প্রত্যাহার: আমেরিকান সেনাবাহিনী ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, কাবুল, ৮ জুলাই। রয়টার্স ।
হিন্দুকুশ পর্বতগাত্রের লিখন অস্পষ্ট নেই আর। আফগানিস্তান সম্পূর্ণ ভাবে দখল আপাতত করতে না পারলেও, আবার সন্ত্রাসের শব্দ তুলে ফিরে আসছে তালিবান। সে দেশ থেকে আমেরিকার সেনা প্রত্যাবর্তন আগে ঘটবে, না কি সেখানকার ভারতীয়রা আগে পালিয়ে বাঁচবেন স্বদেশে— প্রশ্নটা এখন প্রায় এই পর্যায়ে! কন্দহরের বিস্ফোরণের আওয়াজে থরহরি রাজধানী দিল্লির সাউথ ব্লক।
অথচ, ‘এমন ছিল না আষাঢ়শেষের বেলা’। অন্তত কিছু দিন আগেও সগর্বে বিদেশ মন্ত্রক জানিয়েছিল, আফগানিস্তানে শান্তি ফিরিয়ে আনতে ‘সব পক্ষ’-এর সঙ্গে কথা বলছে নয়াদিল্লি। গত মাসের মাঝামাঝি চাউর হয়ে যায়, এত দিনের আফগান নীতিতে বড় বদল এনে তালিবানদের সঙ্গে সরাসরি সংলাপের দরজা খোলা হয়েছে। এমনটাও রাজধানীর অলিন্দের গুঞ্জন, এ কাজে পুরোভাগে রয়েছেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল। প্রজাপতির মতো নির্ভার লাগছিল সে সময় কাবুল নিয়ে দৌত্য চালানো কূটনীতিকদের।
কিন্তু তালিবানদের মাত্রাছাড়া সন্ত্রাসের সামনে দাঁড়িয়ে এখন কোণঠাসা দেখাচ্ছে মোদী সরকারকে। দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার রণনীতি ও কূটনীতিতেও যেন একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভারত। অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর তালিবানদের সঙ্গে দরজা খোলা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ঘটনার প্রবল ঝড়ে তা বন্ধ হওয়ার উপক্রম। অথচ, পাকিস্তান, ইরান এবং রাশিয়ার মতো দেশের সঙ্গে তালিবান সম্পর্কের যে গভীর সুড়ঙ্গ, তা হঠাৎ সরগরম হয়ে উঠছে যেন।
পরিস্থিতি শাঁখের করাতের মতো। যে হেতু ভারত-তালিবান সংলাপ সূচনার বিষয়টি আর গোপন নেই, আফগান রাষ্ট্রদূত আবদারের সুরে বলছেন, ভারত কেন তালিবানদের বুঝিয়েসুঝিয়ে মূলস্রোতে আনছে না? অথচ তিনিও জানেন, আফগান সরকারও জানে, সবচেয়ে বড় কথা সাউথ ব্লকও জানে, বিষয়টা ছেলেখেলা নয়। তালিবানরা পকেটে মেওয়া-বাদাম নিয়ে ‘কাবুলিওয়ালা’র মতো সাউথ ব্লককে রাতারাতি ‘খোঁখীঁ’-জ্ঞান করবে, এমন মোটেও নয়। তবুও আফগানিস্তান সরকারের হাল এখন জলে ডুবে যাওয়ার আগে, খড়কুটো প্রত্যাশীর মতো। তারা চাপ বাড়াতে ছাড়ছে না।
দিনের আলোর মতো স্পষ্ট যে, তালিবানদের সঙ্গে ফের পাকিস্তানের মদতপ্রাপ্ত হক্কানি এবং অন্যান্য সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে। সন্ত্রাসের যে উগ্রতা দেখা যাচ্ছে, তা রাওয়ালপিন্ডির সমর্থন ছাড়া ঘটার কথা নয়। ভারত যখনই আফগানিস্তানে নিজেদের কনস্যুলেট বাড়িয়েছে, পরিকাঠামোয় বিনিয়োগ করেছে, শান্তি প্রক্রিয়ায় শামিল হওয়ার চেষ্টা করেছে, কর্কশ হয়েছে ইসলামাবাদের কণ্ঠ। এখন গত দেড় মাসে আফগানিস্তান থেকে ভারতের পায়ের ছাপ ক্রমশ কমছে, যা পাকিস্তানের সরাসরি উল্লাসের কারণ। হেরাট, কন্দহর এবং জালালাবাদের ভারতীয় কনস্যুলেট কার্যত কূটনীতিকহীন। কবে আবার এই কনস্যুলেটগুলি খোলা যেতে পারে তার কোনও নিশ্চয়তাই নেই। এমনটাই তো চেয়েছিল পাকিস্তান।
ভারত সরাসরি তালিবানদের সঙ্গে টেবিলে বসে কথা বলে যাবে, এমন ঘটনা চোখের সামনে দেখে চোখ বুজে থাকার কথাও নয় পাকিস্তানের। বেশির ভাগ তালিবান নেতার পরিবার থাকে পাকিস্তানে। ইসলামাবাদ বরাবরই তালিবানের সঙ্গে দর-কষাকষির প্রশ্নে এই বিষয়টিকে কাজে লাগায়। তালিবানের সঙ্গে যে এখনও লস্কর-ই-তইবা, আল কায়দার মতো জঙ্গি গোষ্ঠীর যোগাযোগ রয়েছে, সেটাও প্রমাণিত। সব মিলিয়ে পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা কতটা বাস্তবসম্মত তালিবানদের পক্ষে?
আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারে ব্যস্ত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও তাঁর প্রশাসন বিষয়টি নিয়ে এখন নাক গলাতে চান না। ভারতের আঞ্চলিক নিরাপত্তা অথবা তালিবানদের কারণে কাশ্মীরে আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাস বৃদ্ধি নিয়ে তাঁদের মাথাব্যথা নেই। শুধু আমেরিকা নয়। সম্প্রতি ভারতের সুপ্রাচীন মিত্র রাশিয়ার সঙ্গেও তালিবান-প্রশ্নে মতবিরোধ ঘটেছে মোদী সরকারের। ইরান বা ব্রিটেনের সঙ্গেও। তালিবান রাশিয়াকে আশ্বাস দিয়েছে, তারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারে, সন্ত্রাস আফগানিস্তানের বাইরে গড়াবে না। ফলে, তালিবানি সন্ত্রাস নিয়ে মাথা গলাতে চায় না মস্কো। অনুরূপ আশ্বাস নাকি পেয়েছে ভারতের আদি অকৃত্রিম শক্তি-সহচর ইরানও।
এমনটা ভারতের হিসেবে ছিল না। কিছুটা স্তম্ভিত ভারতীয় বিদেশমন্ত্রী রাশিয়ার বিদেশমন্ত্রীকে বলেন, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে না গিয়ে, হিংসার মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকে ‘বৈধতা’ দেওয়া যায় না। ভারতের এই ‘বৈধতা’ তত্ত্বকে রাশিয়া হয়তো তত গুরুত্ব দিচ্ছে না। আফগানিস্তান-প্রশ্নে পাকিস্তানকেই তারা গুরুত্ব দিচ্ছে বেশি, ভারতের তুলনায়।
গোদের উপর বিষফোড়ার মতো সম্প্রতি ব্রিটেনের পক্ষ থেকেও ভারতকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, তালিবানরা যদি ক্ষমতায় আসে তবে তাদের স্বীকৃতি দিতে কোনও সমস্যা নেই। আফ-পাক নীতির ক্ষেত্রেও ব্রিটেনের সমর্থন রয়েছে পুরোপুরি ইসলামাবাদের দিকে, এমন আশঙ্কা ছড়াচ্ছে সাউথ ব্লকে। ঘটনা হল, ব্রিটেন বরাবর মনে করে এসেছে, পাকিস্তান আফ-পাক অঞ্চলের নিরাপত্তা বহাল রাখতে সবচেয়ে কার্যকর তাদের ভূকৌশলগত অবস্থানের জন্য। পাকিস্তানের সঙ্গে ব্রিটিশ সেনা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চলে, আফগানিস্তানের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে তা আরও বেড়েছে।
এখন উপায় কী? হিন্দুকুশ পর্বতমালার মাথায় কি রুপোলি রেখা একেবারেই নেই?
হাল ছেড়ে দেওয়ার অর্থ সে দেশের রাজনৈতিক পরিসরে কট্টরপন্থী পাক মদতপ্রাপ্ত তালিবানদের প্রভাব বাড়া। কাশ্মীর এবং ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত আরও বিপদগ্রস্ত হয়ে ওঠা। তাই, সামান্য যেটুকু পরিসর রয়েছে সামনে এগোনোর, তাকেই আঁকড়ে ধরা ছাড়া গত্যন্তর নেই। তালিবান শক্তি নিষ্ঠুর, নির্মম, নারীবিদ্বেষী, বিশ্বাসঘাতক, মধ্যযুগীয়—এই সবই ঠিক। হয়তো এর সঙ্গে আরও বেশ কিছু বিশেষণ জুড়ে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু তারা আর যা-ই হোক, আত্মহত্যাকামী বা নির্বোধ নয়। তা হলে আমেরিকার সঙ্গে দু’দশক লড়াই চালিয়ে যেতে পারত না। অতীতের মুজাহিদিনদের মতো এখন কোনও বৃহৎ শক্তি তাদের অস্ত্র জোগান দিয়ে সহায়তাও করছে না। তাদের ভরসা শুধুই পাকিস্তান, যে দেশ নিজেই ভিতর থেকে দীর্ণ।
যে কোনও সমাজ বা রাষ্ট্রই শেষ পর্যন্ত নিজেদের স্বার্থে কাজ করে। ফলে, অদূর ভবিষ্যতে ভারতের বিরুদ্ধে লড়াই করে তালিবানদের লাভ কী? পাকিস্তানের হক্কানিদের কথায়, আফগানিস্তানের ভিতর ভারতীয়দের উপর চাপ বহাল রাখছে তালিবান— সেটা একটা ভিন্ন বিষয়। আর কাশ্মীর নিয়ে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধং দেহি হওয়া— সম্পূর্ণ অন্য। বিশেষত, ভারতের বিপুল বিনিয়োগে অনেক প্রকল্প ইতিমধ্যেই চলছে সে দেশে, যার থেকে পরবর্তী কালে লাভ পাওয়ার কথা তালিবানদেরও। পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্রের উপর অতিনির্ভরতা, প্রশাসনিক এবং আর্থিক ক্ষেত্রে আফগানিস্তানকে যে কোথাও পৌঁছে দেবে না, সেটা তালিবানরাও জানে। তাদের জীবনযাপন, ইসলামের ব্যাখ্যা, নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক স্বাধীনতা— এর কোনওটাই আধুনিক সমাজের সঙ্গে মেলে না। কিন্তু সেই কারণগুলিই কি যথেষ্ট ভারতকে শত্রুজ্ঞান করার? মনে হয় না। পাকিস্তানের যুদ্ধ তারা লড়তে যাবে কেন? ভারতকে ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত করার দিবাস্বপ্ন তারা দেখে না। ভারতীয় মুসলিমদের মৌলবাদে দীক্ষিত করার ক্ষমতাও তাদের নেই।
তাই পরিস্থিতির উপর নজর রেখে, তালিবান এবং আফগানিস্তান সরকার, উভয়ের সঙ্গেই আলোচনার দরজা খোলা রাখার যে কাবুল-নীতি নেওয়া হয়েছিল, তাকেই এগিয়ে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন নয়াদিল্লির। নয়তো, দু’মাস পর, আমেরিকা ও ন্যাটোর সেনা আফগানিস্তানের মাটি থেকে ফিরে গেলে যে শূন্যতা সৃষ্টি হবে, নয়াদিল্লির বুটের ছাপ চিরতরে সেখান থেকে মুছে যেতে পারে। রাশিয়া বা আমেরিকার ভরসায় না থেকে এ ক্ষেত্রে যা করার করতে হবে ভারতকেই। কারণ, যত ক্ষণ না নিজেদের গায়ে আঁচ পড়ছে, অন্য দেশের জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে, কারও কিছু যায় আসে না। তা সে যত বড় বন্ধু রাষ্ট্রই হোক না কেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy