Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
আরও এক বিভাজনরেখা
Hacking

প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিমুক্ত হলে তবেই ডিজিটাল ব্যবস্থা স্বচ্ছ হতে পারে

‘ডিজিটাল বঞ্চনা’ এক নতুন বোঝা। ঝাড়খণ্ডে ডিজিটাল বঞ্চনায় ২০১৭-১৮ সালে ২৩ জন অনাহারে মারা গিয়েছিলেন।

অশোক সরকার
শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০২২ ০৪:৫৬
Share: Save:

কমন সার্ভিস সেন্টারের মন্টু কম্পিউটার খুলে কী সব টেপাটিপি করে বলল, “জেঠিমা, তোমার নাম পেনশনের লিস্টে তো উঠে গেছে, দু’মাস ধরে টাকাও আসছে।” শুনে দুবরাজপুরের মনসা বাগদির চোখে বিস্ময়। ইংরেজিতে লেখা সেই তালিকায় নিজের নাম কোথায়, বোঝার উপায় নেই তাঁর। বললেন, “আমি তো কানাকড়িও পাইনি, কোথায় গেল টাকা?” তার উত্তর মন্টু জানে না। কার কাছে উত্তর চাইবেন, তা-ও জানেন না মনসা।

ঝাড়খণ্ডের দুমকা জেলার রুপালি মারান্ডির রেশন কার্ডের সঙ্গে আধার কার্ড লিঙ্ক হয়নি, তাই রেশন না মেলায় ২০১৭ সালে অনাহারে মৃত্যু হয়েছিল তাঁর। মধ্যপ্রদেশের শাহডোল জেলায় বিকাশ মানিহারের ১০০ দিনের কাজের টাকা ছ’মাস ধরে অন্য কারও ব্যাঙ্কের খাতায় জমা পড়ছে, কিন্তু তাঁর মোবাইলে টাকা জমা পড়ার খবর দিয়ে মেসেজের বিরাম নেই। জনকল্যাণ প্রকল্প আর সরকারি পরিষেবা যত অ্যাপ-নির্ভর হয়েছে, তত দেশের সব প্রান্ত থেকে নালিশ আসছে।

‘ডিজিটাল বঞ্চনা’ এক নতুন বোঝা। ঝাড়খণ্ডে ডিজিটাল বঞ্চনায় ২০১৭-১৮ সালে ২৩ জন অনাহারে মারা গিয়েছিলেন। একই কারণে একশো দিনের কাজে প্রতি বছর প্রায় ৬০-৭০ লক্ষ মানুষ তাঁদের প্রাপ্য মজুরি পান না, জানাচ্ছে এক অসরকারি সংস্থা, ডিজিটাল বঞ্চনার পরিমাপ করে সরকারি তথ্য ঘেঁটে। ওই সংস্থা এ-ও দেখেছে যে, ডিজিটাল ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থার পরেও একশো দিনের কাজে মাত্র চব্বিশ শতাংশ ক্ষেত্রে মজুরি ঠিক সময়ে দেওয়া গিয়েছে।

অথচ, ই-গভর্ন্যান্স চালু করার লক্ষ্যে একের পর এক পরিষেবা ডিজিটাল এবং অ্যাপ-নির্ভর হয়ে চলেছে! শ্রম কার্ড, পিএম কিসান, পেনশন, রেশন, একশো দিনের কাজ থেকে অন্যান্য অনেক পরিষেবা এখন ডিজিটাল। এ রাজ্যে ফসলের ন্যূনতম সহায়তা মূল্য পেতে গেলে অ্যান্ড্রয়েড ফোনে অ্যাপ ডাউনলোড করতে হবে। রেশনে নাম উঠল কি না, দেখতে ওয়েবসাইট খুলতে হবে। পিএম কিসানের টাকা এল কি না, সেই খোঁজ নিতে হলে ওয়েবসাইটই ভরসা। শ্রম কার্ড পেতে গেলেও সেই অ্যাপ।

ডিজিটাল ব্যবস্থার সপক্ষে তিনটি যুক্তি দেওয়া হয়। এক, তা স্বচ্ছতা আনে। ওয়েবসাইট খুললেই দেখা যাচ্ছে সারা দেশের ছবি— ফসল বিমা, পিএম কিসান, একশো দিনের কাজ প্রকল্পে কর্মসংস্থান, রেশনের প্রাপক, শ্রম কার্ড ইত্যাদি কোন রাজ্যে কত হয়েছে তার পরিসংখ্যান। দুই, তা কাজে তৎপরতা আনে— ডিজিটাল ব্যবস্থায় সরকার টাকা পাঠালে তা তাড়াতাড়ি প্রাপকের ব্যাঙ্কে পৌঁছয়। আর তিন, তা দুর্নীতি কমায়।

সত্যিই কি স্বচ্ছতা বাড়ছে, দুর্নীতি কমছে? মনসা-রুপালি-বিকাশের কাছে যে ডিজিটাল শাসন স্বচ্ছ বা তৎপর নয়, তা স্পষ্ট। একশো দিনের কাজের ক্ষেত্রে যে পাঁচটি অধিকার আইনে স্বীকার করা হয়েছিল— আবেদনের পনেরো দিনের মধ্যে জব কার্ড দিতে হবে, কাজ চাইলে ১৫ দিনের মধ্যে কাজ দিতে হবে, চাইলে একশো দিন কাজ দিতে হবে, কাজ করলে সাত দিনের মধ্যে মজুরি দিতে হবে, কাজ না দিলে ১৫ দিনের মধ্যে বেকার ভাতা দিতে হবে— তার কোন‌ওটাই ডিজিটাল শাসনে সুনিশ্চিত করা যায়নি। বরং নতুন নতুন দুর্নীতির রাস্তা খুলে গিয়েছে। যেখানেই বায়োমেট্রিক চিহ্ন দিয়ে রেশন দেওয়ার ব্যবস্থা চালু হয়েছে, সেখানেই খাদ্যের সুরক্ষা থেকে কেউ না কেউ বঞ্চিত হচ্ছেন। গত পাঁচ বছরে শুধু ইংরেজি খবরের কাগজেই ১৯টি রাজ্যের ডিজিটাল-বায়োমেট্রিক সংক্রান্ত অনিয়মের ফলে রেশন-বঞ্চনার খবর পাওয়া গিয়েছে।

পিএম কিসানের এক কিস্তি আসছে তো পরের দু’কিস্তি আসছে না, উজ্জ্বলা গ্যাসের ভর্তুকি এক বার আসছে তো পরের বার আসছে না। পেনশন প্রকল্পে আবেদনের পরে নাম কেন উঠছে না, উঠলেও টাকা কেন ঢুকছে না অ্যাকাউন্টে, তার উত্তরও ডিজিটাল ব্যবস্থা দিতে পারেনি। কে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, কোথায় ভুল করছে, কী দুর্নীতি চলছে, মনসা বা বিকাশের মতো মানুষেরা তা জানতেও পারছেন না। তা হলে স্বচ্ছতা এল কোথায়?

ডিজিটাল পরিষেবাকে স্বচ্ছ, তৎপর ও দুর্নীতিমুক্ত হতে গেলে প্রথমে ব্যবস্থাটাকেই স্বচ্ছ, তৎপর এবং দায়বদ্ধ করে তোলা দরকার। তা না হলে সেটা ডিজিটাল অপশাসনে পরিণত হয়। এই ব্যাপারে অনেক দিন আগেই সাবধান করেছিলেন কেন্টারো টোয়মা। মাইক্রোসফটের গবেষণার প্রধান হিসেবে তিনি ভারতে এসেছিলেন— স্বপ্ন ছিল, ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভারতের স্কুলশিক্ষা আমূল পাল্টে দেবেন। পাঁচ বছর কাজ করে বুঝতে পারেন, আসল গলদটা কোথায়। সেই অভিজ্ঞতায় অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা তাঁর বিখ্যাত বইয়ে (দ্য গিক হেরাসি: রেসকিউয়িং সোশ্যাল চেঞ্জ ফ্রম দ্য কাল্ট অব টেকনোলজি) তিনি সারা বিশ্বের কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিকাঠামো ইত্যাদি ক্ষেত্রের উদাহরণ একত্র করে দেখান যে, সুশাসন থাকলে ডিজিটাল টেকনোলজি তাকেই প্রসারিত করে, অপশাসন থাকলে সেই অপশাসনই প্রসারিত হয়।

আর এক টেক-গুরু বিল গেটসও প্রকারান্তরে একই কথা বলেছিলেন তাঁর দ্য রোড অ্যাহেড বইটিতে। কোনও প্রতিষ্ঠান যদি তৎপর, দক্ষ হয়, ডিজিটাল ব্যবস্থা তার তৎপরতা, দক্ষতা অনেক গুণ বাড়িয়ে দেবে। আর প্রতিষ্ঠান অদক্ষ, আমলাতান্ত্রিক, গয়ংগচ্ছ মনোভাবাপন্ন হলে, বা দুর্নীতিগ্রস্ত হলে, ডিজিটাল ব্যবস্থা সেগুলিকেই আরও অতিকায় করে তুলবে। প্রযুক্তি সংস্থার শীর্ষকর্তারা যা বুঝতে পেরেছেন, ভারতের প্রশাসকরা কি তা বোঝেননি?

ভারতে ডিজিটাল অপশাসনের তিনটি ধারা দেখা যাচ্ছে। প্রথমত ডিজিটাল ব্যবস্থা মানুষকে দু’ভাগ করছে— যাঁরা ডিজিটাল ব্যবস্থায় সড়গড়, আর যাঁরা তা নন। যদিও যাঁরা এই ব্যবস্থা ব্যবহার করতে পারেন না, সেই মনসা, রূপালি, বিকাশদের প্রয়োজন সামনে রেখেই ডিজিটাল শাসনের আমদানি হয়েছিল। বলা হয়েছিল যে, পুরনো, দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থায় এঁরাই বঞ্চিত হন, ডিজিটাল ব্যবস্থায় সেই সব সমস্যা দূর হবে। দ্বিতীয়ত, ডিজিটাল ব্যবস্থা জনকল্যাণেরপ্রকল্প ও পরিষেবাগুলির সিদ্ধান্তগ্রহণের প্রক্রিয়াকে ক্রমাগত কেন্দ্রীভূত করেছে। পঞ্চায়েতিরাজ ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে বিকেন্দ্রিত শাসনব্যবস্থার যে কাঠামো গড়ে উঠেছিল, তার মূলে কুঠারাঘাত করেছে ডিজিটাল শাসন। সকলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে স্থানীয় শাসনের যে ব্যবস্থা ক্রমশ গড়ে উঠছিল, তাকে বাতিল করে ক্ষমতা আবার ফিরে গিয়েছে কেন্দ্রীভূত আমলাতন্ত্রের কাছে। এমনকি কেন্দ্র-রাজ্য শাসনের যে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে উঠেছিল, তা-ও ডিজিটাল শাসনের দৌলতে দুর্বল হয়ে গিয়েছে। বেশির ভাগ জনকল্যাণ প্রকল্প এখন কেন্দ্র থেকে সরাসরি নিয়ন্ত্রিত হয়। রাজ্যের ভূমিকা গৌণ থেকে গৌণতর হয়ে গিয়েছে।

অপশাসনের তৃতীয় ধারাটি সবচেয়ে গুরুতর। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনকল্যাণ প্রকল্প ও অধিকার-ভিত্তিক পরিষেবার ভিত্তি হল গণতান্ত্রিক তর্ক-বিতর্ক, এবং জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে জনতার নিরন্তর আদানপ্রদান। ডিজিটাল শাসন ও পরিষেবা এই গণতান্ত্রিকতাকে চুরি করেছে; অর্থ, ক্ষমতা, সিদ্ধান্তগ্রহণের প্রক্রিয়া আবার সেই অস্বচ্ছ আমলাতান্ত্রিকতায় ফিরে গিয়েছে। মূল প্রশ্নটা তাই রয়েই যাচ্ছে— প্রশাসন কী করে গণতান্ত্রিক, স্বচ্ছ, তৎপর, পারদর্শী ও দায়বদ্ধ হবে? ডিজিটাল প্রযুক্তির কাছে সে উত্তর আশা করা চলে না।

উন্নয়নবিদ্যা বিভাগ, আজ়িম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়

অন্য বিষয়গুলি:

Hacking Mobile Apps
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy