স্বাধীনতা-সন্ধানী: নন্দলাল বসুর ছবি নটীর পূজা।
আজ থেকে একশো বছর আগে আমার দিদার বয়স ছিল পনেরো কি ষোলো। নতুন বৌ হয়ে মফস্সল শহরের শ্বশুরবাড়ি এসেছেন। ক্রমে অবলাবালার দশ ছেলেমেয়ে হল, গোয়ালে গরু, কর্তার কাছারি ঘরে মক্কেলের ভিড়। যখন বিধবা হয়ে কলকাতায় ছেলেদের সংসারে এলেন, তত দিনে বদলে গিয়েছে জগৎটা। মেয়েদের আর ঝটপট বিয়ে হয় না। মা আর ছোট মাসি গ্র্যাজুয়েট হলেন, তার পর ‘অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ’-হওয়া হাউসওয়াইফ হলেন, সন্তানসংখ্যা এক লাফে দশ থেকে নেমে দুই। তাঁদের মেয়েরা, অর্থাৎ আমাদের প্রজন্ম, লুকিয়ে প্রেম, প্রকাশ্যে বিয়ে সেরে রোজগেরে গিন্নি। আর আমাদের কন্যারা ভেবেই পায় না, প্রেম কিংবা সেক্সের সঙ্গে বিয়ের কী? যাদের মায়েরা সন্ধের আগে বাড়ি না ফিরলে বিস্তর বকুনি খেত, সেই মেয়েরা এখন ক্যাম্পাসে রাত-কার্ফুর বিরুদ্ধে লড়াই করছে। ছেলেরা রাতে বাইরে থাকবে, মেয়েরা পারবে না কেন?
এই কি বাঙালি মধ্যবিত্ত মেয়ের গল্প নয়? সময়ে একটু হয়তো উনিশ-বিশ— কারও দিদিমা-ঠাকুমা প্রথম ইস্কুলে পড়িয়েছেন, কি মিছিলে হেঁটেছেন, কি গান গেয়েছেন মঞ্চে, কারও বা মা-কাকিমা। কিছু আগে আর পরে। তাতে কী, মেয়েদের পথ তো সোজা নয়। সে যেন পাকদণ্ডী, বাঁকে বাঁকে দেখা হয়। চড়াই উতরাই পেরোতে ঘাম ঝরে, পা হড়কায়। তবু কোনও এক বিস্মৃত জননী যে কথা দিয়েছিল নিজেকে, নিজের দেশকে, সেই প্রথম প্রতিশ্রুতি স্মরণ করে ঘরের চাবি ব্যাগে পুরে বেরোয় মেয়েরা। আর একটু পথ, আর একটু উচ্চতা।
না কি, ঠিক তেমন সমুখ-যাত্রা হয়নি মেয়েদের? ফিরে দেখলে বোঝা যায়, কত পথ শুরু হয়েও হারিয়ে গিয়েছে। অবলাবালা যখন কোরা কাপড়ে দুধে-আলতার পদচিহ্ন এঁকে নতুন সংসারে ঢুকছেন, সেই ১৯২১-২২ সালে কলকাতার মেয়েরা পিকেটিং করছে বড়বাজারে। বিদেশি কাপড় চলবে না। ব্যবসায়ীরা নারী সত্যাগ্রহী সমিতির সদস্যদের দেখিয়ে নিয়ে গাঁটরি বাঁধে, হকার বিনা পয়সায় লেমনেড খাওয়ায়। গোড়ায় পাত্তা না দিলেও, পরে চটল ইংরেজ। যে দিন লাঠিচার্জ হল, সেই রাতে “দেশীয় পুলিশ দলকে অপসারিত করিয়া এক দল গোরা সৈনিক প্রেরিত হইল,” লিখছেন সরলাবালা সরকার। তাদের লাগামহীন লাথি-ঘুষিতে ছত্রভঙ্গ, বিপর্যস্ত হল মেয়েরা। তবু মিছিল চালু রইল। মেয়েরা পতাকা হাতে পথে নামলেই হাজার হাজার লোক যোগ দেয়। তারা গিয়ে দাঁড়ালে মেয়েরা গয়না খুলে দেয়। শেষে পঞ্চাশ জন সত্যাগ্রহী মেয়েকে জোড়াবাগান কোর্ট এক সঙ্গে জেলে পাঠাল, নিষিদ্ধ করল নারী সত্যাগ্রহী সমিতিকে। সে দিন কী আনন্দ মেয়েদের! তাদের ভয় পেয়েছে ইংরেজ, এ বার স্বরাজ এল বলে।
কেবল কংগ্রেসের পথে নয়, অনেক মেয়ে নিজেই পথ তৈরি করেছিল। ১৯২১-২২ সালে সন্তোষকুমারী দেবী একের পর এক চটকলে শ্রমিকদের সংগঠিত করছেন, নেতৃত্ব দিচ্ছেন, মামলা করছেন ক্ষতিপূরণ চেয়ে। কংগ্রেস বা কমিউনিস্ট, কোনও দল সঙ্গে নেই। নিজেই নাইটস্কুল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র খুললেন মজুরদের জন্য। ১৯২৪ সালে শ্রমিক পত্রিকা বার করলেন, দাম এক পয়সা। খুব চলল কাগজ, কিন্তু ছাপাখানার বিল মেটাতে নেকলেস বাঁধা রাখতে হল। কত গল্প তাঁকে নিয়ে— এক বার তাঁর ঘোড়ার গাড়িতে চড়াও-হওয়া গুন্ডাদের নাকি চাবুক চালিয়ে হটিয়েছিলেন। আর এক বার বন্ধ মিলের সামনে মজুরদের জটলা দেখে পাঁচিল টপকে ভিতরে ঢুকে মালিককে ধমকে গেট খুলিয়েছিলেন সন্তোষকুমারী। এমনি করে দশের জীবনে মেয়েদের প্রবেশের দরজা খুলেছিল। তাঁর পথ ধরে শ্রমের ন্যায্য মূল্য না-পাওয়া মজুর, ফসলের ন্যায্য ভাগ না-পাওয়া ভাগচাষি, জমির স্বত্ব-হারানো খেতমজুরের জন্য কত মেয়ে এগিয়ে এসেছেন। লাঠি খেয়েছেন, জেল খেটেছেন, অকথ্য পুলিশি নির্যাতন সয়েছেন, সংসারেও খোঁটা শুনেছেন। সাবিত্রী রায়, মহাশ্বেতা দেবী, জয়া মিত্র, মীনাক্ষী সেনের লেখা পড়ে আভাস মেলে সে সব জীবনের।
মেয়েদের লড়াই চিরকাল ঘরে-বাইরে। কস্তুরবা-বাসন্তী দেবীর দেখাদেখি, পুরুষদের পাশাপাশি মেয়েরা পথে নামল বটে। কিন্তু অচিরে বুঝল, স্বরাজ বস্তুটি কেবল বাইরের নয়। নিজের ঘরে যে পরাধীন, তার আবার স্বাধীনতা কী? ১৯২৮ সালে কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে মেয়েরা আলাদা সভা করে দাবি করল, ডিভোর্সের অধিকার চাই, সম্পত্তির উত্তরাধিকার চাই। সেই তরুণ তুর্কিদের এক জন ছিলেন বাঙালি— রেণুকা রায়ের বয়স তখন মাত্র ২৪ বছর। এক ব্রাহ্ম মহিলা তো তাঁকে বলেই বসলেন, এই তো বছর দুয়েক বিয়ে হয়েছে, এখনই ডিভোর্স? লেডি অবলা বসুও নাকি সে দিন রেণুকাদের পাশে ছিলেন না। হয়তো গৃহবধূ অবলাবালা মুখুজ্জেও সুযোগ পেলে কষে ধমক দিতেন ওই মেয়েদের। তিনি তো তখন জানতেন না, ভবিষ্যতে অসুখী দাম্পত্য থেকে হিন্দু কোড (১৯৫৬) যাঁদের মুক্তি দেবে, তাঁদের মধ্যে থাকবে তাঁর নিজের ক’জন নাতনি-নাতবৌও।
তেমন এক নাতনির ‘দোষ’ ছিল, সে নৃত্যশিল্পী। মেয়েদের নাচের ব্যাপারে ভদ্রলোক বাঙালির এমন গেল-গেল ভাব ছিল যে, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নড়ে বসেছিলেন। নটীর পূজা নাটক কেবল মেয়েদের জন্য লিখেও, শেষে বৌদ্ধ সন্ন্যাসী উপালির চরিত্র ঢোকালেন। ছেষট্টি বছর বয়সে জোড়াসাঁকোর মঞ্চে উঠলেন, যাতে ছাত্রীদের বদনাম না হয়। শেষরক্ষা হয়নি। অহীন্দ্র চৌধুরী লিখছেন, “মঞ্চে ভদ্রমহিলার নাচ দেখলাম আমরা সেই প্রথম... নবীনেরা হৈ হৈ করে উঠলেন, প্রশংসায় স্বতঃস্ফূর্ত। আর, প্রবীণেরা হয়ে উঠলেন নিন্দায় মুখর।” অনুষ্ঠানের পরে পরেই প্রধান অভিনেত্রীরা বিয়ে করে নাচ ছাড়লেন। তবু ভদ্রপল্লিতে নাচ প্রবেশ করল। শান্তিনিকেতনের নৃত্যচর্চা এল কলকাতাতেও, ক্রমে মমতাশঙ্কর, মঞ্জুশ্রী চাকী সরকার মেয়েদের নিজস্ব সৃষ্টিশীলতার স্বাক্ষর রাখলেন মঞ্চে। পুত্রবধূর শিল্পচর্চার পরিবেশ আজও অধিকাংশ সংসারে মেলে না— বাণী বসুর গান্ধর্বী স্মরণীয়— তবু ভিরমি-খাওয়া ভাবটা গিয়েছে। তাতে একটা মস্ত বাধা দূর হয়েছে। আজ পুজোমণ্ডপে, বিসর্জনের মিছিলে মেয়েদের আনন্দ-উচ্ছ্বাস প্রকাশের স্বাধীনতা কত না ভর্ৎসনা-অপবাদের সেতু বেয়ে এসেছে।
তবে কাঁথার দুই পিঠের মতো, এই ইতিহাসের দুটো নকশা। অহীন্দ্রকে রবীন্দ্রনাথ নটীর পূজা অভিনয়ের অনুমতি দেননি। তিনি ‘ভদ্রমহিলার নাচ’-কে বাংলার রঙ্গমঞ্চের নটীদের ছোঁয়াচমুক্ত রাখতে চেয়েছিলেন, বলেছেন অহীন্দ্র। ভদ্রমহিলারা গান-নাচের চর্চা শুরু করল, পঞ্চাশের দশকে বামপন্থী সংগ্রাম-করা মেয়েরা নাটকের মঞ্চে উঠল। পেশাদার অভিনেত্রীরা ক্রমে শুধু ‘বেশ্যা’ পরিচয়ে বেঁচে রইলেন। নব্বইয়ের দশকে মোড় ঘুরল, যখন সোনাগাছির মেয়েরা ঘোষণা করলেন, বেশ্যাবৃত্তিকে পেশার স্বীকৃতি, আর তাঁদেরকে শ্রমিকের স্বীকৃতি দিতে হবে। তখন সে কী শোরগোল! এডস রুখতে গিয়ে শেষে কি সমাজ-সংসার ভেঙে পড়বে? অমর্যাদার অধিকার একশো বছর আগে দিব্যি ছিল পুরুষের হাতে। আর এখন? শ্রমিকের মর্যাদা চায় বেশ্যা, রূপান্তরিত পুরুষ আজ মেয়ের স্বীকৃতি চায়। চিত্রকর ইলিনা বণিক আইভিএফ-এর সাহায্যে পুত্রের একক মা হয়েছেন, বিশ্বসুন্দরী সুস্মিতা সেন বিয়ে না-করেই দত্তক নিয়েছেন দুই মেয়েকে। অবলাবালার এক নাতবৌও যমজ কন্যাসন্তান দত্তক নিয়ে ভারী খুশি। মাতৃত্বের সঙ্গে বিয়ের কী? আর, গর্ভের সঙ্গে মাতৃত্বের কী? এ সব কাণ্ড দেখে ‘মা-মা’ ডাক-ছাড়া বাঙালিকেও আজ ভাবতে হচ্ছে— মাতৃত্বের সঙ্গে মর্যাদার কী?
যে মেয়েরা সংসার-মাতৃত্বের ঘেরাটোপ থেকে বাইরে এসেছিল, তাদের উত্তরসূরিরা আজও নিজেদের জায়গা করে নেওয়ার লড়াই করছে। মনে করুন বাংলার পদ্মপুকুর। কিছু মেয়ে সেখানে তাদের প্রতিভার ছটায়, ব্যক্তিত্বের শক্তিতে, কাজের কুশলতায় দশ দিক আলো করে ফুটে আছে। তারা নিজেকে দিয়ে সব মেয়ের জন্য পূর্ণ মানুষের সম্মান দাবি করে চলেছে। অগ্রাহ্য করার হিম্মত কারও নেই। কত না সুরভিত শতদল এই অমৃতহ্রদে। আর, তাদের ঘিরে আছে আরও অগণিত মেয়ে, ছায়ামাখা জলে পাতা-মৃণাল-শিকড়ের মতো। তাদের জীবন আলাদা করে ঠাহর করা যায় না। মৃত্যুও না। মণিকুন্তলা সেন উত্তরবঙ্গে তেভাগা আন্দোলনের এক গ্রামে দেখেছিলেন, পুলিশের গুলিতে নিহত এক গর্ভবতী বধূর বুকের রক্ত যেখানে পড়েছিল, সেই মাটিটুকু একটা ঝুড়ি চাপা দিয়ে রাখা আছে। মেয়েরা সেখানে সন্ধ্যাবেলা একটা প্রদীপ দেয়।
ব্যস, ওইটুকুই। মন্বন্তর, তেভাগা, দেশভাগ, খাদ্য আন্দোলন, জমিরক্ষার লড়াইয়ের নামহীন মেয়েদের স্বীকৃতি ওই মৃদু, করুণ আলো। গাঢ় অন্ধকারে জেগে-থাকা এক অনির্বাণ প্রশ্নচিহ্ন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy