Advertisement
E-Paper

সমাজবিজ্ঞানী বিদ্যাসাগর

বহুবিবাহ পড়তে গিয়ে প্রথমেই মনে পড়ে যায় যে বিদ্যাসাগর তাঁর সংস্কারক জীবন শুরু করেছিলেন বাল্যবিবাহের দোষ নামে একটি বই দিয়ে।

ব্রায়ান হ্যাচার

শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০২২ ০৪:৪৩
Share
Save

কোভিড-পর্বে হাতে নিয়েছিলাম, বিদ্যাসাগরের তুলনায় কম আলোচিত বই বহুবিবাহ-র প্রথম খণ্ডের সটীক অনুবাদ করার কাজ। ১৮৭১ সালে প্রকাশিত প্রথম খণ্ডটিতে আমার বিশেষ আগ্রহ— কেননা আমার মনে হয়, এখানে এক জন বিদ্যাসাগরকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব, যাঁকে এখনও আমরা তত ভাল করে চিনি না। এই বিদ্যাসাগরেরই পরিচয় দিতে চাই এখানে— সমাজ-গবেষণার পথপ্রদর্শক বিদ্যাসাগর।

বইটি নিয়ে কাজ করতে বসে প্রথমেই বুঝলাম, আমার কাজটা হতে চলেছে সংস্কার (রেস্টোরেশন) আর সংশোধনের মাঝামাঝি কিছু। সংস্কার শব্দটা কেন বলছি? বিদ্যাসাগরের কথা ভাবলে প্রথমেই মনে আসে বর্ণপরিচয় আর বিধবাবিবাহ-র কথা, শিক্ষাপ্রসার ও সমাজ-সংস্কারের ক্ষেত্রে যে দু’টি বই আক্ষরিক ভাবেই যুগান্তকারী। তাদের তুলনায় বহুবিবাহ যেন অনেকটাই নিষ্প্রভ, কেননা তার ফলে শেষ অবধি ব্রিটিশ রাজের কাছ থেকে কোনও আইনি সংস্কার আদায় করা যায়নি। অথচ, আমার মনে হয়, অন্য দু’টির মতো বিরাট সাফল্য না পেলেও বহুবিবাহ গ্রন্থটি প্রকৃতপক্ষে বিদ্যাসাগরের ভাবনাচিন্তা বিষয়ে অনেকটা আমাদের জানাতে-বোঝাতে পারে।

এ বার আসে সংশোধনের কথা, কেননা বইটি একটু অন্য ভাবে পড়া দরকার হয়ে পড়ে। বইটি তার আকাঙ্ক্ষিত সাফল্য পায়নি, এটা যেমন আমরা ভাবি, এও আমাদের অভ্যাস— বিধবাবিবাহ বইটির সঙ্গে এর তুলনা করা। প্রথম দৃষ্টিতে দু’টিকেই এক জাতীয় মনে হতে পারে, শাস্ত্র-সংস্কারের প্রচেষ্টামাত্র। আমি কিন্তু বলব, বহুবিবাহ-র কতকগুলি অতিরিক্ত বৈশিষ্ট্য আছে। যুক্তির দিক দিয়ে এ বই অনেক জটিল সামাজিক সমস্যার দিকে নির্দেশ করে— এমন কিছু সমস্যা যাকে আজ আমরা বলব সমাজ-গবেষণার অন্তর্ভুক্ত বিষয়। এর ভিত্তিতেই তাঁকে আধুনিক ভারতের প্রথম সমাজ-গবেষক বলা চলতে পারে— আমার প্রস্তাব।

গবেষণা এখানে বিদ্যাসাগরের প্রথম অস্ত্র। তা দিয়ে তিনি পরীক্ষা করে দেখান কুলীন বহুবিবাহ প্রথা। বলেন, গবেষণার মাধ্যমে মেলে ‘সবিশেষ অনুসন্ধান’। এক নতুন ‘প্যারাডাইম’-এর প্রয়োগে তিনি সমাজ-কাঠামো আর লিঙ্গ-সম্পর্ককে পরীক্ষা করতে বসেন, বাংলার নারীর দুর্দশা মোচনের লক্ষ্যে।

বহুবিবাহ পড়তে গিয়ে প্রথমেই মনে পড়ে যায় যে বিদ্যাসাগর তাঁর সংস্কারক জীবন শুরু করেছিলেন বাল্যবিবাহের দোষ নামে একটি বই দিয়ে, যাতে ধরা পড়েছিল বাল্যজীবন বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, এবং বিধৃত ছিল সমাজবিজ্ঞান চর্চার এক আদি রূপ। একাধিক গবেষক অবশ্য পরে দেখিয়েছেন, বিধবাবিবাহ আন্দোলনের কালে কী ভাবে বিদ্যাসাগর তাঁর প্রথম ধারার সংস্কারচিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে টেক্সচুয়ালিস্ট বা শাস্ত্রবিচারভিত্তিক সংস্কারচিন্তায় মন দিয়েছিলেন। বাল্যবিবাহের দোষ-এর থেকে সেই ধারাটি যে কতটাই বিপরীত, আলোচনা করেছেন বিদ্যাসাগর-বিশেষজ্ঞ অশোক সেন। অর্থাৎ মনে করা হয়, অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের উপর ভর না করে বিদ্যাসাগর শাস্ত্র দিয়েই সমাজসংস্কারের পথে এগোতে চেয়েছিলেন। আমার বক্তব্য— বহুবিবাহ গ্রন্থই প্রমাণ, এই দাবিটি ঠিক নয়।

বহুবিবাহ বইটির মধ্যে বাল্যবিবাহের দোষ এবং বিধবাবিবাহ দুয়েরই গুরুত্বপূর্ণ দিকের সমাহার ঘটেছে। এই বইতে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের উপর ভর করা হয়েছে, কুলীন ঘরের বধূ ও বিধবাদের যন্ত্রণার বাস্তব তুলে ধরার জন্য। প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রমাণ দেওয়ার পর তিনি বলেছেন, “যাঁদের‌ই চোখ আছে, কান আছে, হৃদয় আছে, তাঁরাই স্বীকার করবেন বহুবিবাহ প্রথা কত অপরিমেয় কষ্টের কার‌ণ।” অর্থাৎ, এই কুলীন প্রথাটি বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে হলে আগে সম্যক ভাবে অবহিত হওয়া দরকার, তিনি মনে করেছেন। সেই অবধানের জন্য তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ আবশ্যক। এটাকেই বলা যেতে পারে সমাজ-গবেষণা। এ কাজে বিদ্যাসাগর যে ভাবে এগিয়েছেন, আমার মতে তার মধ্যে তিনটি পদ্ধতি প্রয়োগ দেখা যেতে পারে: ইতিহাসগত সমালোচনা, সমাজতত্ত্ব কল্পনা এবং তথ্য সংগ্রহ।

ইতিহাসগত সমালোচনা বলতে আমি বোঝাতে চাই, বহুবিবাহ নামক কুলীন প্রথা বিষয়ে নানাবিধ প্রচলিত কথা-উপকথার বিদ্যাসাগরকৃত বিশ্লেষণ। এই বিশ্লেষণকে বলা যায় বাংলার কৌলীন্য সংস্কৃতি বিষয়ক একটি ‘ক্রিটিক্যাল রিভিউ’। আদিসুরা নামক শাসকের বিবরণ থেকে কান্যকুব্জে পাঁচ ব্রাহ্মণের আমন্ত্রণ, বল্লালসেনের আমলে পদাধিকার ও বিবাহ সম্পর্কিত সংস্কার, এবং দেবীবর ঘটকের দ্বারা এই বন্দোবস্তের একত্রীকরণ— তিনি আলোচনা করেছেন। তাঁর ইতিহাস-দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা লক্ষ করতেই হয়। কৌলীন্য একটি দেবপ্রদত্ত প্রথা, এই বক্তব্য তিনি সোজা বাতিল করে দেন। না, কোনও ঈশ্বর এ সব তৈরি করেননি— পাঠকদের বলেন তিনি— কৌলীন্য প্রতিষ্ঠানটি তৈরি করেছে মানুষ নিজেই, এবং নানা ভাবে তার পরিবর্তন ও অবনমন ঘটিয়েছে। পরিবর্তন যখন ঘটিয়েছে মানুষই, বিলোপও মানুষই ঘটাতে পারে নিশ্চয়ই। বিদ্যাসাগরকে যদি কেবল শাস্ত্রবচন-সন্ধানী পণ্ডিত বলে মনে রাখি, তা হলে ভুলে যাব যে, কী তীক্ষ্ণ সমাজবিশ্লেষণ দিয়ে তিনি অসহনীয় সামাজিক প্রথাগুলির বিরুদ্ধতায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন।

কুলীন-তত্ত্ব সমালোচনাসূত্রে তাঁর ইতিহাসপাঠে ঢুকে পড়ে এক রকমের সমাজতত্ত্ব-কল্পনা। সুদীপ্ত কবিরাজ বঙ্কিমচন্দ্রের আলোচনা-সূত্রে ‘ইতিহাস-কল্পনা’র কথা বলেছেন, আমি তারই অনুসরণে ‘সমাজতত্ত্ব-কল্পনা’র কথা বলছি। বিদ্যাসাগর ও বঙ্কিমচন্দ্র জ্ঞানচর্চার অঙ্গন থেকে সে কালের সামাজিক সমস্যাগুলিকে কত নতুন ও পরীক্ষামূলক ভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করছিলেন, সে দিকে নির্দেশ করার জন্যই ‘কল্পনা’ শব্দটি বেশ উপযোগী।

আসলে, সমাজচিন্তার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর যে তথ্যপ্রমাণগুলি হাজির করছিলেন, সেগুলি বাস্তব না কাল্পনিক, তা আমরা জানতে পারি না বলেই ‘কল্পনা’ শব্দটির আশ্রয় নিতে হয়। অবশ্য জানার দরকারটা গৌণ। যে ভাবে তিনি বলছেন কথাগুলি তার জোরটাই আসল। উদাহরণ হিসাবে সেই কাহিনিটি ভাবা যেতে পারে, যেখানে তিনি পিতা ও দুই কন্যার কাহিনি বলছেন। কন্যাদের বাবা তাদের জন্য কুলীন পাত্র খুঁজে না পেয়ে শেষ অবধি এক কুলীন ঘরের ছয় বছরের বালকের হাতে বহু দানসামগ্রী দিয়ে দুই মেয়েকে সঁপে দিলেন। বিবাহের পরই বালক বর অদৃশ্য হয়ে গেল, এবং মেয়ে দু’টি ‘পতিতা’-জীবনে নিক্ষিপ্ত হল। একে সমাজকল্পনা বলা ছাড়া উপায় নেই, কেননা সত্যিই এমন ঘটেছিল, না কি চার পাশের যন্ত্রণাময় সামাজিক বাস্তবের নির্যাসটুকু তিনি এই ভাবে কাল্পনিক-আখ্যানে উপস্থাপিত করেছিলেন, তা আজ আর বোঝার উপায় নেই।

তথ্য অংশটি বিষয়ে বলার এটাই যে, গ্রামবাংলায় বহু জায়গায় ভ্রমণ করেছিলেন বিদ্যাসাগর, শৈশব থেকে শুরু করে পরবর্তী জীবনপর্বেও। মানুষের সঙ্গে আলাপপরিচয়ে তাঁর যে উৎসাহ ছিল, তার থেকেই বোঝা সম্ভব, পাঠকদের কাছে সেই ‘সবিশেষ অনুসন্ধান’ কী ভাবে তিনি পৌঁছে দিয়েছিলেন।

বহুবিবাহ গ্রন্থের সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক অংশ বোধ হয় যেখানে বিদ্যাসাগর সপাটে বর্জন করছেন এই দাবি যে— বহুবিবাহ রোধে আইনি সংস্কার দরকার নেই কেননা এমনিতেই এখন সমাজে তার প্রচলন কমছে। “একদম বাজে কথা!” বলেন বিদ্যাসাগর। এবং এটা যে ‘বাজে কথা’, তা প্রমাণ করতেই হাজির করেন বিস্তর তথ্যপ্রমাণ। তার মধ্যে ছিল হুগলি জেলার কিছু বিশেষ কুলীনের উদাহরণ। তাঁদের নাম ধাম পরিচয় সমস্ত দেন তিনি। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি, যদি ধরে নিই যে তখনকার মানদণ্ডে এই সত্যিকারের পরিচয় দেওয়াটা অনৈতিক ছিল না! নিজের সংগৃহীত এই সব তথ্যের দুর্বলতা ও শক্তির দিকগুলি নিয়ে তিনি নিজেই আলোচনা করেন, খোলাখুলি। হুগলি জেলার জনাই-এ তথ্য দিয়ে সংখ্যাতাত্ত্বিক বিবরণও পেশ করেন। প্রশ্নের আকারে যুক্তিটি তোলেন, রাঢ় বাংলার একটি জায়গাতেই যদি সংখ্যা দাঁড়ায় এমন, তা হলে গোটা বাংলায় ছবিটা কী রকম হতে পারে?

এই পুরো তথ্য-যুক্তি সঙ্কলন ঘটে এমন সময়ে, যখন এ দেশে ব্রিটিশরা প্রথম বার জনগণনার প্রয়াস করছে। যে বছর তিনি হুগলি জেলার কুলীন বিবাহের সংখ্যা জোগাড় করেছেন, সেই বছরেই প্রথম বার সরকারি সেন্সাস তৈরি হচ্ছে কলকাতায়। তিন বছর পর, ১৮৬৯ সালে ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার হচ্ছেন স্ট্যাটিস্টিক্যাল সার্ভের ডিরেক্টর জেনারেল, এবং ১৮৭১ সালের মধ্যে সাধারণ জনগণনার পরিকল্পনা হচ্ছে। জনজীবন বিষয়ে এত ওয়াকিবহাল মানুষ ছিলেন বিদ্যাসাগর, তিনি নিশ্চয় জানতেন এ সব কথা। এবং নিশ্চয় এ দিয়ে প্রভাবিত হয়েছিলেন তাঁর নিজস্ব সামাজিক গবেষণার কাজটিতেও।

এও আর এক ‘সংশোধন’ প্রকল্প, আমরা বলতে পারি: বিদ্যাসাগরকে কেবল শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত হিসাবে না দেখা। তাঁর মধ্যে ইতিহাসবিদ এবং/তথা সমাজতাত্ত্বিক হওয়ার স্পষ্ট লক্ষণ ছিল। বহুবিবাহ বইটি তাঁর সেই সারস্বত প্রবণতার প্রমাণ। এই দিক দিয়ে বিদ্যাসাগরকে আবার নতুন করে ফিরে দেখার অবকাশ রয়ে গিয়েছে, আমার মনে হয়। ফিরে দেখা, এক নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে।

ধর্মতত্ত্ব বিভাগ, টাফটস ইউনিভার্সিটি, আমেরিকা

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তেফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

Ishwar Chandra Vidyasagar Sociologist

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।