মুসলমান মেয়েদের একাংশ কেন হিজাব পরেন, তার একাধিক কারণ থাকা সম্ভব। কারও চোখে এটি পারিবারিক ঐতিহ্য, কারও ক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুশীলন। কেউ হিজাব পরেন তাঁর বিপর্যস্ত আত্মপরিচয়ের প্রতিরক্ষায়, কেউ বা তাঁর সামাজিক-সাংস্কৃতিক চিহ্নের আত্মপ্রকাশ রূপে। আবার কারও হিজাব পরিধানের কারণ হয়তো স্রেফ জবরদস্তি, পিতৃতন্ত্র-নিয়ন্ত্রিত সামাজিক নিপীড়নের চিহ্ন। সুতরাং হিজাবকে বেছে নেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতটি কোনও একটি নির্দিষ্ট অর্থ বা ব্যাখ্যার উপর দাঁড়িয়ে নেই। পরিধানের কারণ যা-ই হোক না কেন, হিজাব আদতে নির্দিষ্ট ব্যক্তি মানুষের আত্মপরিচিতির অভিব্যক্তিরই প্রকাশ। দিনের শেষে তা সেই ব্যক্তির ‘চয়েস’-ই। তা কার ক্ষেত্রে মুক্ত আর কার ক্ষেত্রে পরাধীন, জনে জনে তার বিচার করা বাস্তবিকই অসম্ভব।
হিজাবে নিষেধাজ্ঞার মূলে অবশ্য নারীর স্বাধীনতা রক্ষা বা শিক্ষাঙ্গনকে ‘সেকুলার’ করার কোনও মহৎ উদ্দেশ্য ছিল না— ছিল শুধুই ঘৃণার রাজনীতি। সেই ঘৃণার লক্ষ্য একটি বিশেষ ধর্ম সম্প্রদায়। তাই কোনও মুসলিম মেয়ের হিজাব বেছে নেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতটি যা-ই থাকুক— যাঁরা হিজাব নিষিদ্ধ করতে চান, তাঁরা সেটিকে কেবল একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় অভিব্যক্তি প্রকাশের প্রতীক রূপেই দেখেন। হিজাব বন্ধ করে তাঁরা সেই বিশেষ সম্প্রদায়কেই কোণঠাসা করার খোয়াব দেখেন।
আর হিজাব-বিরোধী এই পরিকল্পনায় ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্রীয় কাঠামোও ব্যবহৃত হয়— যে রাষ্ট্রকাঠামো আসলে সংখ্যাগুরুর ধর্ম, সংস্কৃতির আধিপত্যের সঙ্গেই নিজেকে একাত্ম করে। সেই একাত্মীকরণকে ‘নর্মালাইজ়’ করে। তাই হিন্দু সমাজে প্রচলিত সিঁদুরের সামাজিক নিপীড়নের চিহ্ন মুছে গিয়ে মেয়েদের নিছক ব্যক্তিগত ‘ফ্যাশন স্টেটমেন্ট’-এর ঐচ্ছিক প্রকাশ হিসাবে তার রূপান্তর ঘটে। কিন্তু হিজাবকে দেখা হয় কেবলমাত্র সামাজিক নিপীড়নের চিহ্ন রূপেই। রাষ্ট্রের নীতিপুলিশি সীমাবদ্ধ থাকে সংখ্যালঘুর উপর নজরদারিতেই। এই ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্রে সংখ্যাগুরুর ধর্মীয় অনুষঙ্গগুলি ক্রমে ‘সংস্কৃতি’র— ‘ভারতীয়’ সংস্কৃতির— উপাদান হয়ে ওঠে। আর মুসলিম সম্প্রদায়ের বেলা তা কেবলই ‘ধর্মীয়’, ‘বহিরাগত’— ‘অভারতীয়’ এবং ‘অচ্ছুত’। আর তাই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মন্দিরের উদ্বোধনে দেশের প্রধানমন্ত্রী বিশেষ ধর্মীয় পোশাক পরে হাজির হতে পারেন। কিন্তু, শিক্ষাঙ্গনে হিজাব পরে আসার ‘অপরাধে’ মুসলিম মেয়েদের শারীরিক, মানসিক ভাবে লাঞ্ছিত হতে হয়।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ভারত নামক জাতিরাষ্ট্রটি বরাবরই সংখ্যাগুরুর ধর্ম, সংস্কৃতিকেই ‘নেশন’-এর সঙ্গে একাত্ম করে এসেছে। তাই সংবিধানে যতই বহুত্বের জয়জয়কার হোক, বাস্তব যে ভিন্ন— তা এ দেশের প্রতিটা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের (বিশেষ করে মুসলিম) মানুষকে জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি প্রতি দিন নানা অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হতে বুঝে নিতে হয়। সমাজের সমস্ত প্রান্তে সংখ্যাগুরুর ধর্ম, সংস্কৃতির অভিব্যক্তি প্রকাশের অধিকার সুরক্ষিত রয়েছে, উদ্যাপিত হচ্ছে। রাষ্ট্রের বর্তমান নিয়ন্ত্রকরা তাকে অগ্রাধিকার দেওয়াকেই স্বাভাবিক বলে দেখান। অথচ সেই অধিকারের ছিটেফোঁটাও জোটেনি সংখ্যালঘুর। যেটুকু যা অধিকার সুরক্ষিত আছে, আজ তা-ও লুণ্ঠিত হওয়ার মুখে।
তাই সংখ্যাগুরুর ‘হিন্দুনেস’ আপত্তিকর না হলেও সংখ্যালঘুর ‘মুসলিমনেস’ ঢের সমস্যাজনক। সংখ্যাগুরুর ধর্মাচরণে, সংস্কৃতিতে কেউ বিপন্ন বোধ করে না। কিন্তু সংখ্যালঘু মুসলিমের বেলা গল্প আলাদা। তখন তাঁদের ক্ষেত্রে সংবিধানস্বীকৃত আত্মপরিচয়ের প্রকাশের অধিকারকেও দেশের স্বার্থের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দেওয়া চলে। কেবল পর্দাতেই নয়, বাস্তবেও নাগরিক থেকে রাষ্ট্র সকলের চোখে তাকে সহজেই ‘ভিলেন’ বানানো চলে। তখন সংখ্যাগুরুর এই রাষ্ট্র তাঁর এমন একটি ভাবমূর্তি নির্মাণ সম্পূর্ণ করে, যাতে তার আত্মপরিচিতির অন্যতম অভিজ্ঞান ‘মুসলিমনেস’ও খোদ মুসলিম সমাজের মধ্যেই আতঙ্ক তৈরি করে। সমাজের সামনে সে তার ‘মুসলিম’ পরিচয় জ্ঞাপন করতেও ভয় পায়, লজ্জা পায়। তার ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক বা ব্যক্তিগত পছন্দের চিহ্ন প্রকাশ তো দূরের কথা।
অথচ হিজাব, যার পরিধানের পিছনে কোনও ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক অনুশীলন জড়িত থাকুক বা না থাকুক— তা প্রকৃত প্রস্তাবে ব্যক্তি নাগরিকের আত্মপরিচয়েরই প্রকাশ। যে প্রকাশের স্বাধীনতা সংবিধান দ্বারাই সুরক্ষিত। সেই হিজাব পরতে বলা বা খুলে ফেলতে— কোনওটিই গায়ের জোরে বা আইন করে করা যায় না। তা ছাড়া, কোনটি সামাজিক নিপীড়নের চিহ্ন এবং কেন, তা হঠাৎ এক দিন পোশাক বিধি বা আইন চালু করে স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের বোঝানোও যায় না। বদলে রাষ্ট্রের এমন নীতিই হওয়া উচিত, যেখানে তারা মুক্তমনে, নিজেদের মতো করে, স্বাধীন ভাবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে।
সংখ্যাগরিষ্ঠের ভারতে হিজাবকে ঘিরে রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত একরৈখিক অর্থ-ব্যাখ্যা-পর্যবেক্ষণ শুধু অর্থহীনই নয়, বিপজ্জনকও। তা কেবল দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া সংখ্যালঘু মুসলিমের বিপদই বাড়াবে না। সঙ্কটে পড়বে দেশও। কারণ হিজাবে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি কেবল এক টুকরো কাপড়ের বাতিল হয়ে যাওয়ার মধ্যেই সীমিত নয়— ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও ব্যক্তিগত অভিব্যক্তি প্রকাশের অধিকারের প্রশ্নে তার গুরুত্ব অসীম। রাষ্ট্রের বর্তমান পরিচালকদের মনোভাব আজ হয়তো মুসলিম সম্প্রদায়ের বিপদ বাড়িয়েছে। ভবিষ্যতে যে আরও প্রান্তিক, সংখ্যালঘু স্বরের উপরেও একই আঘাত নেমে আসবে না, সেই আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। ব্যক্তি নাগরিকের স্বাধীন আত্মপ্রকাশের অধিকারের প্রশ্নে বৈষম্য হলে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার দায়িত্ব সবার। শুধু সংখ্যালঘুর নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy