Advertisement
১৪ ডিসেম্বর ২০২৪
Samaresh Basu

লোকবৃত্তের দরদি স্বজন

ব্ল‍্যাকবোর্ডের চেয়ে বাইরের সাতরঙা জগৎ টানত বেশি। উড়ো মনের ছেলেটির মতি ফেরাতে ভাবনাচিন্তা শুরু হল। দাদা তাঁর কর্মস্থল নৈহাটি নিয়ে যেতে চাইলেন, নিজের তত্ত্বাবধানে পড়াশোনা করাবেন।

রামকুমার মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৭:৫৮
Share: Save:

সমরেশ বসুর জন্ম একশো বছর আগে বিক্রমপুরের রাজনগর গ্রামে। ছোটবেলা ভালই কাটছিল সেখানে। গলায় গান ছিল, বাঁশিতে সুর আর হাতে ছবি। বন্ধু জুটেছিল বেশ ক’জন, ভাল লাগত জয়নাল মনসুর ইসমাইল রাজলক্ষ্মীর সঙ্গ। গ্রাম ও আশপাশের পথঘাট, বাগান, ফসলের জমি, বাঁশবন— মুক্ত পরিবেশ। স্কুলেও ব্ল‍্যাকবোর্ডের চেয়ে বাইরের সাতরঙা জগৎ টানত বেশি। উড়ো মনের ছেলেটির মতি ফেরাতে ভাবনাচিন্তা শুরু হল। দাদা তাঁর কর্মস্থল নৈহাটি নিয়ে যেতে চাইলেন, নিজের তত্ত্বাবধানে পড়াশোনা করাবেন।

১৯৩৮ সালে বছর চোদ্দোর সমরেশ নৈহাটি এলেন। এর ঠিক একশো বছর আগে এখানেই জন্ম এ দেশের প্রথম স্নাতক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। জ্ঞানচর্চার প্রাচীন কেন্দ্র ভট্টাচার্য-পল্লিও এমন কিছু দূরে নয়। বিদ্যার্জনের আদর্শ পরিবেশ। পড়াশোনা শেষে অঞ্চলের নানা কলকারখানার একটায় কাজ জুটে যাবে, আর ভাল ফল করতে পারলে কলকাতায় ইংরেজ সরকারের বা বিলিতি কোম্পানির চাকরি। সমরেশ দাদার রেল কোয়ার্টার্সে উঠলেন, স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হলেন। কিন্তু মনের পরিবর্তন ঘটল না। নবম শ্রেণিতে উঠেছিলেন কিন্তু চার দেওয়ালের ঘণ্টা-পেটা জীবন ও পড়াশোনা সইছিল না। স্কুলের বন্ধুরা যখন সিঁড়ি-ভাঙা অঙ্কে ব‍্যস্ত, সমরেশ তখন সিঁড়ি টপকে স্কুলের বাইরে। দু’বিঘার পরিবর্তে বিশ্ব-নিখিলের পাট্টা হাতে এল। বন্ধুরা যখন দশম শ্রেণির পাঠ নিচ্ছে, স্বামীর সংসার থেকে ছিটকে-পড়া গৌরীর প্রেমে জীবনের পাঠশালায় প্রবেশ করলেন সমরেশ। স্বেচ্ছায় চলে গেলেন কয়েক কিলোমিটার দূরে জগদ্দলের কাছে আতপুরের এক বস্তিতে। ডিম ব‍্যবসা, আট আনা রোজে কাজ, গৌরীর সামান্য সেলাইয়ের কাজ— তা থেকেই খাওয়া, থাকা, জামাকাপড়ের খরচ। অভাব ঠিক কী আর দিন চালানো কত কঠিন, জীবন থেকেই বুঝেছিলেন।

এ সবই তাঁকে লেখক হিসেবে তৈরি করছিল। শ্রমিক-নেতা সত‍্যপ্রসন্ন দাশগুপ্তের সঙ্গে পরিচয় তাঁকে শ্রমজীবী মানুষের কাছাকাছি নিয়ে যায়। হাতের লেখার গুণে শ্রমিকদের দাবিদাওয়ার পোস্টার লেখার দায়িত্ব পান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বাড়তি অস্ত্রের প্রয়োজনে আঁকায় দক্ষ সমরেশ ইছাপুর বন্দুক কারখানায় চাকরি পেলেন। বস্তি থেকে তত দিনে মিস্ত্রিদের পাড়ায় ঘর জুটেছে। পরবর্তী কালে তাঁর গল্প-উপন্যাসে শ্রমজীবী মানুষের লড়াই, শ্রমের মূল্য ও উদ্বৃত্ত মূল্যের কথা ছড়িয়ে পড়েছে। এর উপাদান তিনি সংগ্রহ করেছিলেন এই সব অঞ্চলের শ্রমিক ও শ্রমহীন মানুষের সঙ্গ থেকে। নিজের দারিদ্রও তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। ১৯৪৪-এ প্রকাশিত ‘আদাব’ থেকে ‘পাড়ি’, ‘নয়নপুরের মাটি’, ‘বি. টি. রোডের ধারে’, ‘শ্রীমতী কাফে’ থেকে শুরু করে শেষ জীবন পর্যন্ত নানা লেখায় কারখানা ও কৃষি শ্রমিকদের জীবনের কাহিনি শুনিয়েছেন।

জীবনের মতো তাঁর সৃজনেরও বৈশিষ্ট্য খড়ির গণ্ডি অতিক্রম করা। খণ্ডের চেয়ে অখণ্ডে, ঘরের চেয়ে বাইরে, সীমার চেয়ে অসীমে, স্থিতাবস্থার চেয়ে নতুন কিছুর প্রতি তাঁর টান বেশি। নয়নপুরের মৃৎশিল্পী মহিমকে জমিদারবাড়ির তরুণী বৌ কলকাতায় নিয়ে গিয়ে প্রচার ও প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করে দেবে বলে, কিন্তু দরিদ্র যুবক সেই অযাচিত অনুগ্রহ প্রত্যাখ্যান করে। গঙ্গা উপন্যাসে আতপুরের মালোপাড়ার মানুষজন গঙ্গার মাছ ধরেই সন্তুষ্ট ছিল কিন্তু তেঁতলে বিলাস উত্তাল সমুদ্রের দিকে আঠারো গন্ডা নৌকা নিয়ে অকুতোভয়ে এগিয়ে চলল, সঙ্গী হল নানা গ্রামের জলজীবী মানুষ। শেকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে উপন্যাসে কারখানার লোহা-কাটা শ্রমিক লছমন সৎ ও পরিশ্রমী, কিন্তু অভাবে সংসার বেহাল। মদ খায়, বৌকে পেটায় আর অন‍্য শ্রমিকদের মতো ঠিকাদারের অন্যায় মেনে নেয় পেটের চিন্তা ও প্রাণের ভয়ে। ঠিকাদার অন্যায় ভাবে মাইনে থেকে দু’পয়সা কেটে নেবে শুনে সে-ই কিন্তু ভয়কে জয় করে প্রতিবাদ জানায়, আর শ্রমিকদের বড় একটা অংশ পরে ‘দু’পয়সার আন্দোলন’-এ যোগ দেয়। এ হল ভয়ের পাথার পার হওয়া, নিজের গণ্ডি নিজেই অতিক্রম। মহাকালের রথের ঘোড়া-র কৃষিমজুর রুহিতন শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় সশস্ত্র লড়াইয়ে নামে, কিন্তু তা সফল হয়নি। তবু, অসংখ্য প্রান্তিক মানুষের মনে তার স্বপ্নের বীজ পোঁতা হয়ে গেছে।

রাজবৃত্তের কথা বহুশ্রুত, কিন্তু লোকবৃত্ত বড় ব্রাত্য। সে বৃত্তের নিবিড় পরিচয় তুলে ধরতে তাঁর দ্বিতীয় সত্তা কালকূটের জন্ম। তিনি পথে নেমেছিলেন লোকবৃত্তের প্রাণসন্ধানে, অনেকটা তাঁর পূর্বসূরি, বিক্রমপুরের অতীশ দীপঙ্করের মতো। কালকূটের উদ্দেশ্য জগৎ ও জগৎজনকে চেনা, সঙ্গে নিজের ভিতরে যে পড়শিনগর আছে সেখানেও খানিক বসত করা। শুরু অমৃত কুম্ভের সন্ধানে দিয়ে। তার পর কোথায় পাবো তারে আর অমৃত বিষের পাত্রে। যেন ভারতকথার এক-একটি পর্ব। নানা জনপদ থেকে আসা মানুষের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন আর ভাবছেন, এই সব মানুষের বাঁচার ধরন ও গড়ন কী অসাধারণ! কালকূট ধর্মবিশ্বাসী না, কিন্তু মানবধর্মে দীক্ষিত। তীর্থক্ষেত্র থেকে ফিরছেন বলে গ্রামের বুড়ি পায়ে এক কলসি জল ঢেলে প্রণাম করে। কালকূট লেখেন, “ঘরের কাছে এসে অবলা বাগদিনী আমাকে নতুন অমৃত-সন্ধানের জলধারা দিল পায়ে!” এঁরা কালকূটের প্রতিটি বইয়ের ভরকেন্দ্র। কালকূটও তাঁর সৃষ্ট শাম্ব চরিত্রের মতো রাজবৃত্তের মোহে না পড়ে লোকবৃত্তের স্বজন হলেন।

চৌষট্টি বছরের জীবনে সাহিত্যের জমিতে সোনার ফসল ফলিয়েছেন। দুঃখ থেকে যায়, রামকিঙ্কর বেজকে কেন্দ্র করে লেখা উপন্যাস দেখি নাই ফিরে শেষ করে যেতে পারেননি। প্রকাশিত পরিচ্ছেদগুলি পড়লে বোঝা যায়, অন্তরের গভীর তাগিদে এটি লেখা। রামকিঙ্করকে নিয়ে ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্রটিও শেষ হয়নি। যা যুক্তবেণি হওয়ার কথা ছিল তা মুক্তবেণি হয়ে ত্রিধারায় বয়ে গেছে জীবনের আপন খেয়ালে।

অন্য বিষয়গুলি:

Writer Novel Samaresh Basu Bengali Writer
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy