E-Paper

দুর্নীতির চক্রব্যূহে মৃত্যু

সরকার ও প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি উন্মোচনে যুক্ত মানুষদের হত্যা করে সাক্ষ্য-প্রমাণ লোপ, সঙ্গে অন্যদের সতর্ক করাই দুর্নীতিতে জড়িয়ে থাকা লোকেদের প্রধান কাজ।

অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৪:৫৪
Share
Save

অটলবিহারী বাজপেয়ীর সোনালি চতুর্ভুজ সড়ক প্রকল্পের ইঞ্জিনিয়ার সত্যেন্দ্র দুবে গয়ার রাস্তায় গুলিবিদ্ধ হন ২০০৩-এর নভেম্বরে। তিনি ন্যাশনাল হাইওয়ে অথরিটি অব ইন্ডিয়া-র নিযুক্ত একটি প্রোজেক্টের ডিরেক্টর ছিলেন, কাজে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিলেন। তারও তেরো বছর আগে, ১৯৯০-এর মে মাসে বানতলায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য দফতর ও ইউনিসেফ কর্মী অনিতা দেওয়ান-সহ তিন জনের উপর আক্রমণ ও যৌন অত্যাচার হয়। অনিতা মারা যান। তিনি নাকি স্থানীয় সিপিএম পঞ্চায়েতের হাতে ইউনিসেফের টাকা নয়ছয়ের বৃত্তান্ত জানতেন। ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশনের ইঞ্জিনিয়ার সন্মুগম মঞ্জুনাথ উত্তরপ্রদেশের লখিমপুর খেরির দুটো পেট্রল পাম্পে ভেজাল তেল বিক্রির প্রতিবাদ করেছিলেন। ২০০৫-এর ১৯ নভেম্বর, গুলিতে ঝাঁঝরা তাঁর শরীর মেলে নিজেরই গাড়ির পিছনের সিটে। ঝাড়খণ্ডে পালামৌ জেলায় মনরেগা প্রকল্পে যুক্ত ইঞ্জিনিয়ার ললিত মেহতা খাদ্যের অধিকার নিয়ে আন্দোলন করতে গিয়ে বিপুল কেলেঙ্কারি আবিষ্কার করেন। আক্রান্ত হন ২০০৮-এর ১৫ মে। মধ্যপ্রদেশে বালি মাফিয়াদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের জন্য আইপিএস অফিসার নরেন্দ্র কুমার সিংহ ট্রাক্টরের নীচে চাপা পড়ে মারা যান ২০১২-র ৮ মার্চ। আইপিএস বিনোদ মেহতাকে গার্ডেনরিচ এলাকায় হত্যা করা হয় ১৯৮৪-র মার্চে।

সরকার ও প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি উন্মোচনে যুক্ত মানুষদের হত্যা করে সাক্ষ্য-প্রমাণ লোপ, সঙ্গে অন্যদের সতর্ক করাই দুর্নীতিতে জড়িয়ে থাকা লোকেদের প্রধান কাজ। ব্যক্তিগত থেকে প্রাতিষ্ঠানিক স্তর, রাজনৈতিক দল, বেসরকারি সংস্থা, সরকারের নানা বিভাগে দুর্নীতির ছড়াছড়ি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মী-নিয়োগ সব ক্ষেত্রই তার শিকার। এতে যে নাগরিকের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিপন্ন হতে পারে, পরিবেশের ক্ষতি হতে পারে, তা কেউ ধর্তব্যের মধ্যে রাখে না। দুর্নীতির অপরাধকে যাঁরা কর্তৃপক্ষ, পুলিশ বা জনসমক্ষে ফাঁস করেন, সেই ‘হুইসলব্লোয়ার’দের দাম চোকাতে হয় প্রাণ দিয়ে।

কলকাতার তরুণী পড়ুয়া-ডাক্তারটিও কি আর জি কর হাসপাতালের দুর্নীতি জেনে ফেলেছিলেন? এই হাসপাতালেই ২০০১ সালে অন্য এক পড়ুয়া সৌমিত্র বিশ্বাসের ঝুলন্ত মৃতদেহ উদ্ধার হয় হস্টেল থেকে, তিনি নাকি হাসপাতালের ভিতরে যৌনচক্রের দুর্নীতি জেনে ফেলেছিলেন। যে সব জালিয়াতির কথা উঠে আসছে তার মধ্যে আছে ফেলে দেওয়া সিরিঞ্জ, রক্তের পাউচ-সহ নানা মেডিক্যাল বর্জ্য কালোবাজারে বিক্রি এবং তা থেকে তৈরি মাদকের কারবার, হাসপাতালে জাল ওষুধের আমদানি ও ব্যবহার, হাসপাতালে যৌনচক্রের রমরমা ইত্যাদি। আশঙ্কা জাগে, এগুলোর কথা হয়তো অনেক পড়ুয়াই জানেন; সব জেনেই বছরের পর বছর এঁরা ডাক্তারি পড়া শেষে পেশাজগতে আসেন। কেউ প্রতিবাদের কথা ভাবেন না, কারণ তাতে চিহ্নিত ও একা হয়ে যাওয়ার ভয় আছে।

শহরে কি গ্রামে, বহু হাসপাতালেই এই সব চক্র সক্রিয়। কর্তৃপক্ষ তা জানেন না, এ কথা মানতে কষ্ট হয়। কর্তৃপক্ষের নীরব বা উদাস সমর্থনের, দেখেও না দেখার অভ্যাস হয়ে গেছে, কারণ তাঁদের স্বার্থ— ওষুধ কোম্পানি ও ব্যবসায়ীদের কাছে। অভিযোগ: জাল ওষুধ, এক্সপায়ারি ডেট পেরিয়ে যাওয়া ওষুধ দিয়ে তাজা ওষুধের দাম নিয়ে চলে যায় দুর্বৃত্তেরা, কোটি কোটি টাকা কামায়। ডাক্তার-কর্তৃপক্ষেরও জোটে অর্থ, বিদেশ ভ্রমণ। ব্যবসায়ীদের কথা না মানলে আরও উপর মহলের যোগাযোগ সূত্রে এসে যাবে বদলির অর্ডার। কয়েক বছর আগের ঘটনা, এক প্রতিবাদী মহিলা ডাক্তার কর্তৃপক্ষের রোষে পড়ে উত্তরবঙ্গে যেতে বাধ্য হন, তাঁর বিশেষ ভাবে সক্ষম সন্তানকে ফেলে রেখে। বার বার ফিরে আসার দরখাস্তেও কাজ হয়নি, শেষে বেছে নেন আত্মহননের পথ। ঝাঁ-চকচকে কর্পোরেট হাসপাতাল, নার্সিং হোমেও কি এই চক্র চলে না? বাইরে প্রকাশ পায় না, পেলেও ধামাচাপা পড়ে অচিরেই। সরকারি ক্ষেত্রে যত ক্ষণ না পরিস্থিতি চরমে উঠছে, তত ক্ষণ গোঁ ধরে বসে থাকা পুরনো অভ্যাস। ক্ষমতা হারানোর ভয় বড় ভয়।

শুধু হাসপাতাল বলে নয়, সরকারি অন্য কর্মক্ষেত্রগুলিও নানা ধরনের চুরি, জালিয়াতি, মাদক ব্যবসা, জুয়া, এমনকি যৌনচক্রের সম্ভাব্য ও গোপন অকুস্থল। কখনও বিরাট অফিসের জনবিরল এক কোনায়, কখনও কর্মী কোয়ার্টার্সেও অবাধে চলে এ সব কাণ্ড, কর্তৃপক্ষ জেনেও না-জানার ভান করে থাকেন। অনেক সময়েই দেখা যায় এই সব কুকীর্তিতে উঁচুতলার আধিকারিকের দোসর নিচুতলার কর্মী ও কর্মচারীরা। এ এক অদ্ভুত ‘দ্বিপাক্ষিক’ সম্পর্ক, আর্থিক ও অন্যান্য বিস্তর সুবিধা হবে বলে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে দু’পক্ষই।

আমরা যাঁরা এই সব কর্মক্ষেত্র ও দুর্নীতিচক্রের বাইরে থাকা সাধারণ নাগরিক, আমাদেরও এ সব অজানা নয়। আমাদেরই পরিবার সংসার বন্ধুবৃত্তের অনেকে এর শিকার। এমনকি অনেক ক্ষেত্রেই শিকারিও। আমরাই বা কখন জনপরিসরে কথা তুলেছি তা নিয়ে, দাবি করেছি— ঘুঘুর বাসা ভাঙা হোক? আমরা অন্যায় করি না হয়তো, অন্যায় সয়ে যাই। সে-ও তো সমান অপরাধ। কলিকালে ঘৃণারও জোর নেই, তৃণসম দগ্ধাতে পারে না আমাদের।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

R G Kar Medical College And Hospital Incident R G Kar Medical College and Hospital Rape Corruption

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।