E-Paper

বিদ্যাসাগর, মুক্তিযুদ্ধ ও তিনি

একটা বই কী ভাবে যে হয়ে ওঠে সময়ের আয়না! বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে গেলেন বিদ্যাসাগর— তাঁর জন্মসার্ধশতবর্ষে। বইটা বেরোনোর পরেই পাকিস্তানের গোয়েন্দা-নজরে পড়ে, একে বিদ্যাসাগর নিয়ে বই, তদুপরি লিখছেন লেখক-শিক্ষকরা।

গোলাম মুরশিদ।

গোলাম মুরশিদ।

শিশির রায়

শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০২৪ ০৬:৩১
Share
Save

আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস চর্চার একটা দুর্বল দিক, বহুপ্রজ লেখকের কেবল পাঠকপ্রিয় বইগুলো নিয়েই মেতে থাকা। কিংবা সেই বইগুলো নিয়ে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে যাদের দেখা মেলে। গোলাম মুরশিদ (ছবি) চলে গেলেন, ওঁর ক্ষেত্রেও এ কথাটা সত্য। তাই দেখি, ওঁকে স্মরণসূত্রে শুধুই আশার ছলনে ভুলি, বিদ্রোহী রণক্লান্ত, হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি বইগুলি আসে ঘুরেফিরে: কালান্তরে বাংলা গদ্য, বাংলা গানের ইতিহাস, বাংলা ভাষার উদ্ভব ও অন্যান্য, আধুনিকতার অভিঘাতে বঙ্গরমণী কদাচিৎ। আমরা সেই বইগুলোই জানি আর পড়ি, আমাদের কেজো জীবনে যাদের দরকার। পাঠকপ্রিয়তার বাইরে যে লেখকজীবন, অগ্নিগর্ভ সময় পেরিয়ে আসা যে লেখকজীবন, তার খবর কতটুকু জানি?

এমনই এক বই গোলাম মুরশিদ সম্পাদিত বিদ্যাসাগর, যেখানে লিখেছিলেন আহমদ শরীফ, বদরুদ্দীন উমর, মযহারুল ইসলাম, সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায়, রমেন্দ্রনাথ ঘোষ, সনৎকুমার সাহা-সহ সেই সময়ের বাংলাদেশের চিন্তকেরা— বাংলা, ইংরেজি, দর্শন, অর্থনীতি, ইতিহাসের জগতের মানুষেরা। লিখেছেন গোলাম মুরশিদ নিজেও। ‘সেই সময়’ মানে কোন সময়? ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে, মুক্তিযুদ্ধের মাসকয়েক আগে। ১৯৭০ সালটা বিদ্যাসাগরের জন্মের দেড়শো বছর, বইটি ‘বিদ্যাসাগর সার্ধ শতবার্ষিকী স্মারক গ্রন্থ’। গোলাম মুরশিদের কলমেই ধরা আছে তার জন্মকথা: সে বছর ২৬ সেপ্টেম্বর বিদ্যাসাগরের জন্মদিনের দিন দুই-তিন আগে মাথায় আসে একটা বই করার ভাবনা; তৎক্ষণাৎ সম্ভাব্য লেখক-তালিকা তৈরি, জনে জনে বলা, লেখা জোগাড়, এবং‌ তিন মাসের মধ্যে বই প্রস্তুত! বই যে দিন প্রেসে যাচ্ছে তার পরদিন পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন, যে ঐতিহাসিক নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ। তৈরি হয়েছিল অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা আর বাঙালি জাতীয়তাবাদকে হাতিয়ার করে তোলা এক স্বাধীনতার লড়াইয়ের অভূতপূর্ব জমি!

একটা বই কী ভাবে যে হয়ে ওঠে সময়ের আয়না! বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে গেলেন বিদ্যাসাগর— তাঁর জন্মসার্ধশতবর্ষে। বইটা বেরোনোর পরেই পাকিস্তানের গোয়েন্দা-নজরে পড়ে, একে বিদ্যাসাগর নিয়ে বই, তদুপরি লিখছেন লেখক-শিক্ষকরা। তখন তো জানা নেই, ২৫ মার্চ রাত ও তার পরে গণহত্যার অঙ্গ হিসাবে বুদ্ধিজীবী-নিধন কোন পর্যায়ে পৌঁছবে, এমনকি যুদ্ধ শেষে পরাজিত পাক বাহিনী আত্মসমর্পণের আগেও কী নৃশংস শেষ আঘাত করে যাবে ১৪ ডিসেম্বর! একাত্তরের জানুয়ারিতেও বাংলাদেশে উৎসবের মেজাজ, ভোটের এমন ফলাফলের পর শেখ মুজিব তো প্রধানমন্ত্রী হবেনই। ১৪ জানুয়ারি ইয়াহিয়া খান পর্যন্ত ঢাকায় তেমনটাই ঘোষণা করেছিলেন। এই আনন্দ ও উত্তেজনার আবহে, ১৭ জানুয়ারি প্রকাশ পেল ‘বিদ্যাসাগর সার্ধ শতবার্ষিকী স্মারক গ্রন্থ’, প্রধান অতিথি ছিলেন হাসান আজিজুল হক। দেশের প্রধান খবরকাগজগুলোয় ছাপা হল সেই খবর। মাস ঘুরল, মার্চ এল ক্যালেন্ডারে। ২১ মার্চ জ়ুলফিকার আলি ভুট্টো এলেন ঢাকায় শেখ মুজিবের সঙ্গে বৈঠক করতে। কী হয়-কী হয় ভাব, সবার চোখ খবরের কাগজে, কান রেডিয়োয়। গোলাম মুরশিদ লিখছেন, রাত সাড়ে দশটায় আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের খবর শুনতে অধীর সকলে, “সেই পরিবেশে প্রণবেশ সেনের লেখা এই গ্রন্থের একটি আবেগমূলক সমীক্ষা ততোধিক আবেগের সঙ্গে পড়ে শোনান দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। তাতে এই গ্রন্থের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয়েছিল। বিশেষ করে এর মাধ্যমে পূর্ব বাংলায় ধর্মনিরপেক্ষতার আন্দোলন যে যথেষ্ট জোরালো, সেটার ওপর বিশেষ ঝোঁক দেওয়া হয়।”

এ-হেন প্রশংসাবাক্যের পরে আর বাকি থাকে কী! এক রকম জানাই হয়ে গেল যে এ গ্রন্থের লেখকেরা ‘ভারতের দালাল’। পরিণাম? মুরশিদ জানাচ্ছেন, “যুদ্ধ শুরু হলেও তাঁরা লেখকদের ভুলে যাননি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের যে-দশজন অধ্যাপককে মেরে ফেলার তালিকা তৈরি করেছিলো সামরিক কর্তৃপক্ষ, তাঁদের মধ্যে মযহারুল ইসলাম, আমার এবং সনৎকুমার সাহার নাম ছিল তালিকার যথাক্রমে প্রথম, দ্বিতীয় ও চতুর্থ স্থানে।” তার পর আর এক যুদ্ধের শুরু, বেঁচে থাকার যুদ্ধ। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের সকালে তাঁর কন্যার জন্ম, ৩ এপ্রিল ছাব্বিশ দিন বয়সের শিশুটিকে নিয়ে আধা-শুকনো পদ্মা পেরিয়ে এপারে পালিয়ে আসা প্রাণ হাতে। পড়ে রইল রাজশাহীর ফ্ল্যাট, গবেষণার লেখালিখি, অ্যালবাম, চিঠিপত্র। বসার ঘরে টাঙানো ছিল রবীন্দ্রনাথের ছবি, বেরোনোর আগে ফ্রেম খুলে তার উপরে সেঁটে আসতে হল জিন্নার ছবি! সূর্য পাটে গেছে, অন্ধকার, হুহু হাওয়া সামলে হাঁটা, হাঁটু-জল পেরিয়ে ‘ভারত’। রাতটা এক পরিচিতের আশ্রয়ে কাটিয়ে পরদিন বহরমপুর, পরে ট্রেন ধরে কলকাতা। মৈত্রেয়ী দেবী ব্যবস্থা করে দেন নাসিরউদ্দীন রোডের এক ফ্ল্যাট, যেখানে একদা থেকেছেন সৈয়দ মুজতবা আলী! কাছেই থাকেন শম্ভু মিত্র-তৃপ্তি মিত্র।

এও এক ‘গল্প হলেও সত্যি’। গোলাম মুরশিদ লিখে গিয়েছেন এই বিবরণও, যখন পলাতক: মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি বইতে। সে বইটারও আজ খোঁজ পড়ে না। বিদ্যাসাগর বইটাও যাঁরা এই মনীষীর দু’শো বছর উদ্‌যাপন-আবহে সম্প্রতি ফিরে পড়লেন, আদৌ কি জানলেন, কোন সময়ের সঞ্জাত সে? গোলাম মুরশিদের প্রয়াণ মনে করিয়ে দিল সেই সব লেখককে, সময়ের প্রতি পূর্ণ দায়বদ্ধ থেকে যাঁরা গড়েছিলেন অতীত ও বর্তমানের সেতু।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bangladeshi Bangladesh Writer Author

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।