রাজনৈতিক মহলের ভিতরের লোক না হইয়াও রাজনীতির ভিতর পর্যন্ত কাঁপাইয়া দিলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ইমানুয়েল মাক্রঁ। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম পর্বে চার প্রার্থীর মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করিয়া তিনি ৭ মে অনুষ্ঠিতব্য চূড়ান্ত পর্ব অর্থাৎ রান-অফ পর্বে চলিয়া গেলেন, ইহাই একমাত্র কাঁপানোর মতো ঘটনা নয়। চার দিকে পরিব্যাপ্ত দক্ষিণপন্থী অভিবাসনবিরোধী সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের যে ধারা ইউরোপ-আমেরিকা তথা সমস্ত পশ্চিম বিশ্ব জুড়িয়া বহিতেছে, তাহাতে মাক্রঁর বিজয় একটি অতিপ্রতীক্ষিত ভিন্ বাতাস আনিয়া দিল, ইহাই আসল সংবাদ। অতি-দক্ষিণপন্থী মারিন ল্য পেন দ্বিতীয় স্থান অধিকার করিয়া পরবর্তী রাউন্ডে মাক্রঁ-র মুখোমুখি হইতে চলিয়াছেন। তবে যেহেতু তৃতীয় ও চতুর্থ স্থান দখলকারী অন্য দুই প্রতিদ্বন্দ্বী সমাজতন্ত্রী ফিলঁ এবং অতি-বামপন্থী মিলশঁ প্রায় প্রকাশ্য ঘোষণা করিয়া দিয়াছেন যে তাঁহারা সর্বতো ভাবে মারিন ল্য পেন-এর বিরোধিতা করিবেন, অর্থাৎ দ্বিপাক্ষিক লড়াইয়ের ক্ষেত্রে মাক্রঁকে সমর্থন দিবেন, ধরিয়া লওয়া যায় যে আগামী রাউন্ডের ফলাফলও খুব অনিশ্চিত নয়। ফ্রান্সের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট সম্ভবত ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমর্থক, মুক্ত অভিবাসন নীতি ও খোলা জাতীয় সীমান্তের প্রচারক মাক্রঁ-ই। ট্রাম্পের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং টেরেসা মে-র ব্রিটেন যাহাই বলুক না কেন, ফ্রান্স সম্ভবত মে মাসের পর উদারপন্থী গণতন্ত্র ও মুক্ত জাতীয়তাবাদের কথাই বলিবে।
এই কারণেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষে এ বারের ফরাসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। বাস্তবিক, অনেকেরই মতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ফ্রান্সে ইহার অপেক্ষা বেশি তাৎপর্যপূর্ণ নির্বাচন ঘটে নাই। এই তাৎপর্য কেবল সে দেশের সীমানার মধ্যে আবদ্ধ নয়। সমগ্র ইউরোপের অস্তিত্বের ধরনটি অতঃপর নির্ভর করিবে ফরাসি প্রেসিডেন্টে মতাদর্শের উপর। মনে রাখিতে হইবে, সাম্প্রতিক অতীতে গ্রিসের তীব্র অর্থনৈতিক সংকট এবং তাহা হইতে উদ্ভূত ই ইউ-এর অন্তর্বর্তী সংঘাতের সময় কিন্তু ফ্রান্স নিতান্ত দৃঢ় ভাবে গ্রিসের পক্ষ লইয়াছিল। এ বারও নাকি জয়লাভের পর মাক্রঁ-র প্রথম ফোনকলগুলির মধ্যে একটি গিয়াছে গ্রিসেই, তাহাদের উৎকণ্ঠা নিবৃত্তির লক্ষ্যে। জার্মান চ্যান্সেলর মার্কেল, ই ইউ-এর প্রধান ভারপ্রাপ্ত নেত্রীও বিরাট নিশ্চিন্তির শ্বাস ফেলিয়াছেন, প্রচারমাধ্যমে তাহা জানাইয়াছেনও। এই সামূহিক উৎকণ্ঠাই প্রমাণ করে, ইউরোপের বর্তমান মহাদেশীয় গোষ্ঠীটির অস্তিত্বের কতখানি নির্ভর করিতেছে পরবর্তী ফরাসি নেতৃত্বের উপর।
ফ্রান্স ও ব্রিটেনের বরাবরই পরস্পরের বিপ্রতীপে বিচরণ করিবার অভ্যাস। মধ্যযুগীয় প্রোটেস্ট্যান্ট-ক্যাথলিক বিভাজনের কাল হইতে এই ট্র্যাডিশন চলিতেছে। এ বারের নির্বাচনেও সেই ঐতিহাসিক ধারাটিরই আভাস! ব্রিটেন যখন ব্রেক্সিট পাকাপাকি করিবার জন্য ব্যতিব্যস্ত, মাক্রঁ-র ফ্রান্স সেই অবকাশে ই ইউ-কে স্থিত করিবার অভিমুখে কাজ করিবে, ধরিয়া লওয়া যায়। ব্রেক্সিট কার্যকর করিতে কি ইহাতে কোনও অসুবিধা বা বাধা তৈরি হইবে? পদ্ধতিগত ভাবে না হইলেও ব্রেক্সিট লইয়া ব্রিটেনে এবং ইউরোপে নূতন করিয়া কিছু সমাজমানসিক সংকট তৈরি হইবার সম্ভাবনা যথেষ্ট। তবে এই ধরনের বিভিন্নতা কিংবা বৈচিত্র শেষ পর্যন্ত অবাঞ্ছিত বলা যাইবে না। ইতিহাসের ভিন্ন ভিন্ন ধারা অতীতেও পাশাপাশি প্রবাহিত হইয়াছে। বর্তমান ও ভবিষ্যতেও এই ধরনের দেশভিত্তিক বৈচিত্র বিশ্বরাজনীতিকে সবল করিতে পারে। রক্ষণশীলতা ও সংকীর্ণতা যখন গোটা বিশ্বে দ্রুত সাম্রাজ্য বিস্তার করিতেছে, তখন যে ফ্রান্স তাহার বিরুদ্ধে মাথা চাড়া দিয়া উঠিয়া একটি পৃথক বার্তা দিতে পারিল, ইহাই অতি সুসংবাদ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy