Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
educational institution

নির্যাতনের অন্ধকার শিক্ষাঙ্গনেও

শিক্ষাক্ষেত্রে মেয়েদের নিগ্রহ এবং নিগ্রহকারী হিসাবে শিক্ষকদের নাম উঠে আসা গভীর উদ্বেগের।

তূর্য বাইন
শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৮:২৮
Share: Save:

বছরের প্রথম দিনে খবর ছিল, পিএইচ ডি স্কলার ও তাঁর প্রেমিক খুন করেছেন অধ্যাপককে। অভিযোগ, প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ায় অধ্যাপকটি ছাত্রীকে হেনস্থা করছিলেন এবং তাঁকে বিয়ে না করলে ব্যক্তিগত ছবি সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দেবেন বলে ভয় দেখাচ্ছিলেন। খবরটা পড়ে রাজ্যের এক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর কথা মনে পড়ে গেল। জানতে চেয়েছিলাম, কোন অধ্যাপকের অধীনে সে এম ফিল করবে, ঠিক হয়েছে কি না। সে সসঙ্কোচে বলেছিল, “যতটা জেনেছি, সম্ভাব্য অধ্যাপকদের মধ্যে মাত্র এক জনই ‘নিরাপদ’!”

শিক্ষাক্ষেত্রে মেয়েদের নিগ্রহ এবং নিগ্রহকারী হিসাবে শিক্ষকদের নাম উঠে আসা গভীর উদ্বেগের। দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে মেয়েদের প্রতিনিধিত্ব ছেলেদের তুলনায় যথেষ্ট কম। অবৈতনিক উচ্চশিক্ষা-সহ নানা প্রকল্পে নারীশিক্ষায় নিরন্তর উৎসাহদানের কর্মসূচি সত্ত্বেও স্কুলছুট ও বাল্যবিবাহ ঘটেই চলেছে। এম ফিল, পিএইচ ডি, পোস্ট ডক্টরাল গবেষণার ক্ষেত্রে গবেষকদের সাফল্য অনেকটাই গাইডের উপর নির্ভর করে। পরে চাকরির ক্ষেত্রেও তাঁদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব থাকে। এ সব কারণে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এই ধারণা জন্ম নেয়, গাইড অধ্যাপকের কাছে আনুগত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়াটা অবশ্যকর্তব্য। কিছু নীতিবর্জিত শিক্ষক এই সুযোগ নিয়ে শিক্ষাঙ্গন ও শিক্ষককুলকে কালিমালিপ্ত করেন।

২০১৮ সালে লন্ডনের গবেষক-ছাত্রী অদ্রিজা দে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিলেন, তিনি লিঙ্গভিত্তিক হিংসা ও যৌন নির্যাতন সংক্রান্ত গবেষণার কাজে ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি পরিদর্শন করেন। একটাও বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ধান পাননি, যেখানে ছাত্রী-সহ মহিলা শিক্ষাকর্মীরা সম্পূর্ণ সুরক্ষিত বোধ করেন। তাঁর আরও দাবি, এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির দায়বদ্ধতা, অভিযোগ নিরসন পদ্ধতি ও ক্ষমতাবিন্যাস নিয়ে বিস্তর বিতর্কের পরেও অবস্থার বিশেষ হেরফের হয়নি। নির্যাতনকারীরা ক্ষমতায় থেকে পড়িয়ে যাচ্ছেন এবং সন্দেহ, দোষ পড়ছে নিগৃহীতাদের উপর।

কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের যৌন হেনস্থা প্রতিরোধে ১৯৯৭ সালে বিশাখা গাইডলাইন প্রণীত হলেও শিক্ষা-সহ বহু ক্ষেত্রে তা কার্যকর করার বিষয়ে ছিল চরম অনীহা। ২০১২-তে দায়ের করা জনস্বার্থ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট রাজ্য সরকারগুলিকে এই গাইডলাইন কঠোর ভাবে কার্যকর করার নির্দেশিকা জারি করে। ২০১৩ সালে কার্যকর হয় কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা (প্রতিরোধ, নিবারণ ও অভিযোগ নিষ্পত্তি) সংক্রান্ত আইন।

এই আইনের উপর ভিত্তি করে শিক্ষাঙ্গনে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের এক গুচ্ছ নির্দেশিকা মেনে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে ‘ইন্টারনাল কমপ্লেন্টস কমিটি’ (আইসিসি) বা ‘কমিটি এগেনস্ট সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট’ (ক্যাশ) গঠিত হয়েছে। তবু অধিকাংশ ছাত্রী সাহস করে কমিটির কাছে অভিযোগ জানাতে যাচ্ছেন না। ৫০০ জন মহিলাকে নিয়ে করা এক সমীক্ষায় দেখা যায়, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে নিগৃহীতাদের ৪০.৩১ শতাংশই অপমানের কথা গোপন রেখেছেন। আইসিসি-তে অভিযোগ করেছেন নামমাত্র। এর অন্যতম কারণ হিসাবে অদ্রিজা লিখেছেন, কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী প্রোক্টরের কাছে নির্যাতিত হয়ে আইসিসি-র কাছে গিয়ে জানতে পারেন, প্রোক্টর-ই ওই কমিটির প্রধান, আবার স্টুডেন্টস’ গ্রিভ্যান্স সেল-এরও প্রধান। অনিবার্য কারণে তাঁর অভিযোগপত্রটি গৃহীত হয়নি।

মুখ বুজে অত্যাচার হজম করা বা নীরবে শিক্ষাঙ্গন ত্যাগের কারণ হিসাবে অসুরক্ষিত ক্যাম্পাস, নিগ্রহকারীর অমিত ক্ষমতার পাশাপাশি দায়ী পারিপার্শ্বিক চাপ ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেয়েটিকেই দোষ দেওয়া হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পরিবার— এই প্রবণতা সর্বত্র। শুরু হয় রাজনৈতিক চাপানউতোর, কুৎসিত ট্রোল। কেরিয়ারের অনিশ্চয়তা তো আছেই। সাহস করে কেউ কেউ এগিয়ে এলেও নানা চাপের মুখে তাঁদের একটা বড় অংশ মাঝপথে পিছু হটতে বাধ্য হন।

অবস্থা কিছুটা বদলাচ্ছে ‘মি টু’ আন্দোলনের হাত ধরে। রাজনীতির মারপ্যাঁচ, সমাজের রক্তচক্ষু এবং নিগ্রহকারীর পরাক্রম উপেক্ষা করে নির্যাতিতারা মুখ খুলতে শুরু করেছেন। এই আন্দোলন নিয়েও বিতর্ক, কেউ কেউ মেয়েদের এই প্রতিবাদী কণ্ঠকে মনোযোগ আকর্ষণ বা রাতারাতি বিখ্যাত হওয়ার কৌশল বলেও কটাক্ষ করছেন। কারও মতে এটা ব্যক্তিস্বার্থ বা অসূয়া চরিতার্থ করার হাতিয়ার। প্রমাণিত হওয়ার আগেই কুৎসা ছড়িয়ে পড়ায় নির্দোষ মানীর সম্মানহানির আশঙ্কাও অমূলক নয়।

তবু অনেকেই মানছেন, যৌন নিগ্রহের বিরুদ্ধে মেয়েদের এই সরব প্রতিবাদের গুরুত্ব অপরিসীম। দীর্ঘ কাল ধরে চলে আসা যৌন শোষণ রোধে এর চাইতে কার্যকর আয়ুধ আর কী-ই বা হতে পারে! সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিরও বদল প্রয়োজন। ভবিষ্যতে নিগৃহীতার নিকটজনকে যেন তপন সিংহের আদালত ও একটি মেয়ে ছবির জনকৌতূহলে বিপর্যস্ত বাবার মতো ‘আমার ধর্ষিতা কন্যা ভাল আছে’ জাতীয় প্ল্যাকার্ড বানাতে না হয়।

অন্য বিষয়গুলি:

educational institution sexual harassment
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy