অতঃপর? এক মানব্যাপী অভূতপূর্ব নাগরিক আন্দোলনে শামিল নবীনরাও। কলকাতা ছবি পিটিআই।
পশ্চিমবঙ্গের তরুণ চিকিৎসক সম্প্রদায়ের প্রতি আবেদন: আপনাদের আন্দোলন এক মাসে পড়ল। দেশবাসী আপনাদের সঙ্গে। সবচেয়ে বড় কথা, এই রাজ্যের সাধারণ মানুষ, বিশেষত মেয়েরা, রাস্তায় ঢল নামিয়ে অভূতপূর্ব মাত্রায় আপনাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, রাজনীতি দূরে রেখে, গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক হিসাবে সুস্থ নিরাপদ রাষ্ট্রিক জীবন ফিরে পাওয়ার দাবিতে।
এমনটা ঘটেছে, কারণ আপনাদের নিহত সহকর্মীর মর্মন্তুদ পরিণতি যদিও একান্ত তাঁরই (আর কারও যেন না হয়), তাতে আতশকাচের মতো ধরা পড়েছে শাসনব্যবস্থার সার্বিক বিপর্যয়, সিস্টেমিক ফেলিয়োর। সেই বিপর্যয়ের নানা প্রকাশে আমরা প্রত্যেকে প্রত্যহ আক্রান্ত— গোচরেই আসে না, এলেও ভবিতব্য বলে মেনে নিই। কিন্তু মনে-মনে প্রতিবাদ জমতে থাকে, শেষে এক দিন বাঁধ ভেঙে ফেটে বেরোয় পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, ভীতি, হতাশা— এবং অবশ্যই প্রতিকারের ক্ষীণ প্রত্যাশা, নইলে আন্দোলন করছি কেন? আজ এমন একটা মুহূর্ত। যে প্রতিবাদ এত দিন বাঁচার তাগিদে এড়িয়ে গেছি, আজ মনে হচ্ছে না-করলে বাঁচব না।
আমাদের সমাজ ও প্রশাসন জুড়ে ব্যাপক ও বহুলাংশে পরিকল্পিত অভিসন্ধিমূলক অনাচার। তার বৃহত্তম কারণ দলীয় রাজনীতির রাহুগ্রাস: কোনও বিশেষ দল নয়, সব ক’টির মিলিত বাস্তুতন্ত্র। আমরা সাধারণ মানুষ আমাদের নাগরিক অস্তিত্ব তাদের কাছে ইজারা দিয়ে নিষ্ক্রিয় ছিলাম। আজ ইজারার মাসুল গুনতে গিয়ে দেখছি জনজীবন দেউলিয়া, তাই দালাল হটিয়ে হারানো নাগরিক উত্তরাধিকার ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছি।
ইজারাদাররা এতে স্বভাবতই অখুশি, ব্যবসা ফিরে পেতে মরিয়া। তারা পথে নামিয়েছে নতুন এক দল বিক্ষোভকারীকে। গত তিন সপ্তাহ রাজ্য জুড়ে ছোটবড় কয়েকশো বিক্ষোভ হয়েছে। সব ক’টি একান্ত শালীন, শান্তিপূর্ণ, সুশৃঙ্খল। নয়া বিক্ষোভের চিত্র হিংসাত্মক, ছন্নছাড়া; তার উপজীব্য ভাঙচুর, পুলিশকে আক্রমণ, আগ্রাসী রাজনৈতিক আস্ফালন। এমন তাণ্ডব মৃতার স্মৃতির প্রতি অবমাননাকর, ন্যায়বিচারের দাবির পবিত্রতা কলুষিত করছে।
এ সব কোন দলের কীর্তি সে প্রশ্ন প্রায় অবান্তর, কারণ সব দলই এই মওকায় তাদের চিরাচরিত বন্ধ্যা অরাজক রাজনীতিতে ফেরার রাস্তা পেল, সুযোগ পেল বিচারকামী নাগরিকদের শুভ প্রচেষ্টাকে দেগে দেওয়ার, এলেবেলে করে দেওয়ার। বাকি ভারতে ও অনাবাসী সমাজে ইতিমধ্যেই গল্প চালু যে একদা সদর্থক আন্দোলনের এই হীন পরিণতি। এ রাজ্যেও কিছু মানুষ ক্রমে এমন ভাবতে শুরু করবেন। মানুষ হতাশা ও বিতৃষ্ণায় আন্দোলন থেকে সরে আসবেন।
সেই সঙ্গে জোরদার হবে আপনাদের কর্মবিরতির প্রশ্ন। বিরতির স্বপক্ষে আপনাদের অবস্থান স্পষ্ট। তাকে মান্যতা দিয়ে রোগী ও তাঁদের পরিজন এখনও নিজেদের ক্ষতি ও হয়রানি মোটের উপরে মেনে নিচ্ছেন। ক্ষতির— হয়তো চরম ক্ষতির মাত্রা দিনে-দিনে বাড়লে কিন্তু জনসমর্থনে ভাটা পড়তে বাধ্য। ২০১৯-এ এনআরএস কাণ্ডে এটাই হয়েছিল, এ বারও অবধারিত ভাবে সেই লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
চতুর কর্তৃপক্ষ অপেক্ষায় থাকেন এমন মুহূর্তের জন্য। সুযোগ বুঝে একটা চটজলদি বোঝাপড়া করে প্রতিবাদ স্তব্ধ করে, দমনপীড়ন শুরু করেন। আর আছে আদালত। উচ্চ আদালত এ-যাবৎ আপনাদের কাজে ফিরতে ‘অনুরোধ’ বা ‘আবেদন’ করেছে; সেটা ‘আদেশ’-এও পরিণত হতে পারে।
অত্যন্ত সঙ্কোচ ও বিনয়ের সঙ্গে, এক সাধারণ নাগরিক হিসাবে কিছু প্রস্তাব তাই নিবেদন করছি। হয়তো সেগুলি অবান্তর বা অবাস্তব, আপনাদের কর্মক্ষেত্র সম্বন্ধে আমার অজ্ঞতার পরিচয়, তবু আমার ধৃষ্টতা মার্জনা করে একটু ভেবে দেখুন।
সবার আগে আবেদন, কোনও চাপ বা হুকুমের অপেক্ষায় না থেকে আপনারা কাজে ফিরে আসুন, জনগণের মুখ চেয়ে। সরকার সিবিআই আদালত— কাউকে নায়কের ভূমিকায় অবতরণের সুযোগ দেবেন না। কাজে ফেরা হোক একান্ত ভাবে আপনাদের পেশাগত ও মানবিক সিদ্ধান্ত।
আন্দোলনের তবে কী হবে? এ তো সাধারণ মানুষেরও নিরাপত্তা ও সম্মানরক্ষার লড়াই। মহিলা-চিকিৎসকের যদি এই নিয়তি, মহিলা-রোগীরা কোথায় যাবেন? আপনাদের কর্মস্থল সিস্টেমিক অনাচারের লীলাক্ষেত্র। দিশাহারা রোগীপক্ষ বেডের আশায় নেতার সুপারিশের জন্য হন্যে হয়ে বেড়ান; কিংবা সিস্টেম-আশ্রিত দুষ্কৃতীদের হাতে টাকা গুঁজে দেন, ওষুধ ও পরীক্ষার জন্য দালালের শরণাপন্ন হন; এবং ক্ষোভে ফেটে পড়েন। আক্রান্ত হন আপনারাই, অথচ প্রতিকারের ক্ষমতা আপনাদের হাতে নেই।
রোগী ও চিকিৎসক একই অনাচার ও অব্যবস্থার শিকার, অথচ তাঁদের অবস্থান হয়ে পড়ে প্রতিপক্ষীয়। আপনারা তখন নিজেদের নিরাপত্তার দাবিতে আন্দোলনে নামেন। এতে ভারাক্রান্ত চিকিৎসাব্যবস্থা আরও বিপর্যস্ত হয়। সাধারণ মানুষ দুর্দশায় পড়েন, চিকিৎসকেরা সহানুভূতি হারান।
মিছিল-অবস্থান অবশ্যই চলুক, আপনাদের ও সহমর্মী নাগরিকদের। কিন্তু আবেদন, একই সঙ্গে আন্দোলন চলুক এক নতুন মুখ্য রূপে— হাসপাতালে চিকিৎসাদানের সময়ে, পাশাপাশি। এ কাজটা একমাত্র আপনারাই পারবেন, কোনও রাজনৈতিক দল বা বহিরাগত নয়। কাজটা কী? যে রোগী ও পরিজনদের সঙ্গে আপনাদের নিত্য সংস্রব, তাঁদের (অতএব জনসাধারণকে) বিশদ ও নিরন্তর ভাবে জানতে দিন স্বাস্থ্যক্ষেত্রের মজ্জাগত ঘাটতি ও অনাচারের কথা। এ সব তাঁরা ঠিকমতো জানেন না, জানতে দেওয়া হয় না; সামনে পেয়ে আপনাদের উপরই ক্ষোভ উগরে দেন। এই অবস্থার প্রতিকার হোক কেবল আপনাদের নয়, সকলের দাবি।
প্রত্যেক হাসপাতালের প্রত্যেক বিভাগে দেওয়ালে থাকুক ৯ অগস্টের ঘটনার স্মরণিকা, তার পর কত দিন কাটল সেই হিসাব। সঙ্গে এক-আধ বার এক-আধ জায়গায় নয়, প্রত্যহ, খুঁটিয়ে, সর্বত্র টাঙিয়ে দিন আপনাদের মৌলিক সমস্যাগুলির বিবরণ, যথা:
(১) বিভাগের আবাসিক ডাক্তারেরা একটানা কত ঘণ্টা ডিউটি করেন। তাঁদের বিশ্রামের জন্য কী ব্যবস্থা, কী নিরাপত্তা।
(২) বিভাগে প্রত্যহ কত রোগী আসেন, পরিষেবায় থাকেন কত জন ডাক্তার, নার্স ও অন্য কর্মী; অতএব গড়ে রোগী-প্রতি কতটা সময় ও লোকবল বরাদ্দ।
(৩) কী কী অপরিহার্য যন্ত্র বা ওষুধ নেই। কোন যন্ত্র বিকল বা অব্যবহৃত হয়ে পড়ে আছে।
(৪) ভবনের রক্ষণাবেক্ষণ, জল বিদ্যুৎ ইত্যাদি ব্যবস্থায় কী কী দীর্ঘমেয়াদি ত্রুটি বা ঘাটতি আছে।
(৫) আর কী কী অনাচার ও অন্যায় চাপের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। রোগীপক্ষের আক্রমণও এর মধ্যে পড়বে।
এই বৃত্তান্ত নিয়মিত বিশদ ভাবে রোগীদের সঙ্গে শেয়ার করুন। তাঁরা বুঝবেন, আপনাদের সমর্থন করবেন, হাসপাতালের যথার্থ উন্নয়নের জন্য গঠনমূলক জনমত সৃষ্টি হবে। কর্তৃপক্ষের উপর কর্তব্যপালনের চাপ বাড়বে এবং অব্যাহত থাকবে। পরিচালনার দোষত্রুটি অবহেলার দায় আপনাদের আক্রান্ত হয়ে মেটাতে হবে না, অপশাসনের ফলে জীবন বলি দিতে হবে না।
আজ বাংলার পাশে দাঁড়িয়েছে সারা দেশের চিকিৎসক সমাজ। অন্য রাজ্যেও অনাচার কম ঘটে না। আপনাদের দৃষ্টান্তে, আপনাদের নিহত নির্যাতিত সহকর্মীর স্মরণে যদি ভারতের সর্বত্র তরুণ চিকিৎসকেরা উপরোক্ত ব্যবস্থা চালু করেন, তাঁর স্মৃতি কেবল বেদনাময় নয়, মঙ্গলময় হয়ে উঠবে।
প্রবীণদের কাছেও একটি প্রার্থনা। একটা জনরবে রাজ্যবাসী বিশেষ উৎকণ্ঠিত। ডাক্তারি পরীক্ষার ফল নিয়ে ব্যাপক অনাচারের অভিযোগ উঠছে: অযোগ্য ছাত্র সসম্মানে পাশ, মেধাবীরা ধরাশায়ী। স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়টি অনুসন্ধান করছে কি? শিক্ষক-চিকিৎসকেরাই বা কী বলেন? শিক্ষকমাত্রেই মানবেন, এমন অনাচার পুরো শিক্ষককুল বা পরীক্ষককুলের অগোচরে চলতে পারে না, বিশেষত যেখানে ছাত্র-শিক্ষক-পরীক্ষকমণ্ডলী অপেক্ষাকৃত ছোট ও পরস্পরের পরিচিত। প্রবীণ চিকিৎসক-মহল যদি সমবেত ভাবে বিবৃতি দিয়ে গুজবটা খণ্ডন করেন, রাজ্যের মানুষ আশ্বস্ত হবে। আর যদি অভিযোগে এতটুকু সত্যতা থাকে, আজও তাঁরা সরব না হলে এই মারণ অপরাধের দায়ভাগ পুরো চিকিৎসক সমাজের উপর বর্তাবে।
প্রবীণ-নবীন সব চিকিৎসকের কাছে নিবেদন: আপনারা অনেক সহ্য করেছেন, অনেক অনাচার চোখের সামনে দেখেছেন, নীরব থেকে জনগণের কাছে সেই অনাচারের দায়ভোগী হয়েছেন। অথচ একই অনাচার ও অপশাসনে আপনারাও নানা ভাবে বিপর্যস্ত, আর জি করের ঘটনা তার চূড়ান্ত প্রকাশ। আপনাদের দোহাই, আজকের ক্ষোভ আর দুশ্চিন্তা আন্দোলনের বাতাসে মিলিয়ে যেতে দেবেন না, তার কিছু স্থায়ী কল্যাণকর ফল দেশের মানুষ যেন পায়। আপনাদের জয় হোক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy