প্রত্যাবর্তন: নিজের বই হাতে সলমন রুশদি। জার্মানি, মে ২০২৪। ছবি: রয়টার্স।
সেই গানটা মনে আছে, কিশোরকুমারের? ‘সেই রাতে রাত ছিল পূর্ণিমা’! ১১ অগস্ট, ২০২২-ও ছিল সে রকম পূর্ণিমা। নিউ ইয়র্কের শাতাকুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে হ্রদ ভেসে যাচ্ছে জ্যোৎস্নায়। ডিনারের পর রাতে গেস্ট হাউসের সামনের বাগানে পায়চারি করতে করতে সে দিকেই তাকিয়ে ছিলেন লেখক। বিজয়নগর, হাম্পি, পম্পা কাম্পানাদের নিয়ে তাঁর উপন্যাস প্রকাশকের কাছে, অচিরেই চলে আসবে ফাইনাল প্রুফ। আমরা, রুশদি-পাঠকেরা জানি, সেই উপন্যাসেও চাঁদ ছিল। জাদুকরী কবি পম্পা কাম্পানার হাতে ছড়ানো বীজ থেকেই বিসঙ্গ সাম্রাজ্য জন্ম নেবে, হুক্ক এবং বুক্ক নামের পশুপালক দুই ভাই চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলবে, তারা চন্দ্রবংশীয় রাজকুমার। অনুভূতির কি কোনও রহস্যময় পূর্বজ্ঞান বা ‘প্রিমোনিশন’ থাকে?
সলমন রুশদির নাইফ সেই পূর্বজ্ঞানের নতুন অভিজ্ঞান। শাতাকুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেওয়ার দিন দুয়েক আগে দুঃস্বপ্ন দেখছেন, রোমান অ্যাম্ফিথিয়েটারে এক মল্লযোদ্ধা তাঁকে পেড়ে ফেলেছে, তিনি হাঁসফাঁস করছেন। যেতে মন চাইছে না, তবু বক্তৃতাটা দিলে একটি চেক পাওয়া যাবে। বাড়ির লজ্ঝড়ে এসি বদলাতে সেই চেকের অর্থমূল্যটি কাজে দেবে। এসি বদলানো বাস্তব, তার সঙ্গে মিশে গেল দুঃস্বপ্নকল্পদ্রুম। এখানেই ভারতীয় লেখকের জাদুবাস্তবতা। নতুন বইতেও তিনি বুঝিয়ে দিলেন, বাস্তব পৃথিবীর সঙ্গেই লেগে থাকে স্বপ্ন, পূর্বজ্ঞান, পরাবাস্তবতার অভিজ্ঞান। সে দিনের হামলাবাজ, হাদি মাটারের নাম বইতে এক বারও নেননি রুশদি। বরং সারা বইতে তাকে ‘এ’ নামে উল্লেখ করে গিয়েছেন। ‘এ’ মানে গাধা বা অ্যাস, খুনে বা অ্যাসাসিন যা কিছু হতে পারে। জেলখানায় বন্দি এই চরিত্রটির সঙ্গে সাতাত্তর বছর বয়সি রুশদির আর দেখা হয়নি। লেখক জেলে গিয়ে তার কাল্পনিক সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। বাস্তব তথ্যের মতোই ‘এ’ রুশদির কোনও বই পড়েনি, ইউটিউবে তাঁর দু’-একটি সাক্ষাৎকার দেখেছে মাত্র। নাইফ দেখাল, ইউটিউব, অ্যামাজ়ন, টুইটার ও সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে স্বাধীন চেতনা ও ধর্মহীনতা মানে স্বপ্নকে বাদ দেওয়া নয়। কবিতাকে ছেঁটে ফেলা নয়।
চন্দ্রাহত এবং কবিতাপ্রেমী রুশদিই নাইফ-এর উপজীব্য। ২০১২ সালে বেরোনো রুশদির স্মৃতিকথা জোসেফ আন্তন-এ চমৎকার একটি ঘটনা আছে। স্যাটানিক ভার্সেস ও খোমেইনির ফতোয়াযুগে ওই ছদ্মনামেই তিনি বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপন করতেন। একটি বাড়ি কিনবেন, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দেহরক্ষী জানাল, পিছনের গেট ও পাঁচিল বদলাতে হবে। তখনই আপনি পূর্ণ নিরাপদ। রুশদি তার দিকে কিছু ক্ষণ তাকিয়ে বললেন, “স্যাটানিক ভার্সেস কবিতার বই হলে এত আবদার করতে পারতেন?” তাঁর প্রাক্তন স্ত্রী পদ্মলক্ষ্মী লাভ, লস অ্যান্ড হোয়াট উই এট নামে যে স্মৃতিকথা লিখেছিলেন, সেখানেও কবিতা নিয়ে রুশদি প্রচুর ঠাট্টা করেছেন, “আরে, কবিরা তো পাতার শেষ অবধিই পৌঁছায় না।” একত্রিশ বছরের ছোট আমেরিকান কবি রাচেল এলিজ়া গ্রিফিথস-এর সঙ্গে পঞ্চম বারের বিয়ে তাঁকে এ ভাবেই বদলে দিল? রুশদি এখন পাতায় পাতায় জানিয়ে দেন, তিনি রাচেলের কবিতার বই পড়েন, চমৎকার লাগে। নাইফ স্রেফ ছুরিকাহত হয়ে দৃষ্টি হারানোর গল্প নয়, একটা পরিবারে সকলের সকলকে জড়িয়ে বাঁচার গল্প।
খোমেইনির রাহুগ্রাস ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার পর প্রথম পুত্র জাফরকে একটি বই উৎসর্গ করেছিলেন রুশদি। হারুন অ্যান্ড দ্য সি অব স্টোরিজ়। আলিফবে দেশের লোকেরা এত দুঃখী যে দেশটার নাম ভুলে গিয়েছে। সেখানেই স্ত্রী ও ছেলে হারুনকে নিয়ে বাস করে গল্প-বলা রশিদ। আর আছে খতম শুদ। সে নীরবতার সম্রাট, গল্প, ভাষা, স্বাধীন চেতনা সব কিছুর শত্রু। তাই রশিদকে সে সহ্য করতে পারে না। হারুনকে নিয়ে রশিদ তাই পথে বেরিয়ে পড়ে। গুপী আর বাঘা নামে দু’টি মাছ তাদের পথ দেখায়।
সেই বইটা যদি ছিল জাফরের, এই বইটা তা হলে রুশদি ও তাঁর তৃতীয় স্ত্রী এলিজ়াবেথ ওয়েস্টের সন্তান মিলনের। জাফর এখন চুয়াল্লিশ বছরের মধ্যবয়সি। বাবার ছুরিকাহত হওয়ার খবরে লন্ডনের বাড়িতে সে সারা রাত কাঁদে। ঘটনার কয়েক দিন পরে রুশদির লন্ডনে আসার কথা ছিল, জাফর ও তাঁর স্ত্রী তাঁদের শিশুকন্যাকে ‘এই তো দাদু আসবেন, তোমাকে সাঁতারের ক্লাসে নিয়ে যাবেন’ বলেছেন। সে বোধ হয় এই যাত্রায় আর হবে না।
অন্য দিকে এলিজ়াবেথ ওয়েস্টের সঙ্গে রুশদির তৃতীয় বিয়ের সন্তান মিলনের জন্ম ১৯৯০ সালে। এলিজ়াবেথের সঙ্গে রোজ হাসপাতালে বাবাকে দেখতে যায় সে। শোকার্ত বিস্ময়ে বাবাকে বলে, “এক বার ছুরি খেলে অনেকে বাঁচে না। আর তুমি পনেরো বার!” লেখক বাবা বললেন, “হ্যাঁ, নেকড়ে মানুষের গল্প পড়িসনি? সব আক্রমণ সামলে নেয়।” পুত্রের পাল্টা রসিকতা, “তা হলে নেকড়ে মানুষের নখগুলি আর বার কোরো না, প্লিজ়।” আজেবাজে বিষয়ে বাঙালি সোশ্যাল মিডিয়ায় জঞ্জাল ছড়ায়। নাইফ পড়লে বুঝত, ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ শুধু বাঙালি কবির উচ্চারণ নয়। তার অনুরণন দুনিয়াব্যাপী।
কবিতা এবং জাদুবাস্তবতা-মাখা পূর্বজ্ঞান? রুশদি লিখছেন, ২৭ সেকেন্ড ধরে আততায়ী তাঁর চোখে, ঘাড়ে, বুকে ছুরির আঘাত চালিয়ে গিয়েছে। আর শেক্সপিয়রের ১৩০ নম্বর সনেট পড়তে ২৭ সেকেন্ডই লাগে। এ সব জেনে ফের সনেটটা পড়া গেল। ১৬০৯ সালে প্রকাশিত সেই সনেটের প্রথম পঙ্ক্তিতেই তো চোখ। “মাই মিস্ট্রেস’স আইজ় আর নাথিং লাইক দ্য সান/কোরাল ইজ় ফার মোর রেড দ্যান হার লিপস’ রেড।” এই যে সূর্যের মতো চোখ নয়, প্রবালের মতো রক্তিম অধর নয়, তবু কবি চতুর্দশপদীর শেষে জানান— ঈশ্বরীকে কখনও হেঁটে যেতে দেখিনি, কিন্তু আমার প্রেয়সী মাটিতে হেঁটে গেলেও স্বর্গের দিব্যি, আমার প্রেম দুর্লভ। ছুরিকাহত হওয়ার পর কখনও শেক্সপিয়রের কবিতা, কখনও সালভাদর দালির চিত্রনাট্যে বুনুয়েলের দি আন্দালুসিয়ান ডগ ছবিতে ছুরিতে চোখ কাটার দৃশ্য, কখনও বা পোলানস্কির নাইফ ইন দ্য ওয়াটার ছবির কথা মনে পড়া... এখানেই সৃজনশীলতার স্বচ্ছন্দ চারণভূমি। একটি দুর্ঘটনার সাংবাদিকী বর্ণনা নয়, বরং তাকে কেন্দ্র করে হরেক অনুষঙ্গ আনাতেই মধ্যরাতের এই সন্তানের সিদ্ধি। সাতাত্তর বছর বয়সেও শরীরী আঘাতে তিনি পর্যুদস্ত হন না, বরং পঠনের হরেক অভিজ্ঞতায় ভেসে যান।
হাসপাতালে টানা ছয় মাস কাটিয়ে অবশেষে ঘরে ফেরা। নষ্ট চোখে প্রথমেই কী দেখতে পেলেন তিনি? এ-বি-সি দিয়ে তৈরি বর্ণমালার প্রাসাদ। প্রথমে তাঁর বাঁচা নিয়ে ডাক্তারেরাই নিশ্চিত ছিলেন না। পিপীলিকাভুক আর্মাডিলোর লেজ শরীরে ঢুকে এল। নল-ভর্তি শরীরে ভেন্টিলেটরকে ও রকমই লাগছিল তাঁর। এক দিন সেই লেজ থেকে নেমে এলেন; কাঁধে, পাঁজরে তখনও স্টেপল করা। একের পর এক বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের আনাগোনা। লেখক মনে মনে এই বিশেষজ্ঞদের কারও নাম দিয়েছেন ডাক্তার চোখ, কারও বা ডাক্তার হৃৎপিণ্ড, কেউ বা ডাক্তার মস্তিষ্ক। কখনও ওষুধের মাত্রা ভুল, প্রস্রাবের বেগ আটকে গিয়েছে। নিজেই ওষুধ বন্ধ করলেন, পরদিন ডাক্তার এসে বললেন, “ঠিক করেছেন। ওটায় সাইড এফেক্ট হয়, ওষুধটা আর খাবেন না।” এই দুনিয়ায় ওষুধপত্রও বিশ্বস্ত নয়। বাড়ি ফেরার পর প্রথম দিকে হাত মুঠো করতে পারেন না, তবু চলে যন্ত্রণাদায়ক ফিজ়িয়োথেরাপি। আহত বাঁ হাতে বুড়ো আঙুলের সঙ্গে কড়ে আঙুলটা ছোঁয়াতে হবে। ‘ডাক্তার চোখ’ পাথরের চোখ বসানোর পরামর্শ দিলেন। কিন্তু রুশদি নারাজ। ওই মরা চোখ তিনি ঢেকে রাখবেন, ওটি থাকুক।
ফিজ়িয়োথেরাপি শেষে একটু স্বাভাবিক হতে বাড়ির বাইরে প্রথম কোথায় গেলেন রুশদি? তাঁর ক্যানসার আক্রান্ত লেখক বন্ধু মার্টিন অ্যামিসের বাড়িতে। মার্টিন ক্যানসারে ভুগছিলেন, এই দেখাশোনা-আড্ডার কয়েক দিন পরেই তাঁর মৃত্যু। পড়তে পড়তে প্রয়াত বাঙালি কবি অরুণকুমার সরকারের কথা মনে পড়ে, “পুরনো বন্ধুরা আজ স্মৃতির গম্বুজ হয়ে আছে।” এই মুক্ত অনুষঙ্গই তো ‘বুকার অব বুকারস’ প্রাপক ভারতীয় বংশোদ্ভূত লেখকের কাম্য। রুশদি কেন তাঁর আততায়ীর কাল্পনিক সাক্ষাৎকার নেন? ‘ক্ষমা’ শব্দটা এক বারও এই বইতে নেই। রুশদি তো আর মহাত্মা গান্ধী বা মার্টিন লুথার কিং নন। তিনি জানান, ‘এ’র অস্ত্র যদি ছুরি, তা হলে তাঁর অস্ত্র ভাষা। সেটি দিয়েই তিনি ব্যক্তির স্বাধীনতা ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার পক্ষে দাঁড়াবেন। ছুরি কাণ্ডের পর দেখলেন, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন থেকে তামাম দুনিয়ার উৎকণ্ঠিত বার্তা। শুধু ভারত ও পাকিস্তানের তরফে অখণ্ড নীরবতা।
লেখক লিখেছেন, প্রচারের নিরুত্তাপ আলোকবৃত্ত থেকে দূরেই থাকতে চান এখন। এটাও তাঁর স্বাধীনতা। তিনি ক’বার ছুরি খেলেন, কেন বাঁ হাতে আততায়ীকে আটকাতে গেলেন তা নিয়ে মিডিয়ায় অজস্র আলোচনা। ‘ছুরি খাওয়ার সময় এই রকমই হয়ে থাকে’ গোছের সাংবাদিকতা থেকে এ বার লেখক, তাঁর সাহিত্য এবং চিন্তার মুক্ত পরিসরকেও বাঁচানোর দিন এসে গিয়েছে। সেখানেই এই ছুরির আসল ধার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy