Advertisement
E-Paper

আমাদের ‘বালিকা বিদায়’

আজ বাংলায় পঞ্চায়েত সাধারণ মানুষের কাজে লাগতে অক্ষম। মানবাধিকার কমিশন নেই। মহিলা কমিশন রামপুরহাট পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না।

অনিতা অগ্নিহোত্রী

শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০২২ ০৪:৪১
Share
Save

১৯৭২ সালের মার্চ। মথুরা নামের এক জনজাতির নাবালিকা মহারাষ্ট্রের গঢ়চিরৌলী জেলার এক পুলিশ থানায় দুই পুলিশ কর্মীর দ্বারা ধর্ষিতা হয়। ঘটনার সময় সে পুলিশের হেফাজতে ছিল। যে বাড়িতে কাজের সূত্রে তার যাওয়া-আসা ছিল, সেই বাড়ির ছেলের সঙ্গে তার ভালবাসা হয়। বিয়ে করবে ঠিক করে দু’জন। বাদ সাধে মেয়েটির দাদা। নাবালিকাকে জোর করে অপহরণ করা হবে, এই অভিযোগে সে থানায় ডাকতে বাধ্য করে ছেলেটি ও তার বাড়ির লোককে। মিটমাট হয়ে গেলে সবাই ফিরে যায়, মেয়েটি রয়ে যায় পুলিশের হেফাজতে। সেখানেই দুই মত্ত পুলিশ কর্মী তাকে ধর্ষণ করে। সেশনস কোর্টের সিদ্ধান্তকে খারিজ করে, হাই কোর্টের নাগপুর বেঞ্চ পুলিশ কর্মীদের দোষী সাব্যস্ত করে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট এই আদেশ বাতিল করে তাদের বেকসুর খালাস করে দেয়। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা বলেন, মেয়েটি চিৎকার করেছিল বা বাধা দিয়েছিল, এমন কোনও প্রমাণ নেই। তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন নেই। কাজেই সে স্বেচ্ছায় নিজেকে সমর্পণ করেছে, এটা স্পষ্ট। কারণ হিসেবে বলা হয়, মেয়েটি শারীরিক সম্পর্কে অভ্যস্ত ছিল। মত্ত পুলিশকর্মীদের সে উত্তেজিত করে থাকবে। এই কলঙ্কজনক আদেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যায়। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের খোলা চিঠি লেখেন উপেন্দ্র বক্সী, লতিকা সরকার প্রমুখ। ‘ফোরাম এগেনস্ট অপ্রেশন অব উইমেন’ তৈরি হয়। দিল্লি মুম্বই হায়দরাবাদে নারী আন্দোলন কর্মীরা প্রতিবাদে শামিল হন। সেই প্রতিবাদের ফল ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট-এর ৪৩তম সংশোধন। ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট-এ এই মর্মে পরিবর্তন আনা হয় যে, যৌন সম্পর্কে সম্মতির প্রশ্নে আক্রান্ত মেয়েটির বিবৃতিই তদন্তের জন্য যথেষ্ট, অন্য কোনও প্রমাণ দরকার নেই।

৫০ বছর হয়ে গেছে আক্রমণের ঘটনাটির। প্রায় চার দশক পেরিয়েছে এই আইনি পরিবর্তন। নির্ভয়া কাণ্ডের পর ও জাস্টিস কমিশনের পরামর্শে এই আইনকে আরও শক্তিশালী করা হয়েছে। তার পিছনেও ছিল নারী আন্দোলনের বিরাট ভূমিকা। ২০১২ সালে শিশুদের যৌন অত্যাচার ও শোষণ থেকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য ‘পকসো আইন ২০১২’ পাশ হয়। আজ মনে হচ্ছে, যেন অর্ধশতাব্দী পথ পিছনে হেঁটে সেই ১৯৭২-এর থানায় পৌঁছলাম।

নদিয়ার মেয়েটি বালিকা ছিল। তার অধিকার ছিল পরিবার ও রাষ্ট্রের কাছে সুরক্ষা পাওয়ার। অর্থাৎ ধর্ষণে ‘সম্মতি’ দেওয়ার মতো বয়সেই পৌঁছয়নি সে। তদন্ত আরম্ভ হওয়ার আগেই যদি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর মুখে শোনা যায় ডিজির উদ্দেশে, ‘ওর তো অ্যাফেয়ার ছিল, না!’ হয়তো ‘প্রেগন্যান্ট ছিল’, শরীর খারাপ ছিল। অর্থাৎ বালিকার পুরুষবন্ধু ও তার সঙ্গীদের গায়ে ধর্ষণের মতো অপরাধের দাগ যেন না লাগে— এমনিতেই তারা শাসক দলের সমর্থক।

সারা দেশে মেয়েদের উপর যে আক্রমণের ঘটনা ঘটে তার অধিকাংশই চেনা পরিচিত লোকের হাতে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরোর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ৩৪০০০ ধর্ষণের ঘটনায় ৯৩ শতাংশ ঘটেছিল আত্মীয়স্বজন বন্ধু-পরিচিতদের হাতে। এই যুক্তিতে বৈবাহিক ধর্ষণ, প্রেমিক বন্ধু পরিজনের হাতে নিপীড়ন সবই মার্জনার যোগ্য হয়ে ওঠে। আক্রান্ত মেয়েটিকে দোষী ঠাওরানোও এক চেনা পদ্ধতি। বাংলায় আমরা সুজেট জর্ডানের ক্ষেত্রে দেখেছি। কামদুনির ভয়াবহ আক্রমণ ও হত্যাকাণ্ড পেয়েছে চরম শৈত্য ও ঔদাসীন্য। নারীর উপর আক্রমণকে রাজনৈতিক অস্ত্র বানানোর ধমকও দিয়েছিলেন এক জনপ্রতিনিধি। আর, তাপসী মালিকের দগ্ধ দেহ নিয়ে যাঁরা একদা সন্দেহের ক্রূর হাসি হেসেছিলেন, তাঁদের অনেকে মতার্দশের পাথার সাঁতরে এ পারে এসে উঠেছেন।

কিন্তু বিপুল জনসমর্থনে জিতে আসা সরকারের যদি তদন্তের আগেই মেয়েটির স্বভাব বা অভ্যাস নিয়ে মন্তব্য করতে হয়, সন্দেহভাজন যেখানে শাসক দলের কর্মী (এ রাজ্যে সকলেই শাসক দলেরই সমর্থক, এও শুনলাম) তা হলে তদন্ত ও বিচারের আশা নির্মূল হয়ে যায়। পরিসংখ্যান দেখার চেয়ে বেশি জরুরি সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহ, যা ধর্ষণের মতো অপরাধের ক্ষেত্রে সংগ্রহ করতে হবে কোনও বিলম্ব না করে। এই ঘটনায় রক্তাক্ত আহত মেয়েটিকে পথে পড়ে থাকতে দেখে তাকে নিয়ে আসেন এক জন, সঙ্গে দু’জন অনুসরণকারী। তখন কোনও অভিযোগ দায়ের করেনি পরিবার। অসুস্থ বালিকাকে রাতে কোনও স্থানীয় হাতুড়ের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়, সে মারা যায় পরের দিন। এমন এক শ্মশানে তাকে কেরোসিন ঢেলে পোড়ানো হয়, যেখানে কোনও পরিচয়পত্র বা ডেথ সার্টিফিকেট লাগে না।

হ্যাঁ, বাংলায় এমন শ্মশান এখনও আছে। আধারের সঙ্গে রেশন কার্ডের সংযুক্তি না হতে পারায় কয়েক লক্ষ দরিদ্র উপভোক্তা যেখানে প্রয়োজনীয় জিনিস পান না, সেখানে কোনও পরিচয়পত্র ছাড়াই কেরোসিনে এক বালিকার শরীর পোড়ানো যায়— এ এক গণতান্ত্রিক বিস্ময়। ছেলেটির বাবার রাজনৈতিক প্রতিপত্তিই এর পিছনে আছে, এমন সন্দেহ করা হচ্ছে।

আমাদের শিরদাঁড়া বেয়ে নামে হাড়হিম ভয়ের স্রোত, যখন একটি জনমজুর পরিবারের কোনও সুরক্ষা বা সাহায্য পাওয়ার পরিস্থিতি থাকে না শাসকের কাছ থেকে। পঞ্চায়েত থেকে প্রশাসন, থানা থেকে শ্মশান এমন ভাবে চোখ বন্ধ করে বসে আছে যে, চিকিৎসা, সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ, অভিযোগ করার জন্য সাহায্যের হাত, সামান্যতম সান্ত্বনাও পায়নি বালিকার পরিবার। স্বাধীনতার এত বছর পর আমরা যাবতীয় প্রতিষ্ঠানকে ভেঙেচুরে বিকল করে রেখেছি, যাতে পার্টির শাসন ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট না থাকে। বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার সময় বলা হয়েছিল “অভিযোগ করলে জ্বালিয়ে দেওয়া হবে ঘর।” গরিবের ঘর পোড়ানোর জন্য যে সাংগঠনিক পেশিশক্তি দরকার, তার প্রাবল্য আজ রামমোহন-বিদ্যাসাগরের বাংলায় সর্বত্র বিরাজমান। এমন ধমকের পর পরিবারটি আত্মরক্ষার্থে যা শ্রেয় মনে করেছে, তা-ই করেছে। সরকারি হাসপাতালে যায়নি, হাতুড়ের কাছে চিকিৎসার পর বালিকা সম্ভবত মারা গেছে রক্তক্ষরণেই। পুলিশ অভিযোগ নেয়নি। পরে চাইল্ড-লাইনের চেষ্টায় অভিযোগ দায়ের হয়। নথিপত্রবিহীন দাহের পর এখন সে বালিকা— ছাই।

না, ছাই বলেই যে নিষ্কৃতির যোগ্য, তা নয়। তার মৃত্যু-পূর্ববর্তী ব্যবহার বা স্বভাব, বন্ধুর বাড়িতে পার্টিতে যাওয়া, সবই তাকে তুলে দিয়েছে আক্রান্ত থেকে সন্দেহভাজনের ভূমিকায়। কে জানে সে উত্তেজিত করেছিল কি না এক বা একাধিক পুরুষকে, যারা হয়তো মত্ত ছিল— হলই বা তার বয়স চোদ্দো। আমাদের রাজনৈতিক ক্ষমতাজনিত অহঙ্কার এমন উন্মত্ততায় নিয়ে গেছে চৈতন্যকে, যে একটি বালিকাকে সুরক্ষা, সুবিচার, সম্মানজনক সৎকার, সব কিছু দিতে ব্যর্থ রাষ্ট্র এখন দেশের আইনের বিরুদ্ধে গিয়ে তার স্বভাব ও সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে। আমরা এমনই অধঃপাতে গিয়েছি। একটি আইনে পরিবর্তন আনা কত কঠিন, আমরা জানি। কত লড়াই, রক্ত-ঘাম-অশ্রু, পথ হাঁটা, অবস্থান, ধর্না আন্দোলনের পর এক দশক সময় লেগেছে ভারতীয় সাক্ষ্যপ্রমাণ আইনে ওই বদলটুকু আনতে। তখন জাস্টিস বর্মার মতো বিচারপতি ছিলেন না, যাঁর রিপোর্ট থেকেই নির্ভয়া কাণ্ডের পর উঠে এসেছিল ধর্ষণ আইন পরিবর্তনের সূত্রগুলি। এত পরিশ্রমে অর্জন করা নারীমুক্তি আন্দোলনের বিজয়কে নস্যাৎ করে সময়কে অর্ধশতাব্দী পিছিয়ে দেওয়ার স্পর্ধা দেখানো যায় কেবল নির্বাচনে বিপুল ভাবে জিতেই? মানুষের সমর্থনের উপর দাঁড়িয়ে ক্ষমতাহীনের সুরক্ষার প্রয়োজনকে এই ভাবে ব্যঙ্গ করা যায়? নেতা বা নেত্রীর কণ্ঠ কোনও বিচার্য বিষয় নয়— কথা বলছে টাকা ও পেশিশক্তির পুরুষতন্ত্র।

আজ বাংলায় পঞ্চায়েত সাধারণ মানুষের কাজে লাগতে অক্ষম। মানবাধিকার কমিশন নেই। মহিলা কমিশন রামপুরহাট পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। পুলিশ এফআইআর নেয় না। শিশু সুরক্ষা কমিশনের সদর্থক ভূমিকাটুকু কেবল ভরসা জোগায়। শনিবার চাইল্ড-লাইন উদ্যোগ করে অভিযোগ দায়ের করার পর, কমিশনের সদস্যরা নদিয়া পৌঁছন। কিন্তু এ দীপও অতি দ্রুত নিবে যেতে পারে ক্ষমতার বাতাসে।

বাংলার মেয়েদের অবস্থা কেমন? গ্রামবাংলায় ৪৮ শতাংশ মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায় নাবালিকা অবস্থায়। আজ নয়, বহু দিনই এ বিষয়ে ‘এগিয়ে’ বাংলা। করোনার পর দারিদ্র ঘনীভূত। নাবালিকা বিবাহ, কন্যা পাচার বেড়েছে। মেয়েরা সুরক্ষিত নয়— এই ধারণা বদ্ধমূল থাকলে কখনও এই ‘বালিকা বিদায়’-এর প্রবণতা কমবে না। এর ফল পরের প্রজন্মের জন্য ভয়াবহ। অল্প বয়সের মাতৃত্ব, অপরিণত শিশু, অপুষ্টিগ্রস্ত শৈশবের দুষ্টচক্র। নির্বাচনের রাজনীতি, ক্ষমতার খেলা থেকে মেয়েদের আর কিছু পাওয়ার নেই। আর বিদ্বজ্জনেরা? দ্যূতসভার রাজন্যবর্গের মতো মূক থাকবেন, পাছে সমালোচনায় বিরুদ্ধ দলের হাত শক্ত হয়ে ওঠে।

স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে বাম আন্দোলন, তেভাগার উত্তরাধিকার বহন করে হয়তো নারী আন্দোলনের কর্মীরাই এখনও আমাদের ভরসা। আর ভরসা, বাংলার সাধারণ মানুষ, দৈনন্দিন জীবনে যাঁরা নারী-পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রুজির লড়াই লড়ছেন। টাকা, তোলা, পাচারের অর্থনীতির নীচে অদৃশ্য, জীবন্ত এক রণকৌশল আছে। ঠিকানাবিহীন শ্মশানের ছাইয়ের নীচে এখনও জেগে আছে আগুন।

Women Rape case Law Justice Government police Women Harassed

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

ক্যানসেল করতে পারবেন আপনার সুবিধামতো

Best Value
প্রতি বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

প্ল্যানটি সিলেক্ট করে 'Subscribe Now' ক্লিক করুন।শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
প্রতি মাসে

৪২৯

১৬৯

প্ল্যানটি সিলেক্ট করে 'Subscribe Now' ক্লিক করুন।শর্তাবলী প্রযোজ্য।