দিনে আধ ঘণ্টার জন্য খোলা হয় জানলাটা। লোকালয়ের শেষ প্রান্তে বাড়ি, জানলার বাইরে অন্ধকার। সে দিকে তাকিয়ে এক জন বলল, “এই যে বাইরের অন্ধকার দেখছ, আমাদের মন, মাথায় এর চেয়েও বেশি অন্ধকার। বার বার ভেবেছি, এ বারই শেষ। আর নয়। বাড়ি গিয়ে ঠিক সুস্থ জীবন শুরু করব। মেয়েটাকে বড় করব। পড়াব। কিন্তু, কিছুতেই আর পারি না। এই অন্ধকার আবার টেনে নেয়।” কয়েক বছর আগে যে এই কথা বলেছিল, সে ছিল মাদকাসক্ত। নেশা, রিহ্যাব, ফিরে নেশা, আবার রিহ্যাব— এই ছিল জীবন। বছরখানেক আগে মারা যায়।
“অত নেশা করলে তো মরবেই!” বাক্যটিতে উদাসীনতা মিশে আছে। তাচ্ছিল্যও। এই সব ভেদ করে তাকালে দেখতে পাব একটি সত্য, “এই আসক্তি আসলে একটা রোগ।” এমন এক রোগ, যা নির্মূল হয় না কখনও। যা এক বার ধরলে নিজেকে রক্ষা করে যেতে হবে আজীবন। তার প্রকোপ থেকে এক দিন-এক দিন করে বাঁচিয়ে রাখতে হবে নিজেকে। যার পোশাকি নাম ‘রিকভারি’।
রিকভারি, অর্থাৎ যা আমি হারিয়েছিলাম, সেটাকেই আবার ফিরিয়ে আনা। আমার ‘আমি’-কে ফিরিয়ে এনে ঠিকঠাক ‘মানুষ’ হয়ে ওঠা— যার নিজের উপর ন্যূনতম নিয়ন্ত্রণ আছে, যে সচেতন। যারা নেশার রোগে আক্রান্ত, নিয়ন্ত্রণহীনতার বোধ তাদের বার বার নেশার দিকে টেনে নিয়ে যায়, অপরাধমূলক কাজ করিয়ে নেয়। রিকভারি এমন এক পথ, যার নির্দিষ্ট অন্তিম বিন্দু নেই। আমৃত্যু সংযুক্ত থাকতে হয় যে প্রবাহের সঙ্গে! যে জীবনকে পূর্ণমাত্রায় দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না, কোনও ভাবে অনুভব করা যাচ্ছে না, জানতে পারা যাচ্ছে না, তাকে পাল্টে দেওয়ার সাধনাই রিকভারি।
কোন জীবন? যে জীবন বুঝতেই পারেনি কখনও যে, তার একটা রোগ আছে! তবে, কাছের মানুষরা বিলক্ষণ বুঝেছে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ‘আমার কিছু হয় না’ বলে শুরু করলেও একটা সময় পর তার আচরণে চোখে লাগার মতো পরিবর্তন হয়। সে শুরু করতে পারে, শেষ করতে পারে না। তার আগেই সম্পূর্ণ নেশাগ্রস্ত হয়ে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য অবস্থায় পৌঁছে যায়। এমনটা বার বার ঘটে, ঘটেই চলে। এই চক্রটা তৈরি হচ্ছে সেই রোগের জন্য, যা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে বার বার বোঝাচ্ছে যে, তার কোনও সমস্যা হতেই পারে না। এ ভাবেই সে এক দিন মরে যাচ্ছে। নির্মম মৃত্যু। নিয়ন্ত্রণহীন জীবনের নেপথ্যে ফণা তুলে রইল যে মূল নেশার রোগ, তা নিয়ে আর কথাই হল না!
কথা হলে বলা যেত যে, এই রোগ আর পাঁচটা রোগের মতো নয়। তাই এর চিকিৎসাও বাকি রোগের মতো নয়। এখানে ওষুধের মাধ্যমে শুধু ডিটক্সিফিকেশন হতে পারে, কিন্তু চিরতরে সুস্থ হয়ে ওঠা যায় না। কারণ, রোগটা শুধু দেহের না, মনেরও। সিনেমায় দেখানো হয় আত্মবিশ্বাসে ভর করে এক বেলার মধ্যে নিজে নিজেই নেশা ছেড়ে দিল নায়ক! যার আত্মের কেন্দ্রটিই ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন ও অন্ধকারময়, যে মানুষ আত্মহীন, সে আত্ম-বিশ্বাস পাবে কোথা থেকে? এটা এক সুদীর্ঘ প্রক্রিয়া। দুপুরে ঠিক করে বিকেলে ছেড়ে দেওয়ার মতো সহজ নয়। ঠিকঠাক সচেতনতা না থাকার ফলেই, বছরের পর বছর ধরে নিয়ন্ত্রণহীন নেশার কারণে কারও মৃত্যু হলে, এ প্রশ্ন সেই কারণেই মাথায় আসে না যে, মানুষটি এত বছর ধরে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছিল কেন?
রোগটার প্রথম বলিই হল নিজেকে নিয়ন্ত্রণের এই বোধ। এই রোগ তার শিকারের থেকে কেড়ে নেয় সব নিয়ন্ত্রণ; যত বার ও যত বেশি করে তা কেড়ে নেওয়া হতে থাকবে, তত বার আক্রান্তের ভিতর ভিতর পইপই করে বুঝিয়ে দেওয়া হবে: দুনিয়ার সব কিছুর উপর তোমার নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ বেড়ে চলেছে। এই করতে করতে খেয়ালই থাকে না, ক্রমে সকলের কাছে পরিত্যক্ত হয়ে যাচ্ছে সে, যন্ত্রণার বোধ হারিয়ে ফেলছে। কোনও ভাবনা বা চিন্তার বলয় থাকছে না। জীবনের স্বাভাবিক অনুভূতিগুলো থেকেও সে এতটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে যে, মেয়েকে মারণরোগে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েই ছুটতে হচ্ছে নিজের নেশার দ্রব্যের খোঁজে। কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলবে, এই অবস্থায় মাথা ঠিক রাখার জন্য ওটা দরকার। আসলে তো তা নয়, সে নেশার দ্রব্য খুঁজছে নেশা করার জন্যই। শুধু এই সত্যটা সে কাউকে বোঝাতে চাইছে না। আরও বিপজ্জনক ও নিষ্ঠুর কথা, এই সত্য সে নিজেকেও বোঝাতে পারেনি।
আক্রান্ত নিজে ও তাঁর পরিজন রোগটিকে চিহ্নিত করতে পারেন না বলে কত লোক বিনা চিকিৎসায় হারিয়ে যায় জীবন থেকে। যদিও, চিকিৎসা হলেই যে সুস্থতার নিশ্চয়তা আছে তা নয়। বার বার চিকিৎসা সত্ত্বেও রোগীরা ফের এই আসক্তির কবলে পড়ে। তখন আবার চিকিৎসা। তবু চেষ্টা চলতে থাকে। কিছু মানুষ আছেন যাঁরা নিজেরা এক সময় এ ভাবেই চিকিৎসা নিয়ে ভাল হয়ে উঠেছেন, তাঁরা এই রোগীদের অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরানোর প্রাণপণ চেষ্টা করে যান।
সেই চিকিৎসা নিতে এসেই বিদেশি গিটারিস্টের ভক্ত কেউ বাইরে বেরিয়ে একটা দারুণ শো করার চিন্তা করে। কেউ বা দেড় বছর ধরে না-দেখতে পাওয়া প্রেমিকার সঙ্গে দেখা হলে তাকে নিয়ে কোথায় ঘুরতে যাবে তা বলে চলে জানলার বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে। যে অন্ধকারের দিকে তাকানো আসলে নিজের দিকে ফেরা। তার মধ্যেই লুকিয়ে আছে প্রথম লড়াইয়ের আলোর বীজ। যে লড়াইয়ে হেরে গেলে আবার রিল্যাপস, ফের মৃত্যুর দোরগোড়া ছুঁয়ে আসা...
কিন্তু, কত বার মরবে জীবনে! ফিরে তো আসতে হবেই! চঞ্চল ঘূর্ণির মধ্যে পড়েও তাই কেউ কেউ সেই আলোর সন্ধান পেয়ে যায় শেষে। খুঁজে পায় কবে কোন জ্যোৎস্নায় বনবাদাড়ে হারিয়ে যাওয়া নিজেকে। সেখান থেকেই সূচনা হয় আরও এক বার বুক বেঁধে বাঁচার। সূচনা হয় স্বাধীনতার!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy