একটা সময় ছিল, যখন সরকারি চাকরি মানেই ছিল পাকা চাকরি। এক বার ঢুকলে একেবারে অবসর নিয়ে তবে বেরোনো, এই নিশ্চয়তার আশ্বাসেই তরুণ-তরুণীরা সরকারি চাকরির পরীক্ষায় বসতেন, মেয়ের জন্য সরকারি চাকুরে পাত্রের খোঁজ করতেন বাবা-মা। আজ সরকারি সংস্থাগুলিও ঠিকাদারের মাধ্যমে কর্মী নিয়োগ করছে। ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে নিযুক্ত কর্মীদের কাজের নিরাপত্তা নেই, নির্দিষ্ট বেতন পরিকাঠামোও নেই। দীর্ঘ দিন দক্ষতার সঙ্গে কাজ করার পরেও মুহূর্তের মধ্যে তাঁরা ছাঁটাই হয়ে যেতে পারেন, কোনও কারণ ছাড়াই।
ঠিকায় নিযুক্ত কর্মীদের কি কাজের নিরাপত্তার অধিকার নেই? প্রশ্নটি উঠেছে দিল্লি হাই কোর্টে। কর্মচারী রাজ্য বিমা নিগম বা ইএসআইসি-পরিচালিত একটি হাসপাতালে সম্প্রতি ঠিকাদারের পরিবর্তন হয়। পুরনো ঠিকাদার নিযুক্ত সব কর্মীকে বরখাস্ত করেন নতুন ঠিকাদার। বরখাস্ত শ্রমিকদের দায় নিতে অস্বীকার করে ইএসআইসি। ঠিকা শ্রমিকরা দিল্লি হাই কোর্টে পুনর্নিয়োগের আর্জি জানান। বিচারপতি প্রতিভা সিংহ এই মামলায় অর্ন্তবর্তী রায় দিতে গিয়ে বলেছেন, ঠিকাদার পরিবর্তন হলেও চুক্তি শ্রমিকদের স্বার্থ সম্পূর্ণ সুরক্ষিত রাখতে হবে, এবং ইএসআইসি-কে চুক্তি শ্রমিকদের জন্য যথাযথ নীতি প্রণয়ন করতে হবে।
ঠিকাদার বদল হতে চুক্তি শ্রমিকদের গণছাঁটাই নতুন কিছু নয়। তবু এই মামলার দিকে নজর যায়, কারণ সংস্থাটি ইএসআইসি, যা সরকারি ও বেসরকারি শিল্প শ্রমিক-কর্মচারীদের সুচিকিৎসা দানের মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তৈরি হয় (১৯৪৮)। সারা দেশে ইএসআইসি গড়ে তুলেছে দেড় হাজারেরও বেশি ডিসপেনসারি ও ১৬০টি হাসপাতাল। সাড়ে তেরো কোটির কিছু বেশি শ্রমিক-কর্মচারী চিকিৎসা পাওয়ার জন্য নথিভুক্ত। এই ইএসআই হাসপাতালগুলিতেই ক্রমাগত ঠিকা, অস্থায়ী ও চুক্তি শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। কেবল সাফাইকর্মী, নিরাপত্তা কর্মী, সহায়ক গ্রুপ ডি কর্মীদেরই ঠিকাদারের মাধ্যমে নেওয়া হচ্ছে, এমন নয়। প্যারামেডিক্যাল কর্মী, ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ান, কম্পিউটারে ডেটা এন্ট্রি বা কেরানির পদেও চুক্তিতে নিয়োগ হচ্ছে। ইএসআইসি-র নিজস্ব নার্সিং ও মেডিক্যাল কলেজ থাকলেও হাসপাতালে নার্স ও ডাক্তার নিয়োগ হচ্ছে চুক্তিতে। ‘অ্যাডিশনাল কমিশনার’-এর মতো আধিকারিক পদেও বসছেন অবসরপ্রাপ্তরা, চুক্তির ভিত্তিতে।
এই চিত্র দেশের সর্বত্র। কারখানা এবং অন্যান্য শিল্প উৎপাদন সংস্থায় স্থায়ী কর্মীদের সংখ্যা কমছে, দ্রুত বাড়ছে অস্থায়ী শ্রমিক। যুক্তি হল, এই নমনীয়তা শিল্পের প্রয়োজন। বাজারে পণ্যের চাহিদা ওঠা-নামা করে, কিন্তু যখন চাহিদা কম, তখন শ্রমিক কমানো কঠিন হয়। কারণ, ভারতে চুক্তি শ্রমিক আইন (১৯৭০) অনুসারে কুড়ি জনের বেশি (নতুন শ্রমবিধি অনুসারে, তিনশো জন) শ্রমিক নিয়োগ করে যে সংস্থা, তাকে শ্রমিক ছাঁটাই করতে হলে রাজ্য সরকারের অনুমোদন নিতে হবে। এটা এড়াতে নিয়োগকারীরা অস্থায়ী কর্মী নিচ্ছেন অনেক দিন। আইন এখন নিয়োগকারীর দিকেই ঝুঁকেছে। ‘ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট অ্যাক্ট’ বা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কর্মী নিয়োগ আইনে (২০১৮) বলা হয়েছে, চুক্তি ফুরোলে কোনও কারণ না দর্শিয়েই ছাঁটাই করা যাবে কর্মীদের। কিন্তু আইনে এ-ও বলা হয়েছে যে, অস্থায়ী কর্মীদের পারিশ্রমিক, ছুটি, কর্মক্ষেত্রে সুবিধা প্রভৃতি সবই স্থায়ী কর্মীদের সমান হতে হবে। শ্রম বিধি (২০২১) আইনেও মধ্যে চুক্তির ভিত্তিতে নিযুক্ত শ্রমিক-কর্মচারীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলি ‘পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য’ শিরোনামে উল্লেখ করা আছে। বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য অপরিহার্য দৈনন্দিন কাজগুলি শুধুমাত্র ঠিকা শ্রমিক দিয়ে করানো যাবে না। স্থায়ী শ্রমিক-কর্মচারীদের সংখ্যা প্রয়োজনের কম থাকলে ঠিকাদার চুক্তি শ্রমিক নিয়োগ করতে পারে, কিন্তু বেতন বৈষম্য থাকবে না, এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।
আক্ষেপ, আজ কেন্দ্র ও রাজ্য স্তরের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও শিল্প সংস্থা আইনের এই নির্দেশকে এড়িয়ে গিয়ে, কেবল ইচ্ছেমতো বেতন, ছাঁটাইয়ের সুবিধার জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ করছে। অস্থায়ী কর্মীরা বৈধ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সম্প্রতি কিছু সমীক্ষা হয়েছে ঠিকা শ্রমিক নিয়োগের নমনীয়তার সঙ্গে শিল্পগুলির লাভের হার মিলিয়ে দেখতে। দেখা গিয়েছে, শ্রমিক-প্রধান শিল্পের চাইতে পুঁজিপ্রধান শিল্পে ঠিকা শ্রমিক ব্যবহার হচ্ছে বেশি, এবং ঠিকা শ্রমিকের স্বল্প বেতনের সুযোগ দিয়ে স্থায়ী শ্রমিকদের বেতনও কমানোর ঝোঁক দেখা গিয়েছে। বর্তমানে একই কাজে নিযুক্ত হয়েও, এবং একই পরিমাণ কাজ করা সত্ত্বেও, ঠিকা কর্মীর চাইতে স্থায়ী কর্মীর মাইনে অন্তত দেড়গুণ বেশি।
সমকাজে সমবেতন, শ্রমিক কর্মচারীদের সামাজিক সুরক্ষা ইত্যাদি আইনের বইতেই লেখা আছে। আইনকে কাজে পরিণত করার দায় অস্বীকার করেই প্রশাসন চলছে। যে রাজ্য সরকারগুলি নিজেদের প্রগতিশীল, দরিদ্রবন্ধু বলে দাবি করে, তারাও চুক্তি ও অস্থায়ী শ্রমিক-নিয়োগেই প্রাধান্য দিচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে দিল্লি হাই কোর্টের অন্তর্বর্তিকালীন রায়টি গুরুত্বপূর্ণ। আদালতের নির্দেশ, বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে ইএসআইসি সংস্থার শ্রমিক নিয়োগের সুষ্ঠু নীতি নির্ধারণ করতে হবে, যা সার্বিক ভাবে সংস্থা অনুসরণ করবে। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি যে ভাবে ঠিকাদার নিয়োগ করে, আর ঠিকাদারেরা যে ভাবে উপ-ঠিকাদার (থার্ড পার্টি সাব-কন্ট্রাক্টর) নিয়োগ করে, সেই পদ্ধতিও খতিয়ে দেখতে হবে কমিটিকে। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির প্রতি এই নির্দেশ সরকারি এবং বেসরকারি, সকল
ক্ষেত্রেই শ্রমিকদের প্রতি ন্যায্য ব্যবহারের বার্তা বহন করছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy