কানপুরের গ্রিন পার্ক স্টেডিয়াম তখনও যুগোপযোগী আধুনিক হয়নি। ক্যালব্যালে পরিকাঠামো। সারা দেশের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বিমাতৃসুলভ প্রেস বক্স। টয়লেটটাও ঠিকঠাক নয়! ইডেন-টিডেন বা মোহালি সেই তুলনায় স্বর্গ!
দিনের নেট প্র্যাকটিসের শেষে গ্যালারির নীচের ড্রেসিংরুমের সামনে কোলাপসিব্ল গেটটা ধরে দাঁড়ালেন সচিন তেন্ডুলকর। পর দিন দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে টেস্ট ম্যাচে নামছে তাঁর দল। খুচরো কিছু ঔপচারিক প্রশ্ন। সচিন কোনওদিনই বাক্পটু নন। ফলে প্রশ্নোত্তরের মেনুও নিরামিষ। তিনি যখন পরিচিত সাংবাদিকদের দিকে সামান্য হেসে, কারও কারও জন্য পূর্বপরিচিতির খাতিরটুকু মাপমতো দেখিয়ে টুকটাক কথা বলছেন, আমি মন দিয়ে ‘ভারতীয় ক্রিকেট ঈশ্বর’-এর চেহারাটা দেখছিলাম।
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি। আনন্দবাজার পত্রিকার নয়াদিল্লি ব্যুরো থেকে পরীক্ষামূলক অভিযানে আমাকে পাঠানো হয়েছে ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা কানপুর টেস্ট ম্যাচ কভার করতে। ‘ফ্যানবয়’ হয়ে ক্রিকেট দেখি। কিন্তু ভক্ত আর রিপোর্টারের মধ্যে কি তুলনা হয়! ভক্ত দূর থেকে নৈবেদ্যর ডালি সাজায়। আর রিপোর্টার তার সাবজেক্টের সঙ্গে চুইংগামের মতো সেঁটে থাকার চেষ্টা করে। রাজধানীতে নিয়মিত রাজনীতি কভার করি। ফলে ক্রিকেটের কাউকে চিনিও না। না কর্মকর্তা, না ক্রিকেটার। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় তত দিনে ভারতীয় ক্রিকেটের আকাশে আবির্ভূত। কিন্তু তাঁর সঙ্গেও প্রাদেশিক কোনও আলাপ-টালাপ নেই। অতএব বিস্মিত বালক হয়ে চারদিকে ফ্যালফ্যাল করে দেখছি।
সচিনকেও সে ভাবেই দেখছিলাম। মুখটা গোলগাল। কিন্তু চোয়ালের দৃঢ়সংবদ্ধ রেখা খুব স্পষ্ট। গালের কোথাও বেবি ফ্যাট-ট্যাট নেই। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। কিন্তু মোটেই লালটুস নয়। টিভিতে দেখে যেমন মনে হয়, তেমন গাবলু চেহারাও নয়। উল্টে সমুদ্রনীল টি-শার্টের ভিতর থেকে ফুটে বেরোচ্ছে চ্যাপ্টা আর জমাট পেশি। চওড়া কাঁধ। সুঠাম ঘাড়ে চকচক করছে সরু সোনার চেন। ধোবিঘাটের পাটাতনের মতো নির্মেদ পেট, কোমর আর তলপেট। শর্টসের নিচে সুঠাম উরু। কাফ মাস্ল। পায়ের গোছ। চোখের ওকলে এম ফ্রেম ‘মিরর কোটেড’ (পরিভাষায় ‘মার্কারি কোটেড’) রোদচশমায় প্রতিবিম্ব পড়েছে সামনে দাঁড়ানো ভক্তিবিনম্র ভিড়ের। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় ডানহাতের কব্জিতে ঝিকোচ্ছে প্ল্যাটিনামের রিস্টলেট।
দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, কী অসম্ভব অধ্যবসায়-শৃঙ্খলা-অনুশাসন-তিতিক্ষায় তৈরি হয়েছে এই বিগ্রহ। এমনই তার ঝলকানি যে, সামনে দাঁড়ালে আপনা থেকেই জ্যোতির্বলয় সমেত আস্ত একটা মন্দির তৈরি হয়ে যায়!
গত সপ্তাহে একটা ভিডিয়ো দেখতে দেখতে কানপুরের সেই যাই-যাই বিকেলের কথা ঝপ করে মনে পড়ে গেল। ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে হেঁটে আসছে একটা চেহারা। ডানহাতের বাহুতে একটা প্রাচীন এবং সুবিশাল ট্যাটু। কিন্তু সেটা অতীতের চিহ্ন। চৌকো ফ্রেমে যে লোকটা হেঁটে আসছে, তার বয়স পঞ্চাশ। তার মণিবন্ধে অতীতের মহার্ঘ ঘড়ি নেই। ভারী ব্রেসলেট নেই। গলায় সোনার চেন নেই। যে লোকটাকে তার বান্দ্রা ওয়েস্টের বাড়ি থেকে গাড়ি করে তুলে এনে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছেন কোনও এক হিতৈষী। যে লোকটা তার আধ-খাওয়া সিগারেটটাও যত্ন করে শেষ করে। প্রতিটি সুখটান মেপে রাখে। যার মোবাইলের ফাটা স্ক্রিন তার ইদানীংকার জীবনের অব্যর্থ সূচক হয়ে দেখা দেয়।
লোকটার একগাল সাদা দাড়ি। মাথায় সস্তাদরের হ্যাট। পরনে সমুদ্রনীল টি-শার্ট। সেই টি-শার্টের বাঁ’দিকের বুকে এমব্লেম— ‘তেন্ডুলকর মিডলসেক্স গ্লোবাল অ্যাকাডেমি’। চোখে সেই ‘মিরর কোটেড’ ওকলে রোদচশমা।
তফাত— সেই সানগ্লাসের কাচে কোনও গুণমুগ্ধ ভিড়ের ছায়া পড়ছে না। বহু দিন পড়ে না।
কিন্তু তবু লোকটা নিজেকে প্রাণপণে ফূর্তিবাজ বলে প্রমাণ করতে চাইছে। মুম্বইয়ের ‘ক্রিকেট ক্লাব অব ইন্ডিয়া’-র কফিশপে তার জন্য অপেক্ষারত ‘মিড ডে’-র সাংবাদিক। সেই টেবিলের দিকে হেঁটে আসতে আসতে বৃষ্টিভেজা দুপুরে লোকটা আকাশের দিকে হাতের মুদ্রায় সঙ্কেত করে সুরে ভাঁজছে, ‘‘ইট্স রেইনিং, ইট্স রেইনিং, ইট্স রেইনিং! মেরা দিল রো রহা হ্যায়!’’ লোকটা খানিক ক্ষণ পর বলবে, ‘‘আমার অনেক টাকা চাই না। আমার শুধু একটু সাহায্য চাই।’’ অতীতের সতীর্থদের উদ্দেশে হাতজোড় করে বলবে, ‘‘ভাই, আমাকে একটু দয়া করো!’’
সেই আর্তিতে ফূর্তির নির্মোক ছিঁড়ে যায়। আরবসাগরের তীরভূমি ধরে অব্যর্থ আকুতি ভেসে আসে। ভেসে আসে করুণ মিনতি। জোলো এবং দমকা বাতাসে ফরফর করে না-লেখা আখ্যানের পাতা উল্টে যায়। সেই হাওয়া এক ধাক্কায় খুলে দেয় স্মৃতির কপাট। মনে হয়, ওই আকুতির মধ্যে জীবনের অব্যর্থ পাঠ আছে। যে পাঠ বলে— কখনও-সখনও ছোট ভুল করে ফেললেও জীবনের ‘কোর্স কারেকশন’ করা উচিত। নিজেকে শুধরে নেওয়া উচিত। যাত্রাপথে পয়েন্ট পাঁচ ডিগ্রি ঘুরলে একটা লোক হয়তো শ্যামবাজারের বদলে পাইকপাড়ায় গিয়ে পৌঁছবে। তখন দূরত্বটা খুব বেশি মনে হবে না। কিন্তু পরের দিকে সেই দূরত্বটাই টালা থেকে টালিগঞ্জ হয়ে যাবে। সেই ব্যবধান আরও বাড়তে থাকবে। বাড়তেই থাকবে।
নব্বইয়ের দশকে ভারতীয় ক্রিকেটের সম্ভবত উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। জীবনের প্রথম সাতটি টেস্ট ম্যাচে ৭৯৩ রান। সেই সাত ম্যাচে তাঁর গড় ছিল ১১৩.২৯ (ঠিকই পড়লেন)। দুটো ডাবল সেঞ্চুরি (আবার, ঠিকই পড়লেন। ঘটনাচক্রে, সচিনের টেস্টে দ্বিশতরান পেতে লেগেছিল সম্ভবত ১০ বছর)। একে বাঁ-হাতি। তার উপর চনমনে। মিডল অর্ডার ব্যাট। শর্ট বলের বিরুদ্ধে অন্য অনেক ভারতীয় ব্যাটারের মতোই দুর্বলতা ছিল। কিন্তু স্পিনের বিরুদ্ধে ফুটওয়ার্ক ঝলমলে। বলা হয়, বন্ধু সচিনের চেয়েও বেশি ট্যালেন্টেড ছিলেন। কিন্তু শেষ টেস্ট খেলেছেন ১৯৯৫ সালে। তখন তাঁর বয়স ২৪ বছরও হয়নি!
কক্ষচ্যুত তারকা? সম্ভবত নয়, নিশ্চিত ভাবে তা-ই। বিনোদ কাম্বলি ভারতের হয়ে শেষ ম্যাচ খেলেছিলেন ২০০৪ সালে। যে ম্যাচে ৫৪ রানে মুড়িয়ে গিয়েছিল ‘টিম ইন্ডিয়া’। ১৯৯২ এবং ১৯৯৬ সালে বিশ্বকাপের দলে ছিলেন। ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ইডেন গার্ডেন্সে শ্রীলঙ্কার হাতে ধ্বস্ত হয়েছিল আজহারউদ্দিনের ভারত। গ্যালারির ক্রোধ যখন ফেটে পড়ছে মাঠ জুড়ে, ম্যাচ রেফারি ক্লাইভ লয়েড ম্যাচ পরিত্যক্ত ঘোষণা করে শ্রীলঙ্কাকে জয়ী ঘোষণা করেন। মাঠ থেকে কাঁদতে কাঁদতে ড্রেসিংরুমে ফিরেছিলেন কাম্বলি। যে ফ্রেম আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের এক বৈগ্রহিক ছবি হয়ে রয়ে গিয়েছে।
১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপ টিমে কাম্বলিকে দরকার হয়নি। তার দশ বছর পর ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর ঘোষণা করেন সচিনের বন্ধু। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট থেকে অবসর ঘোষণা করেন ২০১১ সালে। ঘটনাচক্রে, যে বছর ইউসুফ পাঠান, হরভজন সিংহের কাঁধে চড়ে ওয়াংখেড়ে প্রদক্ষিণ করছেন সচিন। ক্রিকেটার হিসাবে শেষ স্বপ্নও ছোঁয়া হয়ে গিয়েছে তাঁর। দেশের হয়ে বিশ্বকাপ জেতা।
ঘটনাচক্রে, তার পরের বছর, ২০১২ সালেই গাড়ি চালাতে চালাতে আচমকা হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন কাম্বলি। স্টিয়ারিংয়েই ঢলে পড়েছিলেন। এক সহৃদয় মহিলা কনস্টেবল লীলাবতী হাসপাতালে নিয়ে যান। অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করে ধমনীর দু’টি ‘ব্লকেজ’ সরাতে হয়েছিল কাম্বলির।
সচিনের মতোই মুম্বই ক্রিকেটের ‘মহাগুরু’ রমাকান্ত আচরেকরের পাঠশালার ছাত্র কাম্বলি মোট ন’বার কামব্যাক করেছিলেন ভারতীয় দলে। রেকর্ড বলছে, ১৭টি টেস্টে ১,০৮৪ রান করেছেন সারদাশ্রম স্কুলে সচিনের সতীর্থ। গড় ৫৪.২০। ১০৪টি এক দিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে রান ২,৪৭৭। গড় ৩২.৫৯। ইদানীংকার টি ২০-র যুগে ‘মারকাটারি’ পরিসংখ্যান নয়। কিন্তু ভদ্রস্থ। যথেষ্ট ভদ্রস্থ।
সচিনের তিন বছর পর টেস্ট অভিষেক তাঁর। ভারতীয় ক্রিকেটে যৎপরোনাস্তি সংক্ষিপ্ত কেরিয়ারে। তৎসত্ত্বেও কাম্বলি এমন কিছু কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন, যা লিখতে গেলে প্রতিটিতে একটি করে বিস্ময়বোধক যতিচিহ্ন লাগে।
স্কুল ম্যাচে সচিনের সঙ্গে ৬৬৪ রানের অপরাজিত জুটি! রঞ্জি ট্রফি অভিষেকে ব্যাট করতে নেমে প্রথম বলেই বিশাল ছক্কা! শেন ওয়ার্নের এক ওভারে ২২ রান মারা! ভারতীয়দের মধ্যে বয়ঃকনিষ্ঠ (২১ বছর ৩২ দিন) ক্রিকেটার হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম ডাবল হান্ড্রেড! টেস্টে দ্রুততম ১,০০০ রান (১৪টি ম্যাচে)! সব ফরম্যাট মিলিয়ে ৫৯ ম্যাচ পরে প্রথম ‘ডাক’ (শূন্য)! প্রথম ভারতীয় ক্রিকেটার, যিনি নিজের জন্মদিনে এক দিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে সেঞ্চুরি করেছেন!
কিন্তু ব্যস! ওই পর্যন্তই। কিছু খেলোয়াড় ‘গ্রেট’ হতে পারেন। কারও কারও সম্পর্কে বলা হয়, ‘গ্রেট’ হতে পারতেন। কাম্বলি দ্বিতীয় দলে পড়েন। ফ্ল্যামবয়েন্ট জীবনযাত্রার লোভ তাঁকে বিচ্যুত করেছে। পথভ্রষ্ট করেছে। ক্রিকেটের সাধনা থেকে উড়িয়ে নিয়ে ফেলেছে বাইরের চাকচিক্যে। যখন তাঁর মাথা নীচু করে ব্যাট-প্যাডের মাঝখানের ফাঁক ভরাট করার চেষ্টা করা উচিত ছিল, তখনই কাম্বলি ভেসে গিয়েছিলেন অনাচার, উচ্ছৃঙ্খলতা আর নৈরাজ্যের জোয়ারে। ভুলে গিয়েছিলেন জীবন কখনও কখনও নির্দয়, নির্মম এবং নিষ্ঠুর হয়।
ক্রিকেট খেলতে খেলতেই হিন্দি, মরাঠি, কন্নড় মিলিয়ে চারটে ছবি এবং কিছু সিরিয়ালে ছুটকো অভিনয়। সোনার গয়নার প্রতি অসীম দুর্বলতা। হাতি বাঁধার শিকলের মতো মোটা সোনার হার। দু’কানে সোনার দুল। চুলে হিলিবিলি বাহারি ছাঁট। যা দেখে এখনকার দিনের রাসেল-টাসেলের মতো ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেটারদেরও সেরেল্যাক-ভোগী শিশু মনে হবে। পাশাপাশি তাঁর দৈনিক যাপন। ভারতীয় ক্রিকেটের ‘ফিসফিসে কুঞ্জ’ তাঁর রগচটা টেম্পারামেন্টের কথা বলে। বলে পানীয়-আসক্তির কথা। ম্যাচের পর রাতে উচ্ছৃঙ্খলতার জোয়ারে ভেসে যাওয়ার কথা (যা বিবিধ সময়ে রুমমেটদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটিয়েছে)। সঙ্গে ক্রিকেট নিয়ে নিয়ত এবং আপাত অর্থহীন নিরীক্ষা। যার মধ্যে অন্যতম ‘কুখ্যাত’ ব্যাটের হাতল আরও মোটা করা। একটা সময়ে ব্যাটে ন’টা রবার গ্রিপ পরিয়েও খেলেছেন কাম্বলি। মুম্বইয়ের মাঠে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে তাঁর ২০০ দেখে অভিভূত সুনীল গাওস্কর নিজের হাতের দামি ঘড়ি খুলে উপহার দিয়েছিলেন। সেই কাঁড়ি কাঁড়ি রান কিন্তু একটা গ্রিপের ব্যাটে খেলেই এসেছিল!
পুণের হোটেল রিসেপশনিস্টকে চটজলদি বিবাহ। সাত বছর পর সেই বিয়ে ভেঙে এক মডেলের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া। সেই বিয়ের জন্য ধর্ম বদলে খ্রিস্টান হওয়া। ২০০৯ সালে সহ-সভাপতি হিসেবে কে জানে কোথাকার ‘ভক্তিশক্তি পার্টি’-তে যোগদান। বিধানসভা ভোটে লড়া এবং হার। কোথা থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন! আর কোথায় গিয়ে পৌঁছেছিলেন কাম্বলি!
বার বার ব্যর্থ প্রতিজ্ঞা। প্রতিভার ফুলঝুরি হয়ে জ্বলতে শুরু করে ফুলঝুরির মতোই দ্রুত নিভে যাওয়া। বসন নয়, উড়ন তুবড়ির মতো জ্বলতে জ্বলতে মাটি থেকে উপরে উঠে নিজের গতিপথ নির্ধারণ করতে না-পারা এবং শেষ পর্যন্ত মুখ থুবড়ে-পড়া— চুম্বকে এই হলেন বিনোদ কাম্বলি।
পাশাপাশি ছোটবেলার বন্ধুর রকেটগতির উড়ান। যত কাম্বলির পারফরম্যান্স পড়েছে, ততই সচিনের এলিভেটর তরতর করে উপরে উঠেছে। উঠতে উঠতে এক সময় নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে। দিনের শেষে তেন্ডুলকর ‘ক্রিকেট ঈশ্বর’ হয়েছেন। আর কাম্বলি রয়ে গিয়েছেন এক না-হওয়া মহাকাব্য হয়ে।
শেষ কোচিং করিয়েছেন ২০১৯ সালে। মুম্বই টি২০ লিগে। কোভিডের পর যে লিগ এখনও নতুন করে শুরু হতে পারেনি। কাম্বলিকে এখন জীবনধারণ করতে হয় বিসিসিআইয়ের ৩০ হাজার টাকার মাসিক পেনশনের উপর নির্ভর করে। সেজন্য বোর্ডের কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা আছে তাঁর। কিন্তু শুধু কৃতজ্ঞতা ধুয়ে কি আর জীবন চলে!
অতীতচারণের প্রসঙ্গে কাম্বলি বলছিলেন, ‘‘বিনোদ কাম্বলি ইজ বিনোদ কাম্বলি! আমি বলছি না কাউকে আমার মতো হতে হবে। কিন্তু কোনও ক্রিকেটার যদি মদ্যপান করতে চায় তো সে করবে! কেউ যদি লড়কিবাজি করতে চায় তো করবে! ওসব কে না করতে চায়! কে না করে! আমরা হলাম বিন্দাস। বান্দা ইয়ে বিন্দাস হ্যায়। করলে করো! অত ভাবার কী আছে!’’
মন দিয়ে তাঁর কথাগুলো শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, এখনও কি তাঁর জিহ্বা সামান্য শিথিল? কোথাও কি এখনও তাঁকে ছুঁয়ে আছে সামান্য স্খলন? অথবা ঈষৎ বিচ্যুতির রেশ? যে বিচ্যুতি মাত্রা ভুলিয়ে দেয়। হুল্লোড় আর দায়িত্বের বিভাজনরেখা গুলিয়ে দেয়। নইলে যে তিনি বলছেন, ‘‘সাত বছর মদ্যপান করিনি’’, সেই তিনিই পিঠোপিঠি কেন বলছেন, ‘‘তবে কোনও ফাংশন-টাংশনে গেলে...।’’ বাক্য শেষ হচ্ছে না। তবে তার নিহিত অর্থ বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না।
কাম্বলি বলছিলেন, ‘‘আমি রিটায়ার্ড ক্রিকেটার। যার জীবন পুরোপুরি পেনশন-নির্ভর। তার জন্য আমি বোর্ডের কাছে কৃতজ্ঞও। কিন্তু আমার অ্যাসাইনমেন্ট (পারিশ্রমিক নির্ভর কাজ) চাই। যাতে আমি তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে কাজ করতে পারি। জানি, মুম্বই অমল মুজুমদারকে হেড কোচ হিসেবে পুনর্বহাল করেছে। কিন্তু আমাকে দরকার হলে আমিও আছি। আমি-অমল একটা সময়ে একসঙ্গে খেলেছি। অ্যান্ড উই ওয়্যার আ গ্রেট টিম! আমি চাই, মুম্বই ক্রিকেটও একটা টিম হয়ে খেলুক!’’
বলছিলেন, ‘‘আমি এমসিএ (মুম্বই ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন)-র কাছে সাহায্য চেয়েছিলাম। আমি তো ক্রিকেট ইনভল্ভমেন্ট কমিটিতে ছিলাম। কিন্তু সেটা সাম্মানিক পদ (অর্থাৎ, পারিশ্রমিকহীন)। আমার একটা পরিবার আছে। তাদের ভরণপোষণ আছে। এমসিএ-কে অনেক বার বলেছি, দরকার হলে আমায় যেন বলা হয়। ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম হোক বা ব্রেবোর্ন, আমি চলে আসব। মুম্বই ক্রিকেট আমায় অনেক কিছু দিয়েছে। আমি ক্রিকেটের জন্য জীবন দিতে পারি।’’
সচিন কিছু জানেন?
কাম্বলি জবাব দেন, ‘‘সব জানে। কিন্তু আমি ওর কাছ থেকে কিছু আশা করি না। ও আমায় তেন্ডুলকর মিডলসেক্স গ্লোবাল অ্যাকাডেমির অ্যাসাইনমেন্টটা দিয়েছিল। তখন খুব ভাল লেগেছিল। সচিন আমার খুবই ভাল বন্ধু। ও সব সময় আমার পাশে থেকেছে।’’
এটুকুই? আপাত নির্লিপ্তির আবডালে কোথাও কি ক্ষোভ উঁকি মেরে গেল? গেল বোধহয়। যাঁর টুইটার হ্যান্ডলে সবচেয়ে উপরে ‘পিন’ করা টুইটটাই সচিনকে নিয়ে, এমনকি, সচিনপুত্র অর্জুনকে নিয়েও যিনি গর্বের টুইট করেছেন, তিনি কী করে বাল্যবন্ধু সম্পর্কে এতটা নির্মোহ, নিরাবেগ এবং ফর্ম্যাল হন! মনে হচ্ছিল, বাল্যসুহৃদের কঠিনতম সময়ে দূরত্ব রচনাকারী সচিনকে নিয়ে ক্ষোভের আগুন কাম্বলি কৌটোয় ভরে রেখেছেন। আত্মশ্লাঘার কারণে প্রকাশ করতে পারছেন না। কান্না চাপতে চাপতে নিশ্বাস প্রায় বন্ধ করে দিচ্ছেন। কিন্তু তাঁর জঠরের আগুন জ্বলছে।
মনে হচ্ছিল, জীবনের শুরুতে সামান্য বিচ্যুতি কোথায় নিয়ে গেল বিনোদ গণপত কাম্বলিকে। আর কোথায় চলে গেলেন সচিন রমেশ তেন্ডুলকর!
আসলে আমরা সকলেই কখনও না কখনও আধো অন্ধকারে একটা ভুল পা ফেলি। এক মুহূর্তে একটা ভুল প্রশ্বাস নিই। ভুল লোকের হাত ধরে ফেলি। তাতে কোথাও একটা চুলের মতো সূক্ষ্ম ফাঁক তৈরি হয়। সেই ফাঁকটা ক্রমে ফোকর হয়। তার পর চওড়া হতে হতে ফাটল হয়। তার পরে সেটাই ব্রহ্মাণ্ডপ্রমাণ হয়ে যায়। আমরা প্রথমে সেই বিচ্যুতিকে ‘মজা’ ভাবি। ‘দুধভাত’ ভাবি। পর্যায়ক্রমে সেটাই গরল হয়ে আমাদের গ্রাস করে।
যেমন করেছে বিনোদ কাম্বলিকে। প্রতিভার বিচ্ছুরণ দেখিয়েও তাই তিনি মহাকাব্য হন না। আখ্যানও হন না। জীবনের খাতায় থেকে যান নিছক ‘ফুটনোট’ হয়ে।
(গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy