Advertisement
০৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Sarat Chandra Das

রাষ্ট্রের জন্য জরুরি বৃত্তি

যে গুপ্ত রাজনৈতিক দৌত্যের কথা বলা হল এখানে, যার অপর নাম গুপ্তচরবৃত্তি, তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে আছে রাষ্ট্রের ধরন, তার উত্থান ও পতন।

An image of Sarat Chandra Das

শরৎচন্দ্র দাশ। —ফাইল চিত্র।

ঈশা দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০২৩ ০৫:২৯
Share: Save:

আমরা বৌদ্ধধর্মের পণ্ডিত হিসাবেই চিনি শরৎচন্দ্র দাশকে (ছবি)। তাঁর রচিত দু’টি মহামূল্যবান গ্রন্থ অবদানকল্পলতাজার্নি টু লাসা— মহাবোধি সোসাইটিতে গেলে দেখতে পাওয়া যায়। তিনি বন্ধু-শিক্ষক, সহ-অধ্যক্ষ উগিয়েন গাটসো-র সূত্রে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তিব্বতে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল শরৎচন্দ্রের। মানচিত্রের নিঁখুত জ্ঞান, সাহসী ও সৎ চরিত্রের জন্য স্বয়ং বড়লাট তাঁকে পাঠান এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মিশনে। ১৮৭৯ সালে, বৌদ্ধ ভিক্ষুর বেশে শরৎচন্দ্র দাশ প্রবেশ করেন তিব্বতে। ফিরে আসেন তিব্বতের সুস্পষ্ট ভৌগোলিক জ্ঞান নিয়ে, তৈরি করেন মানচিত্র। ১৯০৩ সালে ফ্রান্সিস ইয়ংহ্যান্ডের নেতৃত্বে তিব্বত আক্রমণ করে ব্রিটিশ সরকার। অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে শরৎচন্দ্র দাশের গোপন দৌত্য, বৌদ্ধমঠে দিনযাপন। ভাষাশিক্ষা আমূল বদলে দেয় তাঁর অস্তিত্বকেও। তারই চিহ্ন অবদানকল্পলতা-সহ গ্রন্থসমূহে।

মনে রাখা ভাল, যে গুপ্ত রাজনৈতিক দৌত্যের কথা বলা হল এখানে, যার অপর নাম গুপ্তচরবৃত্তি, তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে আছে রাষ্ট্রের ধরন, তার উত্থান ও পতন। তাই তথাকথিত গুপ্তচরবৃত্তির ইতিহাস খুঁজতে গেলে ইউরোপে তার সন্ধান মেলে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে ‘নিউ মনার্কি’, অর্থাৎ ধর্মীয় ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে রাষ্ট্রপত্তনের সময় থেকে। বিশেষত ইংল্যান্ডে রানি প্রথম এলিজ়াবেথের সময় উইলিয়াম সিসিলের নেতৃত্বে প্রথম পেশাদার গুপ্তচর নিয়োগ শুরু হয়। ভারতবর্ষে গুপ্তচরবৃত্তির ইতিহাসের বয়স আরও কিছুটা বেশি বলে বোধ হয়। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র-এ প্রথম জানা যায় গুপ্তচরদের কথা। মোগল সাম্রাজ্যে, বিশেষত আকবরের শাসনকালে পেশাদার গুপ্তচরদের কথা জানা যায় আবুল ফজ়লের লেখায়। যে-হেতু রাষ্ট্রের ধরন, তার বহির্বাণিজ্যের ধরনও একটি ব্যাখ্যাযোগ্য সূত্র, তাই মোগল সাম্রাজ্যের সময় থেকে প্রচুর বিদেশি ক্রেতা-বিক্রেতার পথ ধরেই শুরু হয় সংবাদের আদানপ্রদান। কখনও বণিকের বেশে, কখনও বা ধর্মযাজকদের হাত ধরে। আধুনিক ভারতের ইতিহাস ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠা ও তার শোষণ-শাসনের ধরনের প্রয়োজনে এই জাতীয় সূত্রের দরকার স্বাভাবিক ভাবেই বজায় থাকে। যে শাসকের কাছে যত বেশি গোপন তথ্য, যে যত বেশি সেই তথ্যকে দমনপীড়নের কাজে ব্যবহার করে, সেই হয়ে ওঠে দীর্ঘস্থায়ী শাসক। শরৎচন্দ্র দাশ, রাষ্ট্রের এমন কাজেই ব্যবহৃত হন।

কিন্তু সুভাষচন্দ্র বসুর সহযোগী ভগৎরাম তলোয়ারের অস্তিত্বের গাথা ছিল আরও বিচিত্র। ভগৎরামের দাদাকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগদান করার অপরাধে ফাঁসির আদেশ দেয় ব্রিটিশ সরকার। দাদার মৃত্যুর পর ভগৎরাম তাঁর রাজনৈতিক কার্যকলাপের ধরন সম্পূর্ণ বদলে ফেলেন। যে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি তাঁর এত ঘৃণা, সেই সরকারেই ‘সিক্রেট এজেন্ট’ হয়ে কাজ করতে রাজি হয়ে যান ভগৎরাম। এ কি এক রকম বিশ্বাসঘাতকতা? এই আশঙ্কা অমূলক প্রমাণ করে, কাবুল আফগানিস্তানের অংশে ভারতীয় বিপ্লবীদের আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠেন ভগৎরাম। শুধু নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু নয়, অনেক ভারতীয় বিপ্লবীকেই নানা ভাবে সাহায্য করেন তিনি। বিস্ময়কর ছিল তাঁর অস্তিত্ব গোপন রাখার ক্ষমতা। ভারতীয় বিপ্লবীদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের কথা কখনওই জানতে পারেননি তাঁর ঊর্ধ্বতন ব্রিটিশ অফিসাররা। শুধু তা-ই নয়, ধীরে ধীরে ‘কুইন্টাপল এজেন্ট’ বা পঞ্চভুজ গোপন রাজনৈতিক দূত বা গুপ্তচর হয়ে ওঠেন। কী ভাবে? ব্রিটিশ সরকারের গুপ্তচরবৃত্তি করার সময়েই তিনি যুক্ত হন ইটালির ফ্যাসিস্ট সরকারের সঙ্গে। তাদের এত বেশি বিশ্বাসভাজন হয়ে ওঠেন যে, মুসোলিনির গুপ্তচর নিযুক্ত হন তিনি। মনে রাখা ভাল, ইটালি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির আরও একটি মুখ।

মুসোলিনির দেশ থেকে এই দৌত্য পৌঁছে যায় হিটলারের দেশেও। জার্মানিরও গোপন দূত হয়ে কাজ করতে শুরু করেন ভগৎরাম। ইংল্যান্ড জানতে পারে না যে ইটালির গুপ্তচর ভগৎরাম, জার্মানি জানতে পারে না যে ইংল্যান্ডের হয়ে দৌত্য করে ভগৎরাম, ইটালি জানতে পারে না যে জার্মানি বা ইংল্যান্ডের গুপ্তচরের নাম ভগৎরাম তলোয়ার। পরবর্তী কালে জাপানের সঙ্গেও কাজ করেন তিনি। এই সব ক’টি সূত্রই কাজে লেগে যায় যখন ভগৎরামের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় সুভাষচন্দ্র বসুর। তিনি শুধু যে আফগানিস্তানের পথে রাশিয়া যাওয়ায় সাহায্য করেন তা-ই নয়, জার্মানি পৌঁছবার, হিটলারের সঙ্গে ঐতিহাসিক সাক্ষাতের পথেও গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় অনুঘটক হয়ে থাকেন।

ভগৎরামের নাম আমরা মনে রাখি না। শরৎচন্দ্র দাশেরও না। নুর ইনায়েত খান, রবিন্দর কৌশিক বা সহমত খানেরও না। জাতি বা রাষ্ট্রের ইতিহাস রচনার সময়ে তাঁদের উল্লেখ গৌরবের সঙ্গে উচ্চারিত হয় না, কিংবা রাষ্ট্রনৈতিকতার সীমা আলোচনাতেও সহসা এঁদের কথা শোনা যায় না। এঁরা রাষ্ট্রের গোপনীয় কারবারের প্রতি শেষ পর্যন্ত বিশ্বস্ত থাকলেও তাঁদের নিজেদের দ্বন্দ্ব ও কৌশলের কথা উঠে আসে না গবেষণায়। অথচ রাষ্ট্রের কাছে অতি জরুরি যে গুপ্তচর বৃত্তি, তার একটা স্পষ্ট ধারণা মিলত এঁদের বৃত্তান্ত জানলে।

অন্য বিষয়গুলি:

Sarat Chandra Indian Scholar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy