— ফাইল চিত্র
ঘরে থেকে কী করবে? ইস্কুল নেই, লেখাপড়া নেই, ছেলে পাওয়া গেল, বিয়ে দিয়ে দিল”— বয়ানটা এক গ্রামবাসীর। সম্প্রতি নবম শ্রেণির ছাত্রীদের রেজিস্ট্রেশন উপলক্ষে মেয়েদের খোঁজে ইস্কুলের পার্শ্ববর্তী একটি গ্রামে গিয়ে জানা গেল, শুধু ওই একটি মেয়েরই না, অনেকেরই বিয়ে হয়ে গিয়েছে। এক ছাত্রীর ভাষায়, “খুব হালকা বয়সে বিয়ে হয়ে গেল।” জাতিধর্মনির্বিশেষে স্কুল বন্ধ থাকার মোক্ষম প্রভাব মেয়েদের জন্য বিয়ে আর ছেলেদের জন্য খাটতে যাওয়া। বিদ্যাসাগরের দ্বিশতবর্ষে ঘর হতে শুধু দুই পা ফেললেই এই পরিস্থিতি, কিন্তু ইস্কুল খোলা নিয়ে কোনও কথা নেই।
শিক্ষার অধিকার আইন বলে একটি জবরদস্ত আইন এ দেশে স্কুলশিক্ষায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছিল, বর্তমানে অতিমারি পরিস্থিতিতে সেটি সম্পূর্ণ ভূলুণ্ঠিত। অনলাইন ক্লাস শুরু হতেই তার লঙ্ঘন শুরু হয়, আশি ভাগ ছেলেমেয়েই লাইনের বাইরে। কেন জানি না, রাষ্ট্র এটাই ধরে নিয়েছে যে, ইস্কুল এক ধরনের বড় মাপের কোচিং ক্লাস মাত্র, কয়েকটি বিষয় গিলিয়ে দিলেই যথেষ্ট।
আর এই অনলাইন ও অফলাইনের খেলাতেই আবারও শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাট বৈষম্য এসে গেল। শিক্ষার অধিকার আইন প্রান্তিক বালিকাটিকেও স্কুলে আনার জন্য গোটা ব্যবস্থাকে উদ্যমী করেছিল, কিন্তু সরকারি স্কুলের পরিসরটুকুও যখন রইল না, তখন কিসের অধিকার? অতিমারি পরিস্থিতিতে শিক্ষা সংক্রান্ত আলোচনা শুধু অনলাইন বা দূরদর্শনের মাধ্যমে শিক্ষাতেই কেন্দ্রীভূত। এটা কিন্তু সকলেই জানেন যে, এই সুবিধা অধিকাংশ পরিবারে নেই। যেখানে আর্থিক অনটনে শিশুটিকেও উপার্জনে নামতে হচ্ছে— সেখানে স্মার্ট ফোন, তার নিয়মিত রিচার্জ, এ সব অলীক স্বপ্ন নয় কি? রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা শুধু ডিজিটাল ইন্ডিয়ার নাগরিকদের প্রতি!
করোনা পরবর্তী নব্য স্বাভাবিকতায় ধীরে ধীরে প্রায় সব বাঁধনই খুলে গেল। অফিস কাছারি, দোকান বাজার, সিনেমা, রঙ্গমঞ্চ, বাস ট্রেন, মেলা, উৎসব, এমনকি ভোট। খুলল না কেবল ইস্কুল। কলেজও খুলতে চলেছে, না হলে আছে অনলাইনে ক্লাস। এখনও পর্যন্ত কোনও আভাসও পাওয়া গেল না। পঠনপাঠন ছাড়া অন্যান্য সব কাজ চলছে। শিক্ষকদের এখন কাজ মাসে দুই তিন দিন গিয়ে মিড-ডে মিলের সামগ্রী অভিভাবকদের হাতে তুলে দেওয়া, শিক্ষাবর্ষ শেষে নতুন ভর্তি ইত্যাদিতে তাঁরা যুক্ত। কিন্তু যে কাজের জন্য স্কুল, তা সম্পূর্ণই বন্ধ।
শিক্ষকরা বহু কাল আগেই জাতির কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন। তাঁরা যে কতটাই অপ্রয়োজনীয়, অতিমারিতে তা আরও স্পষ্ট হল। বিপর্যয়ের দিনে কোনও কাজেই তাঁরা এলেন না, অথচ সুযোগ ছিল প্রচুর, প্রয়োজন ছিল একটু চিন্তাভাবনার, সরকারকেও অত ভাবতে হত না, কেবল শিক্ষকদের এবং সমাজের অন্যদের কাছে জানতে চাইলেই তাঁরা পথ বাতলে দিতেন। এক কালের সমাজবন্ধু শিক্ষকের লড়তে না পারার কোনও কারণ ছিল না, যদি তাঁর ভূমিকা নির্দিষ্ট করে দেওয়া যেত। তা তো হলই না, উপরন্তু, অভিযোগ, ‘বসে বসে মাইনে নিচ্ছে’। বস্তুত, শিক্ষকদের সঙ্গে সমাজের একটা অস্পৃশ্য-প্রায় বিচ্ছিন্নতা গড়ে দেওয়ার চমৎকার ব্যবস্থা, যার ফল হতে পারে সুদূরপ্রসারী। সমাজের সঙ্গে শিক্ষকের সম্পর্ক যদি হয় শত্রুতার, তা হলে সামাজিক বিষয় নিয়ে, সরকারি অব্যবস্থা ও ত্রুটি নিয়ে প্রতিবাদ সংগঠনের সম্ভাবনা ও ক্ষমতা, দুটোকেই কমিয়ে দেওয়া গেল!
এ রাজ্যে স্কুলশিক্ষা প্রধানত সরকারি স্কুলের উপর নির্ভরশীল; এটাও সত্য যে, নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশুদেরই এখানে সংখ্যাধিক্য। স্কুলের পড়াশোনার উপরেই এদের শিক্ষা টিকে আছে, পাঠ্য বিষয় আয়ত্ত করার জন্য স্কুল ছাড়া এদের গতি নেই। নিয়মিত স্কুলে আসায় পড়াশোনার সঙ্গে যে সম্পর্ক তৈরি হয়, সেটি আট-ন’মাসে নষ্ট হয়ে গেছে। গ্রামে গিয়ে দেখেছি, অভিভাবকেরা একটাই প্রশ্ন করছেন— কবে স্কুল খুলবে? বহু পরিবারেই মা-বাবা দু’জনেই কাজে যান, বাড়িতে দেখিয়ে দেওয়ার কেউ নেই, ছেলেমেয়েরা চূড়ান্ত অনিয়মে এ দিক ও দিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। টিউশন এমনিতেই স্কুলশিক্ষার কোনও বিকল্প নয়, তার উপর লকডাউনের আর্থিক পরিস্থিতি টিউশনের ক্ষেত্রেও সমস্যা তৈরি করছে।
এই শিক্ষাবর্ষ সম্পূর্ণ নিষ্ফলা, কেবল তা-ই নয়, আগের পড়াগুলো ভুলিয়ে দেওয়ার পক্ষেও যথেষ্ট। ধাপে ধাপে শিক্ষার যে গতি, তা বাধাপ্রাপ্ত হলে আবার মন বসানো যথেষ্ট কঠিন হবে।
গ্রামাঞ্চলে ইস্কুলের আশেপাশে যে কেউ দেখবেন, ম্লানমুখে কিছু ছেলেমেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ: তাদের জন্যই স্কুল, কিন্তু তাদেরই আজ প্রবেশ নিষিদ্ধ। কিছু কাগুজে কাজ চলছে, যেখানে ছাত্রছাত্রীরা পরিসংখ্যানমাত্র।
অতিমারির ত্রাসগ্রস্ত পরিবেশে, লকডাউনে বন্দি সময়ের বাঁধন শিথিল হতে না হতেই দেশ জুড়ে বিভিন্ন দাবিতে মানুষ পথে নেমেছেন। এই মুহূর্তে দেশের একটি অংশে লাখো লাখো কৃষক তাঁদের দাবি নিয়ে আন্দোলন করছেন। চাকরির নিরাপত্তার দাবিতেও মানুষ পথে নেমেছেন। কেবল ‘ইস্কুল খোলো’ বলে কোনও আন্দোলন হল না। কেন হল না, তার কারণ বোধ হয়, সমাজ, রাষ্ট্র, নেতা-মন্ত্রী-কর্মিবৃন্দের কাছে বাচ্চারা বাচ্চাই, মানুষ নয়। তাদের ভোট নেই, এবং তারা নিজেরা দাবি তুলতে পারে না। তাই তাদের শিক্ষা নিয়ে মাথাব্যথা নেই, স্বাস্থ্য নিয়ে মাথাব্যথা নেই।
অমর্ত্য সেন বারংবার বলেছেন, আমাদের দেশে শিশু অপুষ্টির মাত্রা নিম্ন-সাহারা অঞ্চলের শিশুদের থেকেও মারাত্মক। ভুল প্রমাণিত হলে তিনিই সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন, হা হতোস্মি, সম্প্রতি প্রকাশিত শিশু-পুষ্টি সংক্রান্ত রিপোর্ট অধ্যাপক সেনের অভিযোগটাকে আরও জোর দিয়ে তুলে এনেছে। স্বাস্থ্যের মতোই শিক্ষা কোনও অগ্রাধিকারের মধ্যে পড়ে না। পড়ে না বলেই অতিমারি ও লকডাউনেই শুধু নয়, তথাকথিত সব সামাজিক প্রয়োজনেই সব থেকে আগে ‘উৎসর্গ’ করা হয় ইস্কুলটাকে। রাজনৈতিক দলের সভা থেকে নিয়ে শুরু করে পুজো, যাত্রাপালা, মায় পুলিশক্যাম্প পর্যন্ত সব রকম দরকারে ‘ইস্কুল তো আছে’!
ভাবা দরকার, এই বঞ্চনা কি কেবল শিশুদের? এটা কি আসলে আমাদের স্বদেশের, ভারতবর্ষ নামক লোকনিবাসের নয়? জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন কেড়ে নেওয়ার হুঙ্কারেই কি সে আসন পাওয়া যায়, যদি না দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের, আমাদের শিশুদের শিক্ষায়, স্বাস্থ্যে, মানবিকতায় সমুজ্জ্বল করে তোলা যায়? ভারতের শিশুদের স্বার্থের প্রতি, তাদের অধিকারের দিকে দৃষ্টিপাত না করে কাল্পনিক ভারতমাতার আরাধনার চেয়ে বড় প্রবঞ্চনা— এবং আত্মপ্রবঞ্চনা— আর কী হতে পারে?
ইস্কুল খোলার দাবিটা এই প্রবঞ্চনা থেকে মুক্তি পাওয়ার দাবি। অবশ্যই ইস্কুল খোলার মধ্যে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সমস্যা আছেই। কিন্তু, চিন্তা-ভাবনা করলে, সামূহিক ভাবে উদ্যোগী হলে, এ বাধা দূর করা নিশ্চয়ই সম্ভব। আপাতত আমাদের যেটা ঠিক করতে হবে, তা হল— এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করব, না কি স্রোতে গা ভাসিয়ে দেব?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy