এ খুব মুশকিল কিন্তু। সাহিত্যে নোবেল পাওয়া লেখকের বই-ই যদি বিশ্ববাজারে না পাওয়া যায়, এই ২০২১-এও অনলাইন বইদোকানেও মেরেকেটে একটা-দুটোর বেশি না মেলে, সে কেমন একটা ভ্যাবাচ্যাকা ব্যাপার না? আন্তর্জাতিক বই-বিক্রেতাদের অবস্থা লেজেগোবরে করে ছেড়েছেন আব্দুলরাজ়াক গুরনা। নোবেলজয়ী লেখকের বইয়ের বিক্রি হাউইয়ের মতো ওঠে, জানা কথা। কিন্তু এ কেমন বই, এক ব্রিটেন ছাড়া আমেরিকাতেও মেলে না, অন্য ভাষায় যে বইদের অনুবাদ হয়নি বললেই চলে? তারও বড় কথা, এ কোন লেখক, যাঁর নামটা অবধি একেবারে অজানা, ৭ অক্টোবর নোবেল কমিটির ঘোষণা ইস্তক পাঠকবিশ্বকে যিনি চূড়ান্ত অস্বস্তি আর অস্তিত্বসঙ্কটে ফেলেছেন?
এই অস্বস্তি— ‘বিরাট’ লেখককে না জানার অস্বস্তি, তাঁর কলমকে না চেনার অপরাধবোধ। ১৯১৩ সালের পৃথিবীকে অনেকটা যে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামের এক ভারতীয় তথা এশীয় তথা অ-শ্বেতাঙ্গ, সাহিত্যে নোবেল বাগিয়ে। সাহিত্যে নোবেল মানে একটা অন্য রকম ব্যাপার। সেই সময়ের বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কলমকে সম্মান জানানো হচ্ছে, এ রকম একটা ধারণা। কোত্থেকে তার আগের বছর এক সাধু-সাধু দেখতে লোক এল ইংল্যান্ডে, ইংরেজি অনুবাদে শ’খানেক কবিতার একখানা চটিবই বেরোল তাঁর, নাহয় ইয়েটস-এজ়রা পাউন্ড-রদেনস্টাইনরা খুব হইহই করলেন আর টমাস স্টার্জ মুর চিঠি লিখলেন সুইডেনে, তার জন্য লোকটাকে নোবেল দিয়ে দিতে হবে? হেনরি জেমস পেলেন না, টমাস হার্ডি-ও না, আনাতোল ফ্রাঁস না, মজা হচ্ছে? ১৩ নভেম্বর ১৯১৩, সাহিত্য-নোবেল ঘোষণার পর আমেরিকার এক কাগজ লিখেছিল, এই শর্মাটি কে, যার নামটা পর্যন্ত উচ্চারণ করা যায় না?
১০৮ বছর পর, এ বারের সাহিত্যে নোবেলজয়ীর ক্ষেত্রেও বিশ্বপ্রতিক্রিয়া অনেকটা ও রকমই। আরে বাবা, মিলান কুন্দেরা পাননি, নগুগি ওয়া থিয়ং’ও পেলেন না, মার্গারেট অ্যাটউড-হারুকি মুরাকামির নাম ফি-বছর হাওয়ায় ভাসে, সেখানে কে হে তুমি কেন্ট ইউনিভার্সিটির ইংরেজি আর পোস্টকলোনিয়াল স্টাডিজ়-এর ইমেরিটাস অধ্যাপক, একেবারে নোবেল নিয়ে গেলে? অন্তত লেখক হিসাবে নামটা, প্রকাশিত বইপত্তরের নাম তো একটু জানা-শোনা হবে!
ফেসবুক-ইনস্টালাঞ্ছিত এই যাপনবিশ্বে কেউ ভাইরাল হলেই তার নাড়িনক্ষত্র জানা হয়ে যায়, আর এ তো দিগ্বিজয়ী, থুড়ি, নোবেলজয়ী। তাই জানা হয়ে গেছে, কয়েক দশক ব্যাপী অধ্যাপনার পাশাপাশি ইনি দশটা উপন্যাসের েলখক। বহু ছোটগল্পেরও। প্রবন্ধেরও। কেমব্রিজ কম্প্যানিয়ন টু সলমন রুশদি’র সম্পাদকও বুঝি! সত্তরোর্ধ্ব মানুষটির কলমের ভাষা ইংরেজি, কিন্তু রক্তে সোয়াহিলি। পূর্ব আফ্রিকার দ্বীপদেশ তানজানিয়ার জাঞ্জিবার দ্বীপ থেকে পালিয়ে এসেছিলেন ষাটের দশকের ইংল্যান্ডে, তরুণ তখন। মানে উদ্বাস্তু। শরণার্থী। কেন পালিয়ে আসা? সেই এক ইতিহাস। কালোমানুষের দেশে বাণিজ্য করতে আসে আরবদেশীয়রা, আবার শাসন করতে আসে সাদারা। ছড়ি ঘোরায়, ব্যবসা আর ক্ষমতার চাকাও। শাসন, শোষণ, রক্ত, বিদ্রোহ... এই সবের মধ্যে পাক খেতে খেতে, ধাক্কা খেতে খেতে ছিটকে আসে কতকগুলো আফ্রিকাজীবন। আফ্রিকারই অজগাঁ থেকে শহরে, কিংবা অন্য দেশে, ভিন্-মহাদেশে। প্রান্ত থেকে কেন্দ্রের দিকে সরে এলেই কি মুছে যায়, মোছা যায়, প্রান্তজীবন?
এ জীবন লেখকের যাপিত জীবন। এই জীবনই বছরের পর বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন তিনি। লিখেছেনও এই জীবন নিয়েই। লেখক তো নিজেরই হাড়-মাস-মজ্জা-ঘাম-রক্ত-বীর্যের কণা-ভগ্নাংশ ছড়িয়ে রাখেন নিজের গল্পে-উপন্যাসে। আব্দুলরাজ়াকের গড়া চরিত্ররা— হাসান ওমর-ইউসুফ-দাউদ-আব্বাস-ইলিয়াস-হামজ়া— তাঁর সত্তারই উত্তরাধিকার, ব্যক্তি মানুষের খোলে পুরে দেওয়া জাতি-ইতিহাস। সেই ইতিহাসের লিখনকেই গড় করেছে নোবেল কমিটি।
প্রথম উপন্যাস মেমরি অব ডিপারচার (১৯৮৭) লিখেছিলেন নিজের পিএইচ ডি থিসিসের পাশাপাশি। সে বই-ই হোক বা গত বছর প্রকাশিত উপন্যাস আফটারলাইভস— নোবেল পাওয়ার পর যে বইয়ের চাহিদা আকাশ ছুঁয়েছে— কিংবা এ দুইয়ের মধ্যেকার প্যারাডাইস, বাই দ্য সি বা গ্র্যাভেল হার্ট, লিখেছেন নিজের লব্জে, নিজের শর্তে। তাই তাঁর সাহিত্যের ভাষা ইংরেজি হলেও তার মধ্যে ঢুকে পড়ে গেরিলাযুদ্ধ চালায় সোয়াহিলি, জার্মান শব্দরা। ঝঞ্ঝাটও হয় সে নিয়ে— প্রকাশক চান, না-ইংরেজি শব্দগুলো ‘আইটাল’-এ লেখা হোক, শেষে থাক ‘গ্লসারি’। লেখক বলেন, না। তা চলবে না। অপরকে অপর হিসাবে অমন দাগিয়ে দেওয়াতেই তো এই হাল পৃথিবীর। সাহিত্যের ভাষা আপসহীন, পাপমুক্ত থাকুক।
এ বার তাঁর সব বইয়ের খোঁজ পড়েছে। নানা ভাষায় অনুবাদ আর রিপ্রিন্ট-স্বত্ব কেনার হুড়োহুড়ি। সে সব ফুরোলে, বই হাতে পেলে বিশ্বপাঠক পড়বেন তাঁর লেখায় শেকড়ছেঁড়া, নোঙরহারা, শরণার্থী জীবনকে। আফ্রিকার আলব্যেয়র কামু, ওলে সোয়িঙ্কা, নাগিব মাহফুজ়, নাদিন গর্ডিমার, জে এম কোয়েটজ়ি, ডরিস লেসিংদের পাশে একাসনে বসা, উজ্জ্বল কিন্তু শান্ত, স্মিতহাস্য এই লেখককে।
ইদানীং বড্ড ডান দিকে ঝুঁকে থাকা এই পৃথিবীর জন্য তা বড়ই সুখবর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy