Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪
এক নিম্নস্তরের স্থিতাবস্থা
Unemployment

সস্তা খয়রাতিতে কোনও দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক সম্পদ তৈরি হয় না

আমাদের রাজ্যের দু’টি বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সেরা দশের মধ্যে বেশ কয়েক বছর ধরে আছে, এ বারও তাদের স্থান যথেষ্ট সম্মানের। নেতানেত্রীদের মুখে শুনি, তাঁরা গর্বিত। কিন্তু ওই অবধিই।

সংগ্রাম: মহার্ঘভাতা-সহ অন্যান্য দাবিতে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মীদের মৌন মিছিল। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

সংগ্রাম: মহার্ঘভাতা-সহ অন্যান্য দাবিতে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মীদের মৌন মিছিল। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

স্বপ্নেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৭:১০
Share: Save:

চোখে ভাসছে জনঅরণ্য ছবির সেই ইন্টারভিউয়ের দৃশ্য। পরীক্ষক সোমনাথকে চাঁদের ওজন জিজ্ঞাসা করছেন, আর সোমনাথ অবাক হয়ে প্রশ্ন করছে, এর সঙ্গে চাকরির কী সম্পর্ক? সম্পর্কটা আসলে চাকরির সঙ্গে নয়, চাকরি না দেওয়ার সঙ্গে। যদি পছন্দের লোক আগে থেকেই ঠিক করা থাকে, তবে যোগ্য অথচ অপছন্দের লোককে অযোগ্য প্রমাণ করতে হবে।

আমরা অনেকেই এই জাতীয় ইন্টারভিউয়ের সম্মুখীন হয়েছি। দুর্নীতি, স্বজনপোষণ বরাবরই আছে, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির মতো সামাজিক অবক্ষয় আমরা আগে দেখিনি। এখন অবশ্য এত কায়দা করে দুর্নীতির আশ্রয় নিতে হয় না। এখন ক্ষমতার জোরে বা পদের জোরে নিজের লোককে যে কোনও চাকরি পাইয়ে দেওয়া যায়।

কিছু দিন ধরে একটি রসিকতা সোশ্যাল মিডিয়াতে ঘুরছে। নিজের সন্তানদের স্কুলে ভর্তি না করে রাজনৈতিক দলে কী ভাবে ভর্তি করা যায়, তাই নিয়ে রসিকতা। এই রসিকতার মধ্যে কিছুটা যন্ত্রণাও লুকিয়ে আছে। লেখাপড়া করে, উৎকর্ষ অর্জন করে কি সত্যিই কিছু লাভ হবে? যাঁরা আমাদের ভাগ্যনিয়ন্তা, তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা কী, মননই বা কতটা সমৃদ্ধ? অর্থোপার্জনের ক্ষেত্রে কি তাঁদের ধরে-কাছে পৌঁছনো যাবে? সমাজ হিসাবে কতটা অধঃপাতে গিয়েছি আমরা? এই ভাবনাগুলো থেকেই হয়তো এই রসিকতা।

বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কি সত্যিই কারও মাথাব্যথা আছে? চারিদিকে এত দুর্নীতি ফাঁস হওয়ার পরও নেতানেত্রীদের সে রকম ভ্রুক্ষেপ বা ভয়ের লক্ষণ নেই। কারণ তাঁরা জানেন যে, রাজনৈতিক ভাবে তাঁরা নিরাপদ। একটি বৃহত্তর জনগোষ্ঠী তাঁদের হাতের মুঠোয়। কারণটা বুঝতে কষ্ট হয় না। এরা সরকারি খয়রাতিতে তৃপ্ত, কোনও না-পাওয়ার বেদনা এদের নেই। এরা সমাজের বৃহত্তর সমস্যা সম্পর্কে উদাসীন, এদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা কম, এরা খয়রাতির সামান্য অর্থ পেতেই হয়তো বেশি আগ্রহী।

খয়রাতি করে একটি রাজনৈতিক দলের স্বল্পমেয়াদি লাভ হতে পারে, কিন্তু এতে কি জনগণের লাভ হয়? বর্তমানে অর্থনৈতিক অসাম্য নিয়ে প্রচুর কথা হয়। প্রত্যেক দেশেই অসাম্য বাড়ছে, বিশ্বায়নের ফলে উপরের দিকের একটি শ্রেণির সম্পত্তি বেশি বাড়ছে, এ কথা সত্যি। এর জন্য প্রয়োজন সরকারের হস্তক্ষেপ, এবং সরকারি বণ্টন ব্যবস্থা প্রসারিত করা, যাতে অগ্রগতির সুফল সব শ্রেণির মানুষ মোটামুটি সমান ভাবে পান। কিন্তু খয়রাতি আর সমবণ্টন কি এক? কিছু ভাল সরকারি স্কুল তৈরি করে দেওয়া, যেখানে সাধারণ ঘরের ছাত্ররা প্রায় বিনামূল্যে ভাল শিক্ষা পায়; কিছু ভাল সরকারি হাসপাতাল তৈরি করা ও বর্তমান সরকারি হাসপাতালের পরিষেবা উন্নত করা, যাতে সাধারণ মানুষ আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা পরিষেবা পান; মফস্সলে, গ্রামগঞ্জে ভাল রাস্তাঘাট তৈরি করা, যাতে উন্নয়নের সুফল সবাই পেতে পারেন— এগুলো সমবণ্টন প্রক্রিয়ারই অঙ্গ, এবং সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এগুলি সমাজের সম্পদ হয়ে থাকে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম তার সুফল পায়।

কিন্তু ভোটের স্বার্থে কিছু মানুষের হাতে বেশ কিছু টাকা তুলে দেওয়া কি সামাজিক কল্যাণ বৃদ্ধি করে? কোনও সামাজিক কল্যাণমুখী সম্পদ কি তৈরি হয়? এই নিয়ে কল্যাণ-অর্থনীতিতে হয়তো আরও গবেষণার প্রয়োজন আছে— তবে ক্লাব-কেন্দ্রিক সস্তা খয়রাতিতে যে কোনও সামাজিক কল্যাণ বৃদ্ধি হয় না, সেটা গবেষণা না করেই বলা যায়। আর একটি বিষয় ভেবে দেখার যে, খয়রাতি করে কি আমরা একটি পঙ্গু পরজীবী সমাজের জন্ম দিচ্ছি না? এমনিতেই অর্থনীতির তত্ত্ব বলে যে, মানুষকে কাজ করাতে গেলে ইনসেনটিভ বা প্রণোদনা দিতে হয়। মানুষ স্বভাবত বেশি কাজ করে না, যদি তার ‘মোটিভেশন’ না থাকে। তা হলে এই জাতীয় খয়রাতি কি কাজ না-করার প্রণোদনা? কাজ করে কী হবে, একটি রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করো, সমস্ত কুকীর্তি দল সামলে নেবে যদি তুমি দলের ‘সম্পদ’ হও। চাকরি করে যা রোজগার, তার থেকে অনেক বেশি রোজগার এখানে হবে, অর্থাৎ রাজনৈতিক দলের ‘চাকরি’ করো। আর যার ‘সিভি’-তে যত বেশি কুকীর্তি, তার মূল্য তত বেশি।

খয়রাতি বনাম কল্যাণমুখী ব্যয় নিয়ে এখন দেশে বিরাট বিতর্ক চলছে। কোনটা ‘খয়রাতি’, আর কোনটা কল্যাণমুখী সামাজিক ব্যয় এই নিয়ে উচ্চ আদালত সমস্ত রাজনৈতিক দলকে ভাবনাচিন্তা করতে বলেছে, এবং এই সমস্যাটি দেশের সমস্ত রাজ্যের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। বিষয়টি গভীর তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক অর্থনীতির গবেষণার বিষয়। এই নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালিখিও হচ্ছে। সেই বিষয়ে আলোচনা এই লেখার প্রতিপাদ্য নয়। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে সস্তা খয়রাতির একটি নেতিবাচক দিক নিয়ে দু’এক কথা বলি।

আমাদের রাজ্যের দু’টি বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সেরা দশের মধ্যে বেশ কয়েক বছর ধরে আছে, এ বারও তাদের স্থান যথেষ্ট সম্মানের। নেতানেত্রীদের মুখে শুনি, তাঁরা গর্বিত। কিন্তু ওই অবধিই। বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও উৎকর্ষের জন্য কোনও বাড়তি আর্থিক অনুদান নেই, বরং বছরের পর বছর অনুদান হ্রাস পাচ্ছে। যে কোনও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উৎকর্ষের জন্য গবেষণার উৎকর্ষ জরুরি, এবং তার জন্য দরকার সরকারি সাহায্য। সে সবের বালাই নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা তাঁদের গবেষণাপত্র বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় উপস্থাপনা করার ফলে সারা বিশ্বে দেশের, রাজ্যের ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম বৃদ্ধি হত। তাও প্রায় বন্ধ। রাজ্যের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘভাতা পান না। এবং এই জন্য আমরা অনেক ভাল শিক্ষক, গবেষককে হারিয়েছি, যাঁরা আমাদের ছেড়ে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গিয়েছেন। অনেক ভাল তরুণ শিক্ষক, গবেষক রাজ্যের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে উৎসাহী নন। ফলত, আমাদের তরুণ বাঙালি প্রজন্ম শিক্ষা ও গবেষণার উৎকর্ষ থেকে বেশ কিছুটা বঞ্চিত হচ্ছে। স্কুলশিক্ষার ক্ষেত্রেও একই হাল। অনেক ভাল ছাত্রছাত্রী আর স্কুলশিক্ষায় আসতে উৎসাহী নয়। তার উপর বর্তমান স্কুলশিক্ষা দুর্নীতি আরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। দুঃখজনক ভাবে আমাদের নেতানেত্রীদের এ নিয়ে কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। সরকারের নাকি টাকা নেই, তাই বর্ধিত মহার্ঘভাতা দিতে অসুবিধা হচ্ছে। অথচ উৎসবের সময় ক্লাবের অনুদান ও অন্যান্য অনুদান দিতে টাকার সমস্যা নেই। বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তির ও তাঁদের পরিচিতের বাড়ি থেকে অঢেল নগদ টাকা বেরোতে পারে। তাতেও কোনও অসুবিধা নেই। শুধু সরকারি কর্মচারী, সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকশিক্ষিকা, গবেষক ও কর্মচারীদের দেওয়ার মতো টাকা নেই।

তার মানে কি এই বার্তা দেওয়া হচ্ছে যে, সরকারি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশাসন এগুলি জরুরি নয়? আমরা কি তা হলে নিম্নমানের ভারসাম্য বা ‘লো লেভেল ইকুইলিব্রিয়াম’-এই রয়ে যাব? সরকারি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশাসনে যদি ভাল ছাত্রছাত্রীরা না আসে, তা হলে কি সমাজের ভাল হবে? মানবসম্পদ উন্নয়নের সুফল হয়তো তাৎক্ষণিক ভাবে পাওয়া যায় না, কিন্তু এই দীর্ঘমেয়াদি ভাবনাচিন্তার সময় কি এখনও আসেনি? সমস্ত সরকারি কর্মচারীকে বঞ্চিত করে জনগণের করের টাকায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে খয়রাতি কতটা কল্যাণকর, সেই নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার সময় এসেছে।

অর্থনীতি বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়

অন্য বিষয়গুলি:

Unemployment Inflation Protest
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy