শতবর্ষী: শতবর্ষ উদ্যাপন মঞ্চে পত্রিকার প্রথম সংখ্যার ছবি, কলকাতা, ৯ জুলাই
আনন্দবাজার পত্রিকার আবির্ভাব নিয়ে কলকাতায় দি ইংলিশম্যান কাগজে চিন্তার বড় প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। ১৯২২-এর ১৪ মার্চ, দি ইংলিশম্যান জানায় যে, কলকাতায় একটি নতুন দৈনিক পত্রিকা শুরু হয়েছে। তার সমস্তটাই লাল কালিতে ছাপা। আনন্দবাজার পত্রিকার জন্মদিন আনন্দের দিনই ছিল। মার্চ মাসে দোল পূর্ণিমার দিনে সম্পাদক প্রফুল্লকুমার সরকারের পরিচালনায় রক্তবরণের কাগজে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হয়। বিষয়বস্তুর মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি ছিল না। শুধু ঘোষণা করা হয়েছিল যে, আনন্দবাজার পত্রিকা বাঙালির মিলন কেন্দ্র হবে।
যদিও দি ইংলিশম্যান এই রংচঙে পত্রিকাকে ‘কালার লাইক আ ডেনজার সিগন্যাল’ বলে বর্ণনা করেছিল, তার মধ্যেও দেশের সমস্যাগুলি নিয়ে ভাবনার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করা হয়েছিল। সেই চিন্তার প্রয়োজনীয়তা সত্যিই কম ছিল না। আজকে একশো বছর পূর্ণ হওয়ার দিনে আমাদের ভাবতে হবে নতুন কোনও চিন্তা ভাবনার প্রয়োজন আরও গুরুত্বপূর্ণ কি না। ১৯২২-এর সময়ের সঙ্গে আজকের দিনের পার্থক্য খুবই বড় রকমের। দেশ স্বাধীন হয়েছে অনেক দিন হল। স্বাধীনতার সময় আমাদের যে আশা ছিল, তার অনেকটাই পূর্ণ হয়েছে এমনটা বলা যায়। কিন্তু ঘাটতির মাপও কম নয়।
১৯২২-এর সময়ে অনেক ভারতীয়কেই জেলে যেতে হয়েছিল। আমার নিজের আত্মীয়দের মধ্যেও রাজনৈতিক কারণে জেল খাটতে হয়েছিল অনেককেই— তাঁদের মধ্যে কিছু লোক আনন্দবাজার এবং হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড-এ কাজ করতেন। আমার জীবনের প্রথম স্মৃতির মধ্যে খুব অল্প বয়সে তাঁদের জেলে দেখতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা বেশ বড় রকম ছিল। প্রধানত চল্লিশের দশকে। আমি তখন তাঁদের প্রশ্ন করতাম যে, আইনগত অপরাধ ছাড়াই লোককে জেলে দেওয়া কী কোনও সময় বন্ধ হবে না? তার উত্তরে শুনেছিলাম, দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে বোধ হয় বিনা অপরাধে কারাবাস বন্ধ করা যাবে না।
তার পর দেশ স্বাধীন হল। কারাগারের রূপ বদলাল। কিন্তু বিনা অপরাধে রাজনৈতিক কারাবাস এখনও বড় রকম ভাবেই চলছে। সাহসী রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা যাঁরা চর্চা করছেন, তাঁদের অনেককেই মার খেতে হচ্ছে সরকারের হাতে, আরোপিত অপরাধের বিচার ছাড়াই। তাঁদের প্রশংসা ভারতবর্ষের বাইরে থেকে অনেক সময় আসে। যেমন, আমরা শুনেছি জোর গলায় অধ্যাপক চমস্কির মুখ থেকে প্রতিবাদ। বিনা বিচারে হাজতবাসী উমর খালেদকে সম্মান দিতে চমস্কি চেয়েছেন। কিন্তু এ দেশে তাঁদের সম্মান প্রায় সময়ই বিরল। আনন্দবাজার পত্রিকা যে এই সাহসিকতাকে স্থান দিয়েছে তাদের কাগজে এবং আলোচনায়, তার মধ্যে একটা বড় রকম মূল্যবোধ আমরা দেখতে পাই।
আমাদের দুঃখী দেশে সমস্যার অভাব নেই। দারিদ্র, চিকিৎসাহীনতা, সাধারণ মানুষের সম্মানের অভাব, মেয়েদের প্রতি দুর্ব্যবহার— প্রায়ই আমাদের চোখে পড়ে। সে সমস্ত বিষয়ে আনন্দবাজার পত্রিকা যা বক্তব্য রেখেছে, সেই নিয়ে আমাদের চিন্তা করার কারণ আছে। এ দেশে নতুন যে সমস্যা আমাদের জাতীয় ঐক্য পিছিয়ে দিচ্ছে, তার মধ্যেও সুচিন্তার অভাব আমরা অনেক সময় দেখতে পাই। ভারতীয় মানুষদের নানা ভাগে ভাগ করার প্রচেষ্টা এবং হিন্দু-মুসলমানের সহকর্মের জায়গায় বিভেদ তৈরি করার প্রচেষ্টা আমাদের খুবই দেখতে হচ্ছে, রাজনৈতিক সুবিধাবাদের ব্যবহারের জন্য। যে ভারতবর্ষ রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধী, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু চেয়েছিলেন তা সরিয়ে একপেশে সাম্প্রদায়িক রাজত্ব করার প্রচেষ্টা দেশের মানুষকে নানা ভাবে দুর্বল করছে। এই বিভক্তিকরণের বিরুদ্ধে যে আনন্দবাজার দাঁড়াবার প্রচেষ্টা করেছে— এতে আমাদের আনন্দ করার কারণ নিশ্চয় আছে।
যে আদর্শ লাল কাগজে দু’পয়সা দামে দোলের পূর্ণিমার দিন প্রচারিত হয়েছিল, সে আদর্শের মূল্য আজকেও কম নয়। আনন্দবাজারের একশো বছর পূর্তি উপলক্ষে এই বড় কথাটি আমাদের স্মরণ করার অবকাশ আছে। দি ইংলিশম্যান পত্রিকা যাকে ‘ডেনজার সিগন্যাল’ বা বিপদসঙ্কেত মনে করেছিল, তা নিয়ে ন্যায়-প্রচারের প্রচেষ্টা এখনও জরুরি। এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, নানান দুঃখদুর্দশার মধ্যে আমাদের এগোতে হবে। তাই আনন্দহীনতা যেমন আমাদের কাম্য নয়, তেমনই সাবলীল ভাবে আমাদের নানান সমস্যার সমাধান বিষয়ে ভাববার প্রয়োজন খুবই বড়। শুধু সারল্য নিয়ে জীবনচিন্তায় সাফল্য হয়তো আমরা পাব না। শক্তিমান এবং সুচিন্তিত চিন্তাধারার উপরে আমাদের জোর কমানো চলবে না। আনন্দবাজার যে আমাদের এই বড় সত্যের দিকে নজর দেওয়ার প্রচেষ্টা করছে, তার জন্যে আমাদের কৃতজ্ঞতার কারণ সত্যিই আছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy