প্রতীকী ছবি।
সে দিনের ঝড়ের রাতে জানালা দিয়ে দেখা। বাড়ির উঠোনে দাদুর হাত লাগানো মস্ত পেঁও গাছটার মটমট শব্দ করে পাটকাঠির মতো ভেঙে পড়ল। দৃশ্যটা কিছুতেই ভুলতে পারছে না শিমুলতলার বছর সাতেকের ছোট্ট সৌগত ভৌমিক। আমপানের সেই ভয়ঙ্কর রাতের স্মৃতি এখনও মনে এলেই ভয়ে কুঁকড়ে যায়ছোট্ট শিশুটি।
সেই রাতে সৌগতর বাড়ির পেঁও গাছের মতো আরও কত শত গাছ যে ভেঙে পড়েছিল, তার একটা ছোট্ট উদাহরণ পাওয়া যায় নদিয়া-মুর্শিদাবাদের ডিএফও রানা দত্তের কথাতেই। তিনি জানান, ‘‘আমপান ও তার এক সপ্তাহের মাথায় আরও দু’টি ঝড়ে নদিয়া-মুর্শিদাবাদ ডিভিশনে শুধুমাত্র বন দফতরের নিজস্ব জঙ্গলেরই প্রায় ১৫০০ গাছ ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’’ তিনি আরও জানান, এমনিতেই নদিয়া-মুর্শিদাবাদে বনাঞ্চলের পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় প্রায় নগণ্য। তার উপরে এত গাছের ভেঙে পড়ার ফলে প্রকৃতি যে বড় মাপের ধাক্কা খেল, তাতে সন্দেহ নেই।’’ তবে তাঁর আশ্বাস এই বছর ২ লক্ষ ৪০ হাজার গাছের চারা তৈরি করেছে বনদফতর, যা দুই জেলায় বিলি করা হবে লাগানোর জন্য।
এ বড় দুঃসময়। করোনা আতঙ্ক, লকডাউনে ধসে পড়া অর্থনীতি। অগুনতি মানুষের কর্মহীন হয়ে যাওয়া, তার মধ্যে আমপান-সহ পর পর ঝড়ে নানা দিক থেকে বিপর্যস্ত স্বাভাবিক জনজীবন। এই ধরনের ঝড়-বৃষ্টির পর জনস্বাস্থ্যও যথেষ্ট উদ্বেগের মধ্যে পড়ে বলেই মত অনেক চিকিৎসকেরই। কৃষ্ণনগর শক্তিনগর জেলা হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক আমোদ প্রসাদ যাদবের মতে, ‘‘ঝড়, বৃষ্টি পরবর্তী সময়ে সব চেয়ে বেশি সচেতন থাকা উচিত পানীয় জল নিয়ে। কারণ, বৃষ্টির ফলে বিভিন্ন এলাকার দূষিত জল স্বাদু জলের সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে যায়। ফলে, তা থেকে বিভিন্ন জলবাহিত রোগ-জীবাণু ছড়ানোর আশঙ্কা যথেষ্ট বেড়ে যায়।’’ আন্ত্রিক, জলবাহিত জন্ডিসের মতো বেশ কিছু রোগের আশঙ্কা বেড়ে যায় ঝড়-বৃষ্টির মতো দুর্যোগের পরবর্তী সময়ে। এ ছাড়াও, ভেক্টর বাহিত রোগ, যেমন ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বাড়তে পারে। এই সময়ে জলবাহিত লেপটোস্পাইরোসিস রোগের প্রকোপ বাড়তে পারে। এটি একটি জলবাহিত রোগ, যা ইঁদুর দ্বারা বাহিত লেপটোস্পাইরোসিস ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে ছড়ায়। এ সব ক্ষেত্রে জ্বর, যন্ত্রণা উপসর্গ থাকে।
সাধারণত কৃষিক্ষেত্রে কাজ করেন যারা, বা নিকাশি পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত যাঁরা, তাঁদের লেপটোস্পাইরোসিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে বলে তাঁদের একটু বাড়তি সতর্কতা নেওয়া প্রয়োজন এই সময়ে, এমনটাই মনে করেন অনেক চিকিৎসক।
আমোদ প্রসাদ আর বলেন, ‘‘এই সময়ে করোনা পরিস্থিতির জন্য লক্ষ করা যাচ্ছে, প্রাথমিক অবস্থায় অনেকে রোগ গোপন করছেন। খুব বাড়াবাড়ি হলে তবেই হাসপাতাল বা চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছেন। ফলে, তাঁদের রোগ নিরাময় অনেক ক্ষেত্রে কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।’’ এই পরিস্থিতিতে তাঁর পরামর্শ, "রোগকে এড়ানোর জন্য রোগের কারণকে এড়ানো প্রয়োজন। তাই রোগ যাতে না হয়, সে জন্য অনেক বেশি স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল হতে হবে এই সময়ে।’’
এই ঝড়-বৃষ্টিতে বড় ক্ষতি হয়ে গিয়েছে চাষের। বিঘার পর বিঘা ফসল নষ্ট হয়েছে। চাষির মাথায় হাত উঠেছে। বড় বড় গাছ ভেঙে পড়ায় তাতে বসবাসকারী পশু, পাখি সবাই আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। যা পরোক্ষে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় ও বাস্তুতন্ত্রের উপরে বড় আঘাত হেনেছে। সব চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্রে। ঝড়, বৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাসে সেখানে চাষের জমিতে নোনা জল ঢুকে চাষের জমি নষ্ট হয়েছে। চাষের জমিতে বসবাসকারী বিভিন্ন উপকারি অণুজীব, ব্যাকটেরিয়া নোনা জলে ধ্বংস হয়েছে, যা পরিবেশের পক্ষে বড় আঘাত। এ ছাড়া এই সব এলাকায় নোনা জল মিষ্টি জলের সঙ্গে মিশে মিষ্টি জলে বসবাসকারী মাছেদের জীবন সংশয়ের কারণ হয়েছে।
তবে এই ঝড়-বৃষ্টিতে সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চল থেকে দূরবর্তী এলাকায় মাছ চাষের বড় ক্ষতি হলেও নদ-নদীর মাছেদের পরোক্ষে উপকার হয়েছে বলেই মত সিঙ্গুর সরকারি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান তথা মৎসবিদ দেবজ্যোতি চক্রবর্তীর। তাঁর মতে, ‘‘ঝড়-বৃষ্টিতে মাছ চাষের পুকুরে আশপাশের দূষিত জল ঢুকে চাষের মাছের জন্য নির্দিষ্ট পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। চাষ করা মাছের পুকুর ভেসে গিয়ে অনেক মাছ বেরিয়ে গিয়েছে। তাতে চাষীর বড় ক্ষতি হয়েছে এ কথা যেমন ঠিকই, তবে সেই সব ভেসে যাওয়া মাছ নদী, নালায় গিয়ে নদীর মাছের পরিমাণ বাড়িয়েছে।’’ তিনি জানাচ্ছেন, এতে নদীতে অদূর ভবিষ্যতে বড় মাছ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া এই বর্ষার সময়ে মাছের প্রজননের সময় হওয়ায়, নদীর আশপাশের শুকনো, নিচু জায়গাগুলো জলে ভরে গিয়ে কিছু কিছু মাছের ডিম পারার পরিবেশ তৈরি করেছে বলেও মত দেবজ্যোতির।
এই বছর অন্যান্য বছরের তুলনায় বারবার বড় ধরনের ঝড়ের প্রকোপ বেশি হচ্ছে বলেই মত অনেকের। তার কারণ প্রসঙ্গে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান নবকুমার মণ্ডল একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাঁর মতে, আমপানের মতো সুপার সাইক্লোন তৈরির বিভিন্ন কারণগুলির মধ্যে সম্ভাব্য একটা কারণের সঙ্গে করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউনের যোগ আছে বলে মনে করছেন অনেক বিশেষজ্ঞই। তিনি বলেন, ‘‘লকডাউনের সময়ে সারা বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন কলকারখানা, গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকায় সেগুলো থেকে নির্গত ধোঁয়া, ধুলোর পরিমাণ ভীষণ ভাবে কমেছে বায়ুমণ্ডলে। বাতাস তাতে পরিশুদ্ধ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এর ফলে আরও একটা ব্যাপার হয়েছে। তা হল, এই কার্বনকণা, বাতাসে ভাসমান ধূলিকণা নিয়ে গঠিত বায়ুমণ্ডলীয় এরোসল-এর মাত্রা কমেছে। এই এরোসলের মধ্যেই বায়ুমণ্ডলে ভাসমান জলকণা ঘনীভূত হয়ে মেঘ ও বৃষ্টির কারণ ঘটায়। অন্য দিকে, বঙ্গোপসাগরের উপরিভাগের তাপমাত্রা এই সময় ৩২ থেকে ৩৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মতো থাকায় সমুদ্রপৃষ্টের জল বাষ্পীভূত হয়ে উপর দিকে উঠে যাচ্ছে। কিন্তু বাতাসে এরোসলের পরিমাণ কম থাকায় সেই বাষ্প মেঘ বৃষ্টি হয়ে নেমে এসে স্বাভাবিক তাপমাত্রা ও চাপে ফিরিয়ে দিতে পারছে না সমুদ্রপৃষ্ঠকে। জল বাষ্পীভূত হওয়ার কারণে সেই অঞ্চলে যে নিম্নচাপের সৃষ্টি হচ্ছে, সেখানে পার্শ্ববর্তী উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে প্রবল বেগে বাতাস ছুটে আসছে। ফলে, তৈরি হচ্ছে গভীর ঘূর্ণিঝড় বা সুপার সাইক্লোন।
করোনা, লকডাউন, ভেঙে পড়া অর্থনীতি, লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মহীন হওয়া, সুপার সাইক্লোন— সব মিলিয়ে ২০২০ সাল যেন সত্যিই বিষে বিষ। কবে যে এর থেকে মুক্তি মিলবে, সেই অপেক্ষাতেই এখন দিন গুনছে সারা পৃথিবী। তবে তার মধ্যেও আমাদের এই প্রকৃতর পরিবেশের খেয়াল রেখে যেতে হবে। গাছ লাগাতে হবে আরও বেশি করে। যে ক্ষতি আমপানে হল, তার চেয়ে বেশি ক্ষতিপূরণ করে যেতে হবে পরিবেশকে ভালবেসে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy