কিছু দিন আগে এক মা তাঁর মেয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যুর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগের ক্ষেত্র হিসাবে তার কর্মক্ষেত্রকে অভিযুক্ত করেন তিনি। এ দেশের বুকে এমন দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা কম নয়। এই অভিযোগের কারণটি দেখা যাক।
সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে অনিতা পেরিলের করা এই অভিযোগে নড়েচড়ে বসেছে ভারত সরকারের শ্রম দফতর, তদন্ত ও অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। অনিতা অভিযোগ করেন যে, তাঁর ছাব্বিশ বছরের মেয়ে আনা সেবাস্টিয়ান পেরিলের অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণ তার কাজের জায়গার বিষাক্ত বা টক্সিক পরিস্থিতি। যে সংস্থায় সে কাজ করত, তার নাম ও অন্যান্য খুঁটিনাটি-সহ অভিযোগ জানান তিনি। বেশি সময় ধরে একটানা কাজ করতে বাধ্য হওয়া, সারাক্ষণ দুশ্চিন্তায় কাজ করতে হওয়ার ফলে অ্যাংজ়াইটি ডিজ়অর্ডার, ঠিক সময় খাবার জল খাওয়ার সুযোগ না পাওয়ার ফলে শারীরিক ও মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে আনা। অসুস্থতা, শারীরিক অবনতি সত্ত্বেও কাজ করতে বাধ্য হওয়া এবং তার পরবর্তী সময়ে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় আনার।
আপাত ভাবে মনে হতে পারে, আরও কত নৃশংস হতে পারে অত্যাচার। শারীরিক নির্যাতনের পাশে এই ধরনের অভিযোগের কি আদৌ গুরুত্ব আছে?
কিছু তথ্য দেখে নেওয়া যাক। প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ৭.৫ লক্ষ মানুষ মারা যান কর্মক্ষেত্রে এই বিষাক্ত পরিস্থিতির কারণে। তাঁদের মধ্যে ৭০ শতাংশ মানুষই ‘হোয়াইট কলার’ কর্মজীবী। সোজা ভাষায়, সেই ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার উকিল শিক্ষক বা অফিসকর্মীরা, যাঁদের আমরা ধোপদুরস্ত হয়ে ল্যাপটপ হাতে অফিসে যেতে দেখি। অতিরিক্ত শ্রমের কারণে মৃত্যুর কথা শুনলে যে কায়িক পরিশ্রমের ছবি মৃত্যুর কারণ হিসাবে আমাদের সামনে ভেসে ওঠে, প্রকৃত অবস্থা সব সময় তা নয়। শ্রমসাধ্য বা কায়িক পরিশ্রমের কাজ, অনেক ক্ষেত্রে তার থেকে হওয়া দূষণের ভাগ নিজেদের ফুসফুসে নেওয়া, মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়ার কথা আমরা শুনেছি। কিন্তু যাঁদের মস্তিষ্ক, হৃদয়, ফুসফুসে বিষ প্রবেশ করাচ্ছে তাঁদের কর্মক্ষেত্র, তাঁদের কথা শুনব না?
ঠিক কী ভাবে প্রবেশ করে এই বিষ? যে ডাক্তারি পরিভাষা এই ক্ষেত্রে সর্বাধিক ব্যবহৃত হয় তা হল মস্তিষ্ক ও স্নায়ুকোষের মধ্যে সর্বক্ষণের ‘ফাইট-অর-ফ্লাইট’ ধরনের অ্যাংজ়াইটি বা দুশ্চিন্তার প্রকাশ। নাম থেকেই স্পষ্ট যে এই দুশ্চিন্তা তৈরি হয় এক ধরনের নঞর্থক অতিসক্রিয়তা রাখার প্রয়োজনীতা থেকে— যাকে আমরা ‘অ্যালার্ট’ থাকার নামে চিনি। যে কোনও সময় যে কোনও বিপদ হতে পারে, আমাদের সব সময় সেই বিপদের সঙ্গে লড়তে হতে পারে, আমি হেরে যেতে পারি, যদি না পারি তা হলে কী হবে, যদি কোনও কিছু খেয়াল না করি, ভুল করি, তা হলে কী হবে, এমন মানসিক অবস্থায় জীবন কাটান বহু সংখ্যক চাকরিরত মানুষ।
কোনও হিংস্র শ্বাপদ আক্রমণ করে না তাঁদের, হিংস্র ব্যবহার আসে মানুষের থেকেই। উচ্চপদস্থ মানুষটিই হোন, বা তাঁর সম-অবস্থানের সহকর্মীই হোন, কাজের জায়গার আবহাওয়াকে বিষাক্ত করে তোলেন অনেকেই। এই অত্যাচারের মাধ্যম মানসিক বা মৌখিক, ‘সাইকলজিক্যাল’/ ‘ভার্বাল অ্যাবিউজ়’। প্রত্যেক দিন শারীরিক বা মৌখিক ভাষার মাধ্যমে অপমান করার চেষ্টা। শারীরিক নিগ্রহও যুক্ত হয় অনেক সময়— যার করুণ পরিণতি দেখেন স্কুল কলেজ বা হস্টেল কর্তৃপক্ষ।
নাবালক শিশু বা কিশোরদের ক্ষেত্রে যদি কোনও মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাও করতে পারেন, কর্মক্ষেত্রের পূর্ণবয়স্ক মানুষদের ক্ষেত্রে এই হিংস্র ব্যবহারের কী ব্যাখ্যা? ভারতবর্ষের ৫৫% চাকরিরত মানুষ কর্মক্ষেত্রে ‘বুলিং’-এর শিকার, অনেকেই ‘প্যানিক অ্যাটাক’-এর মুখোমুখি হন কাজের জায়গায়, বলে ইউনিসনের একটি সমীক্ষা। সারা বিশ্বে, ২৩% চাকরিরত মানুষ কাজের জায়গায় মৌখিক হিংসার শিকার হন। ভারতবর্ষে এই হার বিশ্বের গড়ের দু’গুণেরও বেশি। মৌখিক ভাষার এই অত্যাচারে মিশে থাকে অপমান, ‘সেলফ-এস্টিম’ বা আত্মসম্মান-এর প্রতি আঘাতমূলক ব্যবহার, যার ফলে মনে বাসা বাঁধে অবসাদ ও নানা অসুখ।
তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকে শ্রমের নিয়মের নানাপ্রকার উল্লঙ্ঘন। ভারত কাজের সময়ের সাপ্তাহিক হিসাবে পৃথিবীর মধ্যে চতুর্থ স্থানে, যা প্রায় সপ্তাহে ৪৬.৭ ঘণ্টা। বিশ্ব শ্রম সংস্থা, বা আইএলও-র নিয়ম অনুযায়ী সাপ্তাহিক হিসাব হতে পারে সর্বাধিক ৪৮ ঘণ্টা। ভারতের গড় এই সর্বাধিকের নিয়মের বিপজ্জনক ভাবে কাছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় কর্মক্ষেত্রে কাজের সময়ের বাইরে, ছুটির দিনে ব্যক্তিগত সময়ে অনুপ্রবেশ।
ভারতের ৮৬% মানুষ কর্মক্ষেত্রে অসুখী। গ্যালাপের ২০২৪ সালের সমীক্ষা বলে, ৮৬% কর্মরত মানুষ কাজের জায়গায় মানসিক কষ্টের শিকার, নিজের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার সময় পান না তাঁরা।
পুণেতে কর্মরত সেই মেয়েটি মারা যায় মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে। তার কর্মজীবনের দৈর্ঘ্য ছিল মাত্র চার মাস। শ্রমের বাজারের তত্ত্ব, মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার চেষ্টা, বাড়ির লোকের স্নেহ কিছুতেই কমাতে পারেনি তার মনের কালিমা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy