বলতে হবে, জানতে হবে তুমি তার বাড়িতে যেতে পারো কি না।” যে বিশ্বপ্রকৃতি মানুষকে মানুষ করেছে, তার সঙ্গে কথা বলা কঠিন কিছু নয়। আর্তের চোখের জল মোছার জন্য নয়, আদিবাসীদের বঞ্চনার বিরুদ্ধে নাকিকান্নাও নয়, নিজের স্বার্থেই সমগ্র মানবপ্রজাতিকে সেটা করতে হবে। তার জন্য পরদ্রব্যলোভীদের চোখে চোখ রেখে বলতে হবে: “তোমরা নিপাত যাও।” স্পষ্ট বলতে শিখতে হবে, প্রকৃতির সম্পদে প্রকৃতির সকলের অধিকার, শুধু মানুষের না, ধনতন্ত্রীর তো না-ই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy