Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Beedi Industries

সুতোয় বাঁধা জীবন

মুর্শিদাবাদের প্রায় অর্ধেক বাসিন্দা বিড়ি শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে যুক্ত। শেষ জনগণনার (২০১১) হিসাব অনুযায়ী জেলার ৬৭ শতাংশ মানুষ গৃহশিল্পের সঙ্গে যুক্ত।

নব দত্ত
শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০২৪ ০৭:৪৭
Share: Save:

মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুরের আরতি, রুমেলি, সুমাইয়া এক ধরনের খেলা চালায় নিজেদের মধ্যে। তারা ছ’জন করে দুটো দলে ভাগ হয়ে যায়। এক দল নেয় লাল সুতো, অন্য পক্ষ বেগুনি সুতো। একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কত বিড়ি বাঁধতে হবে, সেই প্রতিযোগিতায় যারা হেরে যায়, তাদের একশো বিড়ি বেঁধে দিতে হয় বিজয়ীদের।

মুর্শিদাবাদের প্রায় অর্ধেক বাসিন্দা বিড়ি শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে যুক্ত। শেষ জনগণনার (২০১১) হিসাব অনুযায়ী জেলার ৬৭ শতাংশ মানুষ গৃহশিল্পের সঙ্গে যুক্ত। অনুমান করা যায়, এঁদের অধিকাংশ বিড়ি শ্রমিক। ফরাক্কা, সামসেরগঞ্জ, সুতি— এই সব এলাকায় থাকেন। জেলা কর্তৃপক্ষের সমীক্ষায় (১৯৯৬-১৯৯৯) ৮৮ হাজার শিশু বিড়ি-কর্মী চিহ্নিত হয়েছিল। যশোধারা বাগচী ও অসীম মুখোপাধ্যায়ের গবেষণা থেকে জানা যায়, জেলায় তিন লক্ষ বিড়ি শ্রমিক আছেন, যার ১৫ শতাংশ শিশুশ্রমিক। এরা অধিকাংশ কন্যাসন্তান।

আসলে মুর্শিদাবাদের হস্তশিল্প ক্রমশ কমেছে। অন্য দিকে, বিড়ি বাঁধা বিপজ্জনক কাজ জেনেও মানুষ আঁকড়ে ধরেছেন। ‘টোব্যাকো ফ্রি জেনারেশন’ সংস্থা তার সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে ১৩ শতাংশ ক্ষেত্রে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে শিশুরাও বিড়ি বাঁধে। বোঝাই যায় যে আর্থিক প্রয়োজনে এই কাজে পরিবারগুলি শিশু-কিশোরীদের যুক্ত করেছে।

সরকার-নির্ধারিত মজুরির (হাজার বিড়িতে ২৬৪ টাকা) থেকে বিড়ি শ্রমিকদের ৩০-৪০ শতাংশ কম টাকা দেওয়া হয় (১৫০-১৮০ টাকা)। তার উপর এক হাজার বিড়ির থেকে ১৩০-১৫০টি বিড়ি নানা খুঁত ধরে বাদ দিয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। যার অর্থ, প্রতি দিন রাজ্যের প্রায় ১৫ লক্ষ বিড়ি শ্রমিককে অন্তত ১৩০টা বিড়ি তৈরির মজুরি দেওয়া হচ্ছে না। এই বিপুল পরিমাণ টাকা কার কাছে যাচ্ছে?

এক জন শ্রমিকের গড় মাসিক রোজগার ছ’শো টাকা থেকে পাঁচ হাজার টাকা। বিড়ি শ্রমিকদের নানা ধরনের সুবিধা প্রাপ্য, কিন্তু তার জন্য দরকার সরকারি পরিচয় পত্র (বিড়ি কার্ড)। রাজ্যের বিড়ি শ্রমিকদের মধ্যে তিন জনে দু’জনেরই তা নেই। কেন নেই? এখানেও কারণ চুরির দোষারোপ— রাজ্য সরকার ভুয়ো কার্ড দেখিয়ে বাড়তি সুবিধা নিয়ে নিচ্ছে, তাই নতুন কার্ড বিতরণ বাতিল করেছে কেন্দ্র। সরকারের ব্যর্থতার জন্য কেন কল্যাণ প্রকল্প থেকে সুবিধা পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন গরিব শ্রমিক? উত্তর ২৪ পরগনায় প্রায় এক লক্ষের মতো বিড়ি শ্রমিক রয়েছেন, মাত্র কুড়ি জনের পিএফ আছে। মুর্শিদাবাদে তিন লক্ষের বেশি শ্রমিকের পিএফ নেই। এ রাজ্যে বিড়ি শিল্পের থেকে প্রতি বছর কয়েকশো কোটি টাকা সেস বাবদ আদায় হয়। অথচ, সে টাকার কতটুকু শ্রমিকের কাছে পৌঁছয়?

অথচ, বিড়ি শ্রমিকের জন্য বরাদ্দ টাকা পড়ে আছে, খরচ হচ্ছে না। রাজ্যসভায় এক প্রশ্নের উত্তরে প্রাক্তন শ্রম প্রতিমন্ত্রী রামেশ্বর তেলি জানান, বিড়ি শ্রমিকদের চিকিৎসার খরচের জন্য ২০২২-২০২৩ অর্থবর্ষে (২২ জুলাই পর্যন্ত) বরাদ্দ ছিল ১৫.৬৩ কোটি টাকা। খরচ হয়েছে মাত্র ৬২ লক্ষ টাকা। সন্তানের প্রথম শ্রেণি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত পড়াশোনার জন্য বিড়ি শ্রমিকদের প্রতি বছর এক হাজার টাকা থেকে ২৫ হাজার টাকা আর্থিক সাহায্য পাওয়ার কথা। ২০২২-২৩ সালে এই খাতে বরাদ্দ ছিল ৬১ কোটি টাকা, খরচ হয়েছে ২ লক্ষ টাকা। বিড়ি শ্রমিকদের বাড়ি নির্মাণের জন্য বাজেট বরাদ্দ ছিল ৪৩ কোটি টাকা, তার মধ্যে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।

পেশাগত রোগ বিশেষজ্ঞ কুণাল দত্ত জানান, বিড়ি শ্রমিক মহিলাদের এক ভঙ্গিতে দীর্ঘক্ষণ বসে কাজ করতে হয়। ফলে কোমরে ও পায়ের যন্ত্রণা হয়। ত্রিশ-ঊর্ধ্ব মহিলাদের হাড় ক্ষয়ে যাওয়ার অসুখ শুরু হয়। সেই অস্থিক্ষয় একটানা বসা ও বার বার একই ভঙ্গিমার জন্য আরও বাড়ে। এ ছাড়া বিড়ি বাঁধার কাজে ছেদ যাতে না পড়ে, সেই জন্যে জল কম খাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। এর ফলে প্রস্রাবে সংক্রমণ এবং ঋতুস্রাবের নানান সমস্যা হয়। পুরুষ বিড়ি শ্রমিকদের মধ্যে যাঁরা বিড়ি ‘টোস্ট’ বা তন্দুর করেন, তাঁদের শ্বাসের সঙ্গে ধুলো ও নানান গ্যাস (কার্বন মনোক্সাইড) ফুসফুসে যায়। ফলে ফুসফুসের অসুখ, শ্বাসকষ্ট ও টান (সিওপিডি) হয়ে থাকে। কাঁচা তামাক নিয়ে কাজ-করা শ্রমিকদের উপর এক সমীক্ষায় একটি অসরকারি ক্যানসার চিকিৎসা সংস্থার বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, শ্রমিকদের শরীরের বিভিন্ন কোষের ভিতরে জিনঘটিত পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে, যা ক্যানসারের পূর্বসূরি মনে করা হয়।

এই পেশা এত বিপজ্জনক, তবু লক্ষ লক্ষ মানুষ এই কাজ করছেন। বহু গ্রামে দেখা যায়, রোজগারে সমর্থ পুরুষেরা পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে অন্যত্র চলে গিয়েছেন। যাঁরা রয়ে গিয়েছেন, বিশেষত পরিবারের মেয়েরা নিযুক্ত বিড়ি বাঁধার কাজে। তাঁরা অনেকে মুখে মুখে ছড়া কাটেন— “হাতে আছে বিড়ির পাত, খাব না ভাতারের ভাত।” স্বনির্ভরতার স্বপ্ন মেয়েদের বন্দি করছে স্বল্প মজুরির নিরাপত্তাহীন শ্রমে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy