Advertisement
E-Paper

সরকারি দুর্নীতির দীর্ঘ ইতিহাস

সে সময় বাংলায় আটা বিক্রি হচ্ছিল সরকার-নির্ধারিত মূল্যের আড়াই গুণ বেশি দামে। সরকারি দর ছিল দু’আনা সের, কিন্তু খোলা বাজারে আটা বিক্রি হচ্ছে চোদ্দো আনায়।

ত্রাণসামগ্রী মাঝ পথে বেহাত হয়ে যাওয়ার ঘটনা এমন কিছু অভিনব নয়।

ত্রাণসামগ্রী মাঝ পথে বেহাত হয়ে যাওয়ার ঘটনা এমন কিছু অভিনব নয়। ফাইল ছবি।

নিখিল সুর

শেষ আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০২৩ ০৫:৪৫
Share
Save

পশ্চিমবঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার অর্থ বণ্টনে একটা বড়সড় অভিযোগ বেশ কিছু দিন ধরে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, জীর্ণ কুটিরনিবাসী মানুষের যে অর্থ পাওয়ার কথা বাড়ি নির্মাণের জন্য, তাঁদের অনেকের নাম বাদ গিয়েছে তালিকা থেকে। পরিবর্তে চোরাপথে তালিকাভুক্ত হয়েছে তাঁদের নাম, যাঁরা রীতিমতো কোঠাবাড়ির মালিক।

ত্রাণসামগ্রী মাঝ পথে বেহাত হয়ে যাওয়ার ঘটনা এমন কিছু অভিনব নয়। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে ১৩৫০ বঙ্গাব্দের মন্বন্তরের কথা, যে বিপর্যয় ছিনিয়ে নিয়েছিল বাংলার আনুমানিক তিরিশ লক্ষ মানুষের প্রাণ। বম্বে ক্রনিকল-এর সংবাদ অনুযায়ী, ভারত সরকারের নির্দেশে পঞ্জাবের প্রাদেশিক সরকার ১৯৪৩-এর অক্টোবরে দৈনিক সাতাশ হাজার মন গম পাঠিয়েছিল বাংলার বুভুক্ষুদের জন্য। টানা এক মাস ধরে পাঠানো হয়েছিল এই বিশাল পরিমাণ গম। তথাপি বাংলায় আটা বিক্রি হচ্ছিল সরকার-নির্ধারিত মূল্যের আড়াই গুণ বেশি দামে। আটার সরকারি দর সে সময় ছিল দু’আনা সের, কিন্তু অস্থায়ী ছোটলাট স্যর টমাস রাদারফোর্ড নিজে দেখেছিলেন, খোলা বাজারে আটা বিক্রি হচ্ছে চোদ্দো আনায়।

প্রবাসী পত্রিকা (কার্তিক, ১৩৫০) লিখেছিল, বম্বে ক্রনিকল-এর সাংবাদিক লাহোরে বঙ্গীয় সরকারের খাদ্যমন্ত্রী সুরাবর্দির কাছে প্রশ্ন রেখেছিলেন, “বঙ্গীয় ব্যবস্থা পরিষদের কোন কোন সদস্য সরকারের টাকায় খাদ্যদ্রব্যের দোকান খুলিয়াছেন এবং ফলে চাউল ও আটা দুর্ভিক্ষপীড়িত ব্যক্তিদের হাতে না পড়িয়া চোরা বাজারে চলিয়া যাইতেছে বলিয়া যে সংবাদ পাওয়া যাইতেছে তাহা সত্য কীনা?” বলা বাহুল্য, সুরাবর্দি এই অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন, যেমন যে কোনও অভিযোগ খারিজ করে দেওয়া এ কালেও রাজনৈতিক নেতাদের একটা দস্তুর। প্রবাসী স্পষ্ট জানিয়েছিল, মন্ত্রীর কথার সুরে যথেষ্ট সন্দেহের উদ্রেক হচ্ছে এবং তাঁর অস্বীকৃতিতে আস্থা স্থাপন করা কঠিন। মধুশ্রী মুখোপাধ্যায় সম্ভবত তাঁর চার্চিল’স সিক্রেট ওয়ার গ্রন্থে লেখেন, সরকার যে পরিমাণ গম পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তার এক-চতুর্থাংশ বাংলায় পৌঁছয়নি।

সন্দেহটা অমূলক নয়। কলকাতা ও শহরতলির জন্য সে সময় প্রয়োজন ছিল মাসে প্রায় ছেচল্লিশ হাজার টন আটা। যে অঞ্চলের প্রয়োজন ছেচল্লিশ হাজার টন, সেখানে চল্লিশ হাজার টন আমদানি হলে আটার বাজারদর কোনও ভাবেই ছ’আনার জায়গায় চোদ্দো আনা হতে পারে না। সুরাবর্দি নিজেই স্বীকার করেছিলেন, অগস্ট মাসে যে চল্লিশ হাজার টন গম পাঠানো হয়েছিল, সেই গম পেষার জন্য মিলে পাঠানো হয়। আটার একটা অংশ যায় কলকাতার মিলগুলিতে শ্রমিকের জন্য, কিছুটা যায় নিয়ন্ত্রিত দোকানগুলিতে, কিছু অংশ রুটির কারখানায় এবং বাকিটা মফস্‌সলের দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলে। তিনি কোনও নির্দিষ্ট পরিমাণের উল্লেখ করেননি, যা পাঠানো হয়েছিল বিভিন্ন স্থানে। পত্রপত্রিকাগুলির দাবি ছিল, শ্রমিকদের নামে ক্রীত আটার কতটা অংশ প্রকৃতপক্ষে শ্রমিকরা পাচ্ছেন আর কতটা চলে যাচ্ছে চোরাবাজারে, সে তথ্য উদ্ঘাটন করা দরকার।

গোপন মজুতদারদের প্রতি বঙ্গীয় সরকার মাঝে মাঝে ফতোয়া জারি করে ফাঁকা হুমকি দিয়ে মানুষের সন্দেহ দূর করার চেষ্টা করত, এমন অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ, বঙ্গীয় সরকার সতর্ক হতে চেয়েছিল একটা ব্যাপারে। ইস্পাহান কোম্পানির চাল কেনার অবাধ অধিকার বজায় রাখার জন্য তারা আটার ঘটনাটা চেপে যায়। এই সন্দেহ জাগে এ কারণে যে, মিল-মালিকদের গুদামে মজুত আটা এবং তাঁদের মাসিক বা সাপ্তাহিক ক্রয়ের পরিমাণ প্রকাশে প্রবল অনিচ্ছা প্রকাশ করে বঙ্গীয় সরকার।

বঙ্গীয় সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগের তর্জনী তোলে পঞ্জাব সরকারও। পঞ্জাব থেকে বঙ্গীয় সরকার যে দরে গম কিনছে, তার থেকে অনেক বেশি দরে সে গম সরকার বিক্রি করছে বাংলায়। এ অভিযোগ তোলেন খোদ পঞ্জাবের মন্ত্রী সর্দার বলদেব সিংহ, এবং তা যথারীতি অস্বীকার করেন সুরাবর্দি। কিন্তু পঞ্জাবের মন্ত্রীর অভিযোগ যে সত্য ছিল তার প্রমাণ, এই অভিযোগ গুঞ্জরিত হয়ে উঠলে অল্প কয়েক দিন পরেই বাংলায় আটার সরকারি দর নেমে যায় আট আনা থেকে ছ’আনায়। খাদ্যসচিব জোয়ালাপ্রসাদ একটা তদন্ত কমিটি বসিয়েছিলেন মরিস গয়ারকে চেয়ারম্যান করে।

মধুশ্রী মুখোপাধ্যায়ের মতে, যুদ্ধকালীন বিশ্বে সে দিন ব্রিটিশ রাজ, বিশেষত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের অঙ্গুলিহেলনেই ঘটেছিল এই মহা মন্বন্তর। প্রসঙ্গত, সুরাবর্দি বলেছিলেন, যদিও তিনি বিশ্বাস করতেন দুর্ভিক্ষ আসন্ন, ভারত সরকার নাকি তাঁকে সে কথা প্রকাশ করার অনুমতি দেয়নি, তাই তিনি ঘোষণা করেছিলেন বাংলায় খাদ্য ঘাটতির কোনও আশঙ্কা নেই। পঞ্জাব সরকার প্রেরিত গম বণ্টনের দুর্নীতি প্রসঙ্গে আলোচনায় কেন্দ্রীয় আইনসভার সদস্য ক্ষিতীশচন্দ্র নিয়োগী বলেন, বঙ্গীয় সরকার ভারত সরকারের উপর, আর ভারত সরকার বঙ্গীয় সরকারের উপর দোষ ও দায়িত্ব চাপাতে চেয়েছিল।

সেই ট্র্যাডিশন তো চলছে আজও।

Government Corruption Pradhan Mantri Aawas Yojna Relief Aid Indian Government

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।