E-Paper

সহজ বিশ্বাসের বন্ধনে

স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আমি একমাত্র ডাক্তার, এক জন নার্স আছেন। আছেন স্ক্যাভেঞ্জার স্টাফ কাইয়ুম। আমরা কাজ না করলে এই মানুষগুলির কী হবে! যা হয়েছে অত্যন্ত অন্যায় হয়েছে, ক্ষমার অযোগ্য অন্যায়, অপরাধ।

বিশ্বজিৎ রায়

শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:৪৫
Share
Save

কলকাতা থেকে অনেক দূরে ছোট্ট একটা গ্রাম কসবাগোলা। ওড়িশা সীমান্ত সংলগ্ন পূর্ব মেদিনীপুরের এই গ্রামের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রয়েছেন ডাক্তার অনিন্দিতা ঝা, সেই ২০০৭ সাল থেকে। বদলি হয়ে শহরের উৎসমুখে ফিরে যেতে একেবারেই ইচ্ছে করে না। কেনই বা করবে! এখানে থাকতে থাকতে তাঁর কাছে চিকিৎসার মানে একেবারে অন্য রকম হয়ে উঠেছে। শহরের অসরকারি হাসপাতালে তো বটেই, সরকারি হাসপাতালেও ডাক্তার ও রোগীর মধ্যে ‘সার্ভিস প্রোভাইডার’ আর ‘কনজ়িউমার’-এর সম্পর্ক। এখানে এই ছোট্ট স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কে-ই বা পরিষেবাদাতা, কে-ই বা ক্রেতা!

দু’পক্ষের আত্মীয়তা এখানে ঘন, গভীর। গ্রামের এক ঠাকুমা এসে বলেন, “বুড়ি-মা আমাকে একটু ভাল করে দেখে দে তো।” অনেক দিন আছেন বলে এখানে প্রায় সবাই তাঁকে বুড়ি-মা বলে ডাকেন। অনিন্দিতার বড় ভাল লাগে এই ডাক। বললেন, “জানেন, ওরা যদি আমাকে ‘ডাক্তার ম্যাডাম’ বলত, তা হলে হয়তো ওদের এমন আপন হয়ে উঠতে পারতাম না। এই ডাকের মধ্যে ওদের মনের টান মিশে আছে। আর জি করে যখন মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটল, তার খবর এখানে এক রকম ভাবে এসে পৌঁছল। এগরা থেকে তেরো-চোদ্দো কিমি দূরের এই গ্রামের মানুষজন খুব বেশি কিছু বোঝে না। এক জন ডাক্তারদিদি খুন হয়েছেন, এটুকু জেনেছে। আমি দিন দশেকের ছুটি নিয়েছিলাম। ওরা কেন জানি না, ভেবে নিয়েছিল আমারই বুঝি কিছু হয়েছে। ফিরে আসতে সেই ঠাকুমা কত যে আদর করল!”

জিজ্ঞেস করি, ডাক্তারদের কর্মবিরতির এই প্রতিবাদে শামিল হতে ইচ্ছে করে না? অনিন্দিতা একটু চুপ করে থাকেন। তার পর বলেন, “কলকাতার বন্ধুদের বলেছি, আমি কর্মবিরতির কথা ভাবতে পারি না। এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আমি একমাত্র ডাক্তার, এক জন নার্স আছেন। আছেন স্ক্যাভেঞ্জার স্টাফ কাইয়ুম। আমরা কাজ না করলে এই মানুষগুলির কী হবে! যা হয়েছে অত্যন্ত অন্যায় হয়েছে, ক্ষমার অযোগ্য অন্যায়, অপরাধ। কিন্তু তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে, সাধারণ মানুষের কাছ থেকে চিকিৎসক হিসেবে সরে যাব কেমন করে! বন্ধুদের বলেছি, ‘আমাকে ভুল বুঝিস না। আমি মানুষকে সচেতন করব। বিষয়টি নিয়ে ওদের সঙ্গে কথা বলব, কিন্তু কাজ বন্ধ করে দেব কী করে!’” অনিন্দিতা সকালে ন’টার মধ্যে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ঢুকে পড়েন, আড়াইটে-তিনটে পর্যন্ত আউটডোর করেন। প্রাথমিক এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে জটিল কিছু ব্যাধির সমাধান সম্ভব নয়, কিন্তু অনেক কিছু করা সম্ভব। স্বাস্থ্যের প্রাথমিক সচেতনতা, সাধারণ রোগ-ব্যাধির চিকিৎসা, সর্বোপরি মানুষগুলির কাছে থেকে তাঁদের ভরসাস্থল হয়ে ওঠা।

ওঁদের সঙ্গে কথোপকথনে অনিন্দিতাকে প্রথমে সাহায্য করতেন কাইয়ুম। অনিন্দিতা হয়তো ওষুধ দিয়ে বললেন, “সকালবেলায় খালিপেটে খেয়ো।” অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন তাঁরা, নির্দেশের অর্থ বুঝতে পারেন না। দোভাষীর কাজ করেন কাইয়ুম। বলেন, “ফজর বেলায় নার পেটে খাবে।” কাইয়ুম বুঝতে পারেন তিনি কেবল ময়লা পরিষ্কার করার কাজে নিযুক্ত নন, এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রেরই এক গুরুত্বপূর্ণ কর্মী। এখন অবশ্য দুই বাংলার মধ্যে দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক। ‘পা অদা থাকে বলে ঘা হয়’ বলে অনেকে। অদা মানে যে ভেজা, অনিন্দিতার বুঝতে অসুবিধে হয় না আর। বলেন, “পা অদা রাখিস কেন?” গ্রামের ছেলেরা একটু বড় হলে চলে যায় সুরাতে বা কেরলে। সেখানে বাগানে কাজ করে, বা পাইপলাইনের কাজ। মেয়েরা থাকে গ্রামেই। ছোট ছোট মেয়েরা কাছের স্কুলে পড়তে যায়, তাদের সঙ্গে বাংলা ভাষার দেওয়া-নেওয়ার কাজ অনিন্দিতার। স্থানীয় ভাষার শব্দ মান্য বাংলায় কী তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা, বিনিময়। বুড়ি-মার কাছে বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো খানিক বাংলা পড়ে-শেখে।

গর্ভনিরোধক নিয়ে মেয়েদের সঙ্গে আলাদা করে বসতে হয়। চব্বিশ বছরের একটি মেয়ে, এরই মধ্যে তিন সন্তানের জননী। সচেতন করতে হবে তো! প্রথম প্রথম একটু অসুবিধেই হত, যখন দেখতেন ‘কন্ট্রাসেপটিভ পিলস’ খাওয়া না-খাওয়ার সিদ্ধান্ত মেয়েটির ব্যক্তিগত নয়— পারিবারিক, তখন অস্বস্তি হত। শ্বশুর বা শাশুড়ি হয়তো বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে আসছেন। এখন অনিন্দিতার অসুবিধে হয় না। পারিবারিক ভাবেই বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন, বুঝিয়েছেন। শহুরে আধুনিকতা বা মেয়েদের যৌনতার ব্যক্তিগত অধিকারের দাবি নিয়ে সমাজের সর্বাংশের বিচার চলে না। স্বাস্থ্যনীতির মূল সূত্রগুলি প্রয়োগের সময় স্থানীয় সমাজ-সংস্কৃতির রূপটি খেয়াল রাখা চাই। স্থানীয় মানুষ যদি এসে বলেন, “তোর কম্পাসটা আমার বুকে দিয়ে দেখ ঠিক আছে না বুকের ভিতর সব গলে গেছে,” তখন উপহাস করা অর্থহীন, বিজ্ঞানের সূত্রাদি কপচানোরও মানে নেই। কম্পাস অর্থাৎ স্টেথোস্কোপ বুকে ঠেকিয়ে খুব মন দিয়ে দেখতে হবে। শ্বাস নিতে বলতে হবে। সম্পর্কের বিশ্বাস অর্জন না করলে চিকিৎসক ঠিকমতো কাজই করতে পারবেন না যে!

চলে যেতে ইচ্ছে করে না এখান থেকে? হেসে বলেন, “বিশ্বাস করুন, আমাকে যদি পিজি-তে বদলি করে দেয় তা হলে খুব মন খারাপ হবে। এদের সঙ্গে কেমন মিশে গেছি। আমার স্বামীও ডাক্তার, তার এমন রোম্যান্টিসিজ়ম নেই। আমার আছে। রোম্যান্টিসিজ়ম নয়: এখানে থাকার, সরল মানুষগুলোর সঙ্গে নিত্যদিন মেশার ভাল লাগা। সামাজিক মানুষ এক সময় ডাক্তারদের বিশ্বাস করতেন, ভালবাসতেন। সেই সম্পর্কটা নানা কারণে হারিয়ে গেছে। তাই হয়তো এত অবিশ্বাস, দুর্নীতির এমন বিস্তার। আমি বলছি না এই সম্পর্ক দিয়ে সব কিছুর সমাধান হয়, শুধু বলছি, এই সম্পর্ক, এই পারস্পরিক সামাজিকতা ছেড়ে কলকাতায় গিয়ে আমি শান্তি পাব না।”

অনিন্দিতার কথা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের কথা। সমাজকে ভিতর থেকে গড়ে নিতে চেয়েছিলেন, এই ছিল তাঁর নিজস্ব প্রতিবাদের ভাষা। ইতিহাসবিদরা বলেন, রবীন্দ্রনাথের সেই স্বদেশি গঠনমূলক স্বদেশি। সমকালে কখনও কখনও উগ্র তাৎক্ষণিক প্রতিবাদে শামিল হতে পারেননি বলে সমালোচিত হয়েছেন। বিপ্লবের নামে, দেশানুরাগের নামে উচ্চকণ্ঠ দেখনদারির বাইরে সত্যানুরাগী রবীন্দ্রনাথ পথ খুঁজেছেন— মানুষের কাছে যাওয়ার পথ, সামাজিক সহযোগিতার পথ। তা বৃহৎ অর্থে রাজনৈতিক, বিকল্প সে রাজনীতি। তা কত দূর সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে, কিন্তু অনিন্দিতা মানুষের সঙ্গে মানুষের যে সম্পর্ক বন্ধনের মধ্যে নিজেকে স্থাপন করতে পেরেছেন, তাকে অস্বীকার করি কী করে!

মাঝেমাঝে হয়তো রোগীর চাপ নেই, নিতান্ত গল্প করে যাচ্ছেন গ্রামের মানুষ। ছেলের বৌ নির্বাচন করেছেন যাকে তার ছবি দেখিয়ে বলছেন, “বুড়ি-মা, দেখে বলে দে তো লিভারের দোষ আছে কি না?” অনিন্দিতা হেসে বলেন, এ ভাবে বলা যায় নাকি?

এ ভাবে বলা যায় না। আবার অনেক কিছু বলাও যায়। রাজনৈতিক ধান্দাবাজির, ক্ষমতার কারবারের বাইরে মানুষের সমাজের অন্য রাজনীতির সহজ বিশ্বাসের গল্প কি নিতান্তই গল্প! কলকাতা থেকে অনেক দূরে, সীমান্তের প্রান্তে থাকা কসবাগোলা কি কলকাতার কেন্দ্রে থাকা ধর্মতলাকে সামাজিকতার ‘ধর্ম কী’ সে বিষয়ে কিছু বার্তা দিতে পারে!

অনিন্দিতার সামনে আদিগন্ত মাঠ। কলকাতায় এমন দিগন্ত দেখা যায় না। ধানে ভরা গরুরগাড়ি যখন যায়, ধানের শিষের শব্দে-গন্ধে ভরে ওঠেন তিনি। কোনও ভরে ওঠার গল্প কোনও রিক্ত মুহূর্তে শোনা ভাল। তখন বলতে ইচ্ছে করে, আমাদের সামাজিক গোলায় ধান এখনও শেষ হয়ে যায়নি, তা বাড়ন্ত। অনিন্দিতা সেই বাড়ন্ত ধানের শিষের শব্দ আর গন্ধের মধ্যে এক অন্য সত্য দর্শন করেছেন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

R G Kar Hospital Egra

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।