লন্ডনের সাতটি প্রধান সমাধিস্থলের অন্যতম কেনসাল গ্রিন সিমেট্রি-তে গত ৪ অগস্ট হঠাৎ গান ভেসে এল, ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে’। দিনটা ছিল রবিবার। এক দল সাদা কালো বাদামি মানুষ ছোট শ্বেতশুভ্র একটি সমাধির সামনে জড়ো হয়েছিলেন। ভিক্টোরিয়ান ধাঁচের সমাধিটির ওপরের দিকে ইংরাজিতে লেখা ‘ডি টি’। আর নীচের দিকে লেখা, ‘দ্বারকানাথ টেগোর অব ক্যালকাটা’। এক দিন যে মানুষটির সদম্ভ পদধ্বনি এই বাংলার জোড়াসাঁকোর ‘ঠাকুরবাড়ি’র আনাচেকানাচে দৃঢ়তা এবং আধুনিকতার কণ্ঠস্বর হয়ে প্রতিধ্বনিত হত, সেই শালপ্রাংশু ‘রাজপুত্র’ কেনসালের এক ছোট্ট কোণে নিঃশব্দে শেষ শয্যা পেতেছিলেন ১৮৪৬ সালের ৫ অগস্ট। অবশ্য তাঁর চলে যাওয়ার দিনটি ছিল ১ অগস্ট। দেড় শতক পার হয়ে যাওয়া ওই সমাধির গায়ে আজও সেই উদ্যম, সেই চ্যালেঞ্জ-ভরা জীবনটি যেন এক টুকরো চোখের জল হয়ে লেগে আছে। সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা প্রিন্স দ্বারকানাথ একাই অনেক ছিলেন, তাই তাঁর সমাধির মতোই আসলে বড় একাও ছিলেন। এই বছর ২২৫ বছর বয়স হল ‘ঠাকুরবাড়ি’র সেই ‘বিস্মৃত নায়ক’-এর।
১৭৯৪ সালে কলকাতায় জন্ম হয় দ্বারকানাথ ঠাকুরের। ভট্টনারায়ণ বংশের কুশারী ব্রাহ্মণ পঞ্চানন ঠাকুর যশোর ছেড়ে যে পরিবারকে কলকাতায় টেনে আনেন, তার কৃতী ও ধনী পুরুষ ছিলেন সেরেস্তাদার নীলমণি ঠাকুর। নিজের সন্তান ছিল না বলে ভাই রামমণির ছেলে দ্বারকানাথকে দত্তক নিয়েছিলেন তিনি। ছোটবেলায় আরবি, ফারসি ভাষা শেখেন দ্বারকানাথ। বন্ধু উইলিয়াম এডামস, জে গর্ডন, জেমস প্রমুখের সংসর্গে ইংরেজি শেখেন সুন্দর ভাবে। রবার্ট ফার্গুসন নামের এক আইনজীবীর কাছে আইনশাস্ত্র চর্চা করেন। এর মধ্যে প্রয়াত হয়েছেন তাঁর পালকপিতা। বিবাহ হয়েছে দিগম্বরী দেবীর সঙ্গে। আইনকে পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছেন দ্বারকানাথ। সাফল্য তাঁর যাপনের সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে তত দিনে, সঙ্গে তীব্র সমালোচনাও। অশান্তি তাঁর বৈবাহিক ও সামাজিক জীবনকেও মুক্তি দেয়নি।
দ্বারকানাথ ঠাকুরকে অনেকেই চেনেন ‘ব্রাহ্ম আন্দোলন’-এর অন্যতম মুখ হিসাবে। ফার্গুসনের চেষ্টায় গোরাচাঁদ বসাকের বাড়িতে যখন ‘হিন্দু কলেজ’ প্রতিষ্ঠিত হয়, তিনি তার অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সেবামূলক বেশ কিছু কাজের সঙ্গে তাঁর নাম জড়িয়েছে। রাজা রামমোহন রায়ের ‘অ্যাংলো হিন্দু স্কুল’-এ পুত্র দেবেন্দ্রনাথকে ভর্তি করতেও ডরাননি দ্বারকানাথ।
তবু সব কিছু ছাপিয়ে এই ‘ঠাকুর’-এর আসল পরিচয় এমন এক কর্মযোগী হিসাবে, যিনি বাণিজ্যে এবং ক্ষমতার খেলায় ব্রিটিশকে সমানে সমানে টক্কর দিয়েছেন জীবনের শুরু থেকেই। এ ব্যাপারে দ্বারকানাথের অদম্য সাহস, জেদ এবং ঝুঁকি নেওয়ার মনোবল তাঁকে ‘প্রিন্স’-এর মুকুট পরিয়ে দিয়েছিল। একের পর এক জমিদারি কিনেছিলেন দ্বারকানাথ। রাজশাহি, শাহজাদপুর, বহরমপুর, পাণ্ডুয়া ইত্যাদি জায়গায়। নিজের স্ত্রীর মৃত্যু দেখে জীবনের অনিত্যতা বুঝেছিলেন বলে সে সব উত্তরাধিকারীদের ‘ট্রাস্ট’ করে দেন। জমিদারি তাঁর কাছে ভোগের ক্ষেত্র নয়, মূলধন সৃষ্টিকারী কারবার হয়ে উঠেছিল। ১৮২৮ সালে দ্বারকানাথ নিজেও চব্বিশ পরগনায় লবণ ও আফিমের আবগারি বোর্ডে ‘সেরেস্তাদার’-এর চাকরি পান। সমালোচনা আছে, অর্থ রোজগারের ক্ষেত্রে তিনি নীতির পরোয়া করতেন না। মহাজনিও তাঁর অর্থাগমের মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায় বলে অভিযোগ উঠেছিল। তবে সে অভিযোগ কেউ প্রমাণ করতে পারেননি। এর পর দ্বারকানাথ ‘ম্যাকিনটশ অ্যান্ড কোম্পানি’র সঙ্গে যৌথ ব্যবসায় অর্থ লগ্নি করেন। রফতানি বাণিজ্যে তাঁর ভাণ্ডার ফুলেফেঁপে ওঠে। ১৮২৯ সালে দ্বারকানাথ এক ঐতিহাসিক কাজ করেন। ‘ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক’ প্রতিষ্ঠিত হয় তাঁর উদ্যোগে। ভারতীয়দের মধ্যে এ এক বিরল দৃষ্টান্ত।
অবশ্য এই ক্ষেত্রেও সমালোচনা কম নেই। দ্বারকানাথের মূলধন বেড়ে মাত্র তিন বছরে সে কালের ষোলো লক্ষ টাকায় এসে ঠেকেছিল। এর পিছনে হুন্ডিজাত লুটপাটের রহস্য ছিল বলে অনেকেই মনে করেছেন। কিন্তু সেই সব সমালোচনা, নিন্দা ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে উল্কার বেগে এগিয়ে গিয়েছেন প্রিন্স দ্বারকানাথ। প্রথম ভারতীয় হিসেবে খেতাব পেয়েছেন ‘জাস্টিস অব দ্য পিস’। ১৮৪২-৪৩ সাল নাগাদ ঠাকুর পরিবারের তুঙ্গে বৃহস্পতি। ব্যাঙ্ক, বিমা, নীলের কারবার, কয়লাখনি, রফতানি বাণিজ্য এমনকি জাহাজ ব্যবসায় পর্যন্ত খাটছিল দ্বারকানাথের অর্থ।
রাগসঙ্গীতের সমঝদার ছিলেন ঠাকুরবাড়ির এই প্রিন্স। ইতালীয় সঙ্গীতের তালিমও নিয়েছিলেন। মঞ্চাভিনয়ের জগতে তাঁর অবদান স্মরণীয়। ‘দ্য চৌরঙ্গি থিয়েটার’ তো তিনি কিনেই ফেলেছিলেন। কিন্তু দ্বারকানাথের জীবনে নতুন বাঁক এল ১৮৪২ সালের ৯ জানুয়ারি। রাজা রামমোহনের মতোই তিনিও ইংল্যান্ড যাত্রা করলেন। কালাপানিতে ভাসল তাঁর নিজের জাহাজ ‘দ্য ইন্ডিয়া’। ব্রিটেনে পৌঁছতে আক্ষরিক অর্থেই রাজকীয় সংবর্ধনা পেলেন প্রিন্স। কে ছিলেন না সেই আয়োজনে? ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রবার্ট পিল, প্রিন্স অ্যালবার্ট, কেন্টের প্রিন্সেস থেকে শুরু করে স্বয়ং ইংল্যান্ডেশ্বরী রানি ভিক্টোরিয়া। এক জন ‘কালা আদমি’কে এমন সম্মান দিলেন ইংল্যান্ডের রানি! এঁদের দু’জনের বন্ধুত্ব নিয়ে অনেক জল্পনা, অনেক কাহিনি রচিত হয়েছে। ২৩ জুন আবার এল এক ঐতিহাসিক দিন। রানির সঙ্গে রাজকীয় সেনাবাহিনী পরিদর্শন করলেন দ্বারকানাথ। ৮ জুলাই নিমন্ত্রিত হলেন রানির নৈশভোজে। সে দিন মহারানি ভিক্টোরিয়া তাঁর ডায়েরিতে লিখলেন, “ব্রাহ্মণ ভদ্রলোক ভাল ইংরেজি বলেন। চমৎকার, বুদ্ধিমান মানুষ।” দ্বারকানাথের একটি স্কেচও আঁকলেন রানি, নিজের হাতে।
অক্টোবরে ব্রিটেন থেকে প্যারিসে যান দ্বারকানাথ। ফ্রান্সের রাজা লুই ফিলিপ তাঁকে স্বাগত জানান। ওই বছরই ডিসেম্বরে তিনি দেশে ফেরেন। ব্যবসা তখন মন্দগতি। বাজারে ধারদেনা বেড়ে চলেছে। এক দিকে আড়ম্বরপূর্ণ জীবন, অন্য দিকে অনির্দিষ্ট ভবিষ্যৎ দ্বারকানাথকে দিয়ে আবার একটি ‘ইচ্ছাপত্র’ লিখিয়ে নিল। ১৮৪৫ সালে ফের ইংল্যান্ড যাত্রা করেন দ্বারকানাথ। সঙ্গে নিলেন ডাক্তারি পড়তে ইচ্ছুক চার জন ভারতীয় ছাত্রকেও। শরীর ভাল যাচ্ছিল না তাঁর। শেষে এল ১৮৪৬ সালের ১ অগস্ট দিনটি। ‘সেন্ট জর্জ হোটেল’-এর বিছানায় শেষ ঘুম ঘুমোলেন দ্বারকানাথ। খুব ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল সে দিন।
কেনসাল গ্রিন সিমেট্রি-র বাহাত্তর একর জমি জুড়ে সুরম্য সবুজ। গাছের সারির মাঝখান দিয়ে রাস্তা চলে গিয়েছে এঁকেবেঁকে। পাখির গানে মুখরিত সেই সমাধিস্থলে বড় অবহেলিত, অকিঞ্চিৎকর হয়ে মলিন অবস্থায় এত দিন পড়েছিল প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের সমাধি। ভারতীয়রা ব্রিস্টলে রাজা রামমোহন রায়ের সমাধি দেখতে যেতে যত উৎসাহ বোধ করতেন, কেনসাল ততই চলে যাচ্ছিল বিস্মৃতির অতলে। গত বছর ‘বেঙ্গল হেরিটেজ ফাউন্ডেশন’ এবং ‘লন্ডন শারদোৎসব’-এর সদস্যরা উদ্যোগী হয়ে সংস্কার করেন সমাধিটি। তাঁর শেষ বাড়িটিরও সংস্কার করা হয়। প্রতি বছর অগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে এই সমাধির কাছে এসে প্রিন্সকে স্মরণ করার পরিকল্পনাও রয়েছে। এ বছর অনেকে মিলে জড়ো হয়ে এক বিরাট বাঙালিকে তাঁর ২২৫ বছরে স্মরণের উদ্যোগও ছিল সেই পরিকল্পনার অংশ।
প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের গতিময় ও বর্ণময় জীবনে প্রশংসার অধ্যায়ের সঙ্গে সমালোচনার পর্বও কম নয়। তাঁর প্রাত্যহিকীতে জৌলুস ছিল, নারী ছিল, কোলাহল ছিল, অশান্তি ছিল, জেদ ছিল, জয় এবং পরাজয় তো ছিলই। কিন্তু এই সব কিছুর আড়ালে তাঁকে একই সঙ্গে এক জন সাধক ও যোদ্ধা বললেও ভুল হবে না। যে অদম্য প্রচেষ্টায় পরাধীন ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে দেশি হাতে সময়ের ঘোড়ার লাগাম ধরে জোরসে টান দিতে পেরেছিলেন তিনি— তাকে প্রায় তপস্যার পর্যায়েও ফেলা যায়। ইংরেজের দেশে গিয়ে এই উপনিবেশের মানুষটি সাম্রাজ্যের রানির সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে উপনিবেশ দেশটিকেই এক বিরল সম্মান দিয়েছিলেন। উদ্যমহীন, কূপমণ্ডূক জনতার অলস জীবনকে পিছনে ফেলে, শাসিত হয়েও শাসকের সমাসনে নিজেকে অধিষ্ঠিত করতে পারা কম গৌরবের বিষয় নয়। বাঙালি এবং ভারতীয়রা আজ এক বার পিছনে তাকিয়ে ভাবতে পারেন, দ্বারকানাথের যে মশালটি দু’শো বছর ধরে সকলের অলক্ষ্যে, বিস্মরণপথে, জ্বলে রয়েছে— তার কতটুকু মর্যাদা তাঁরা দিতে পেরেছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy